দেশে প্রথমবারের মতো বুধবার (২ মার্চ) মানুষের দেহে কৃত্রিমভাবে হার্ট প্রতিস্থাপন করা হয়েছে।
রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে ৪২ বছর বয়সী এক নারীর হার্ট প্রতিস্থাপন করে হাসপাতালের চিফ কার্ডিয়াক সার্জন ও কার্ডিয়াক সেন্টারের পরিচালক ডা. জাহাঙ্গীর কবিরের নেতৃত্বে একটি টিম।
প্রখ্যাত চিকিৎসক ডা. জাহাঙ্গীর কবির বলেন, মানুষের মৃত্যুর সবচেয়ে বড় কারণ হার্ট ফেইলিওর। এ মৃত্যু রোধে দেশের মাটিতে হার্ট ট্রান্সপ্ল্যান্ট হবে এটা আমাদের স্বপ্ন ছিল। তা আজ পূরণ হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (৩ মার্চ) বিকেলে রাজধানীর গুলশানে ইউনাইটেড হাসপাতালে কৃত্রিম হার্ট প্রতিস্থাপনের সফলতা নিয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
ডা. জাহাঙ্গীর কবির বলেন, এই সাফল্যের পেছনে আমাদের অনেক দিনের প্রচেষ্টা ছিল। এজন্য বিগত ১৪/১৫ বছর ধরে আমরা চেষ্টা করেছি। এমন হয়েছে যে হার্ট ট্রান্সপ্ল্যান্টের জন্য সব প্রস্তুতি সম্পন্ন। কিন্তু নির্ধারিত দিন দুর্ভাগ্যবশত রোগী মারা গেছেন।
তিনি বলেন, এর পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান রোগী ও তার পরিবারের। তারা আমাদের ওপর আস্থা রেখেছিলেন। এমনিতেই আস্থা না পেলে কেউ কাউকে হার্ট দেন না। আমরা আস্থা তৈরি করতে পেরেছি ও তারাও এগিয়ে এসেছেন। এ রোগী সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, এমনকি তুর্কিতেও চিকিৎসা করেছেন। পরে দেশে ফিরেও তার হার্টের অবস্থা ভালো হয়নি। তখন আমরা তাকে হার্ট ট্রান্সপ্ল্যান্টের প্রস্তাব দেই। এতে রোগী ও তার পরিবার সম্মতি দেন।
এ চিকিৎসা অনেক ব্যয়বহুল জানিয়ে তিনি আরও বলেন, মেশিনটির দাম প্রায় এক কোটি টাকা। কৃত্রিম হার্টটি যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা হয়েছে। হাসপাতালে ভর্তি ও অপারেশনের সময় অনেক খরচ রয়েছে। সব মিলিয়ে প্রায় সোয়া কোটি টাকার মতো ব্যয় হতে পারে। আমাদের সদিচ্ছা আছে। সরকারসহ সবার সহযোগিতায় খরচ জনগণের আওতায় নিয়ে আসবো।
সংবাদ সম্মেলনে কৃত্রিম হার্ট প্রতিস্থাপনে অংশ নেওয়া বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে বুধবার (২ মার্চ) ওই রোগীর হৃৎপিণ্ডে মেকানিক্যাল হার্ট বা লেফট ভেন্ট্রিকুলার অ্যাসিস্ট ডিভাইস (এল্ভ্যাড) স্থাপন করেন। ডা. জাহাঙ্গীর কবির ও তার দক্ষ সহকর্মীরা প্রায় ৪ ঘণ্টা সময় ধরে সফল অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে হার্টমেট-৩ নামের একটি মেকানিক্যাল হার্ট রোগীর হৃৎপিণ্ডের বাম নিলয়ে স্থাপন করেন। পরে রোগীর হৃদপিণ্ডের কার্যকারিতা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে।
ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, এসময়ে উন্নত বিশ্বে হার্ট ফেইলিউরের একমাত্র চিকিৎসা আরেকটি সুস্থ হার্ট প্রতিস্থাপন। তবে যদি সুস্থ হার্ট না পাওয়া যায় বা পেতে দেরি হয় তাহলে মেকানিক্যাল হার্ট প্রতিস্থাপন করা হয়। এতে রোগীর হার্ট কিছুটা বিশ্রাম পায় ও সমস্ত শরীরের রক্ত চলাচল অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে আসে। এছাড়া শরীরে অন্যান্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গ যেমন- কিডনি, লিভার সুস্থ হওয়ার পায়। তীব্র হার্ট ফেইলিওরে আক্রান্ত কিছু রোগী হার্ট ট্রান্সপ্লান্টের উপযুক্ত না হলে একমাত্র বিকল্প উপায় মেকানিক্যাল হার্ট স্থাপন। এতে ওই রোগী বাকি জীবন সুস্থভাবে অতিবাহিত করতে পারেন।
বর্তমানে সারাবিশ্বে দশ মিলিয়নের বেশি মানুষ এ জটিল রোগে আক্রান্ত। এশিয়ায় এ রোগের প্রাদুর্ভাব এক দশমিক ২৬ শতাংশ থেকে ছয় দশমিক সাত শতাংশ।
জানা গেছে, দেশে এই প্রথম মেকানিক্যাল হার্ট প্রতিস্থাপনের ফলে দেশের রোগীরা বিশেষ করে বহুবিধ জটিল রোগাক্রান্ত রোগীরা মাত্র ঘণ্টা খানেকের এই পদ্ধতির মাধ্যমে হার্ট ফেইলিওর নিরাময়ের সুযোগ পাবেন।
প্রসঙ্গত, হৃৎযন্ত্র সম্পূর্ণভাবে বিকল হয়ে গেলেও কৃত্রিম হার্ট প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে একজন মানুষ দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে পারেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই সার্জারি হলেও দেশের মাটিতে এই প্রথম কৃত্রিম বা মেকানিক্যাল হার্ট প্রতিস্থাপনের ঘটনা ঘটেছে।
দেশে এই প্রথম মেকানিক্যাল হার্ট প্রতিস্থাপনের ফলে দেশের রোগীরা বিশেষ করে বহুবিধ জটিল রোগাক্রান্ত রোগীরা মাত্র ঘণ্টা খানেকের এই পদ্ধতির মাধ্যমে হার্ট ফেইলিওর নিরাময়ের সুযোগ পাবেন।
আজকাল অনেক কমবয়সি মানুষেরও হৃদরোগ হচ্ছে৷ চিকিৎসার অগ্রগতির ফলে তাদের সহায়তা করাও অনেক সহজ হয়ে পড়েছে৷ কিন্তু হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে গেলে অঙ্গ প্রতিস্থাপন ছাড়া উপায় নেই৷ এক কৃত্রিম হৃদযন্ত্র অনেকের প্রাণ বাঁচাতে পারে৷
বয়স যত বাড়ে, শরীরের কলকব্জাও বিকল হতে থাকে৷ স্বাভাবিক এ নিয়মে অনেক প্রবীণেরই হৃদযন্ত্র ঠিকভাবে কাজ করে না৷ বিশেষ করে যার মাধ্যমে সারা দেহে রক্ত সঞ্চালনের কাজটি হয় বলে মানুষ বেঁচে থাকে, হৃদযন্ত্রের সেই পাম্প নষ্ট হয়ে যায় অনেকেরই৷ সেক্ষেত্রে কেউ দান করলেই সমস্যার সমাধান৷ তো এভাবে হৃদযন্ত্রের প্রতিস্থাপনেও দেখা দিয়েছে সমস্যা৷ চাহিদা বাড়ছে, কিন্তু সেই অনুপাতে সরবরাহ বাড়ছে না৷ অঙ্গ দান করার লোক বাড়ছে না, সরবরাহ বাড়বে কি করে? এ অবস্থায় বাধ্য হয়ে কৃত্রিম পাম্পের দিকে ঝুঁকছেন সবাই৷
