বাংলাদেশের ৫০ বছরের ইতিহাসে জাপাই প্রথম কোনও বিরোধী দল, যে দল ছিল সরকারের অংশও৷ জাতীয় পার্টির তিন জন মন্ত্রী পুরো পাঁচ বছরই দায়িত্বও পালন করেছেন৷ দলের প্রধান এরশাদ ছিলেন মন্ত্রী পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত৷ বেশ আগে থেকেই জাপার এই চরিত্রের জন্য রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ তাদের বলছেন, ‘গৃহপালিত’ বিরোধীদল৷ আর ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বলেছে, ‘অকার্যকর’ বিরোধী দল৷
জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর নানা ধাপ পেরিয়ে ক্ষমতার কেন্দ্রে আসেন তখনকার সেনা প্রধান এইচ এম এরশাদ। ক্ষমতায় আসা এবং পরবর্তীতে রাজনীতিতে আসার ক্ষেত্রে এরশাদ তার পূর্বসূরী জিয়াকে হুবহু অনুসরণ করেছিলেন। জিয়া যেমন ১৮ দফা দিয়ে রাজনীতিতে নেমেছিলেন। এরশাদ নেমেছিলেন ১৯ দফা নিয়ে। জিয়ার মতোই প্রথমে ফ্রন্ট-জোট ইত্যাদি ধাপ পেরিয়ে ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় পার্টি গঠিত হয়।
এরশাদ ক্ষমতায় থাকতে ৮৬ ও ৮৮ সালের প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল। কিন্তু আমার বিবেচনায় জাতীয় পার্টি সবচেয়ে ভালো ফল করেছিল ৯১ সালের নির্বাচনে। পতনের পর দলের চেয়ারম্যান এরশাদ কারাগারে। দেশজুড়ে জাতীয় পার্টির বিরুদ্ধে প্রবল জনমত। সরকারও জাতীয় পার্টির বিরুদ্ধে। মাঠে নামলেই মার খায়। এমন অবস্থায় জাতীয় পার্টি এককভাবে নির্বাচন করে প্রবল উজানে সাঁতার কেটে ৩৫টি আসন লাভ করে।
কারাগারে থেকেও সদ্য ক্ষমতাচ্যুত এরশাদ পাঁচটি আসনে জিতে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। এরপর নানান জোট মিলে আরো ৫টি নির্বাচনে অংশ নিলেও ৯১এর সাফল্য আর ছুঁতে পারেনি জাতীয় পার্টি। সর্বশেষ দুটি নির্বাচনে জাতীয় পার্টি প্রধান বিরোধী দল হয়েছে। কিন্তু ২০১৪ সালে আসন পেয়েছিল ৩৪টি, আর ২০১৮ সালে পেয়েছিল ২০টি। এই সাফল্যও এসেছে আওয়ামী লীগের সাথে জোটের সুবাদে।
মূলত আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিলেমিশেই রাজনীতিতে আছে জাতীয় পার্টি। ২০১৪ সালের ‘একতরফা’ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গী ছিল জাতীয় পার্টি। মহাজোটের শরিক হয়ে দলটি একসঙ্গে সরকারে ও বিরোধী দলে ছিল। আবার ২০১৮ সালের ‘বিতর্কিত’ নির্বাচনও একসঙ্গে করেছে দল দুটি। সমঝোতায় সংসদে প্রধান বিরোধী দলও হয়ে যায় জাতীয় পার্টি।
রাজনীতির মাঠে আওয়ামী লীগের সহকর্মী হওয়া ছাড়া, জাতীয় পার্টির আর কোন গুরুত্ব নেই। এর শুরু বেশ আগেই। তবে এরশাদের মৃত্যুর পর নিতুন মাত্রা যোগ হয়েছে এই অবনমনে। এরশাদের