ফরাসি প্রতিষ্ঠান কারমাত ‘এসন’ ব্র্যান্ড নামে কৃত্রিম হৃৎপিণ্ড উৎপাদন এবং তা মানবদেহে প্রতিস্থাপন করতে শুরু করেছে। গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর ইউরোপীয় দেশগুলোর অনুমোদন লাভের পরপরই তা শুরু হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, মানবদেহে প্রতিস্থাপনের পর কৃত্রিম হৃৎপিণ্ড খুব ভালো কাজ করছে। এমনকি বিশ্রাম, ব্যায়াম, ভারী কাজ করার সময় আসল হৃৎপিণ্ডের মতোই সাড়া দিচ্ছে। অর্থাৎ হৃৎস্পন্দন কম-বেশি হওয়াতে আসল হৃৎপিণ্ডের সঙ্গে প্রায় কোনো পার্থক্য নেই।
মানুষের তৈরি হৃৎপিণ্ডের মূল অংশ হলো দুটি খুব ছোট পাম্পিং ইউনিট, যেটি পুরোপুরি মানুষের হৃদ্যন্ত্রের বিকল্প হিসেবে নিঃশব্দে কাজ করে। রোগীর চলাফেরা ও স্বাভাবিক কাজকর্মে যেন কোনো ব্যাঘাত না ঘটে, সেদিকে খেয়াল রেখেই দেহের বাইরে ব্যাটারি এবং অন্যান্য সরঞ্জামসহ একটি চার কেজি ওজনের ব্যাগ যুক্ত করা হয়েছে। এসব সরঞ্জাম হৃদ্যন্ত্রটি সঠিক কাজকর্ম করছে কি না, সেদিকে খেয়াল রাখে ও ত্রুটি দেখা দিলে তাৎক্ষণিকভাবে জানিয়ে দেয়।
এর মূল অংশ হলো একটি পাম্পিং ইউনিট, যেটি পুরোপুরি মানুষের হৃদযন্ত্রের বিকল্পের কাজ করে৷ সেটি চালায় এমন এক ইঞ্জিন, যা একটি মাত্র অংশ দিয়ে তৈরি এবং যেটি সহজেই চৌম্বক ক্ষেত্রে নড়াচড়া করতে পারে৷ আরডাব্লিউটিএইচ আখেন-এর ফেলিক্স গ্রেফ বলেন, ‘এখানে কয়েল দেখতে পাচ্ছি, পেঁচানো কয়েল, আর এখানে কালো চুম্বকগুলি৷ কয়েলে বিদ্যুত চলাচল শুরু হলে পেন্ডুলামের মতো নড়াচড়া শুরু হয়৷ ফলে হৃদপিণ্ডের বাম ও ডান চেম্বারের ভেন্ট্রিকল বা নিলয় খালি হয় এবং শরীরে রক্তের চলাচল সৃষ্টি হয়’৷
কোনো তার ছাড়াই শুধু ত্বকের মাধ্যমে কৃত্রিম হৃদযন্ত্রে বিদ্যুৎ পাঠানো হয়৷ ত্বকের নীচে তার না থাকায় সংক্রমণও ঘটে না৷ রোগীর বেল্টে ব্যাটারি বসানো থাকায় হাঁটাচলার ক্ষেত্রেও আর তেমন কোনো বাধা থাকে না৷ অধ্যাপক স্টাইনসাইফার বলেন, ‘এখান থেকে কৃত্রিম হৃদযন্ত্রে শক্তি পাঠাতে হয়৷ সমস্যা হলো ত্বকের মাধ্যমে তা প্রেরণ করা৷ আমরা এ ক্ষেত্রে ‘ইন্ডাকটিভ কাপলিং’ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই কাজ করছি৷ দুটি কয়েল-এর মধ্যে একটি ইমপ্লান্ট করা রয়েছে৷ অন্যটি বাইরে থাকে৷ ‘ইন্ডাকশন’ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শক্তি পাঠানো হয়৷ এটা সহজেই দেখানো যায়৷ একটি এলিমেন্ট কাছে আনলেই ডায়ড জ্বলে ওঠে৷ অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে ‘ইন্ডাকটিভ’ প্রক্রিয়ায় বিদ্যুৎ পাঠানো হচ্ছে’৷
হৃৎপিণ্ডের চেম্বারদুটির মধ্যে ‘ফ্লো’ এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়৷ রক্ত অতি দ্রুত বা অতি ধীরে চলাচল করলে চলবে না৷ অন্যথায় চেম্বারের ক্ষতি হতে পারে৷ কম্পিউটার সফটওয়্যারের মাধ্যমে গবেষকরা রক্তের প্রতিক্রিয়া সিমুলেট করছেন৷ রক্তের সারফেস ও গতিবিধি ভালো করে পর্যবেক্ষণ করা হয়৷ অধ্যাপক স্টাইনসাইফার বলেন, ‘আমরা আমাদের কৃত্রিম হৃদযন্ত্রে শুধু ‘অপটিমাইজড সারফেস’ ও উপকরণ ব্যবহার করেছি, যা রক্ত বহনের জন্য বেশ উপযুক্ত৷ এছাড়া পাম্পিং চেম্বারে রক্ত চলাচলের আদর্শ পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে’৷
এদিকে সুইজারল্যান্ডের ইটিএইচ জুরিখ কেন্দ্রে দীর্ঘদিনের গবেষণার পর থ্রিডি প্রিন্টারে নরম সিলিকন দিয়ে কৃত্রিম হৃৎপিণ্ড তৈরি করা হয়েছে, যা মানুষের আসল হৃদযন্ত্রের মতোই কাজ করছে বলে দাবি করেছেন বিজ্ঞানীরা।
বিজ্ঞানীরা জানান, ধাতু ও প্লাস্টিকের তৈরি পাম্পের মাধ্যমে হৃদযন্ত্রের বিকল্প হিসেবে যা ভাবা হয়েছিল, তার চেয়ে সিলিকনের তৈরি হৃদযন্ত্র অনেক বেশি কার্যকরী। ঠিক মানুষের রক্ত-মাংসের হৃদযন্ত্রের মতোই এটি কাজ করবে। আসল হৃদযন্ত্রের মতো এতে দুটি অলিন্দ রয়েছে। তবে বিভাজিকার বদলে রয়েছে দুটি আলাদা প্রকোষ্ঠ। যার একটি প্রকোষ্ঠের মধ্য দিয়ে রক্ত প্রবেশ করতে পারে এবং অন্যটির মধ্য দিয়ে তা পাম্প হয়ে বেরিয়ে যেতে পারে।
বিজ্ঞানীরা আরো জানান, এ সিলিকন হৃদযন্ত্র তিন হাজার বার বিট করতে পারছে। এরপরই অবশ্য এর কাজ সমাপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এ সিলিকন হৃদযন্ত্রের সহায়তায় একজন মানুষ ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট বেঁচে থাকতে পারবে। তবে গবেষকরা এখন এমন এক পদার্থের খোঁজ চালাচ্ছেন যা আসল হৃদযন্ত্রের মতোই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবে।
পুরো পৃথিবীতে মানুষের মৃত্যুর জন্য যতগুলো কারণ আছে, সবগুলো কারণের শীর্ষে আছে হৃদ্রোগ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, পৃথিবীতে হৃদ্রোগের কারণে প্রতিবছর অকালে প্রাণ হারায় প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ মানুষ। অনেকেই তাই হৃদ্রোগকে ‘অসংক্রামক অতিমারি’ আখ্যা দিয়েছেন। হৃদ্যন্ত্র বিকল হয়ে গেলে অঙ্গ প্রতিস্থাপন ছাড়া উপায় নেই। আর তাই কৃত্রিম হৃৎপিণ্ড আশার আলো দেখাচ্ছে। গবেষক ও বিশেষেজ্ঞরা নিশ্চিত যে কৃত্রিম হৃৎপিণ্ড বাঁচাবে বহু প্রাণ।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৫২
আপনার মতামত জানানঃ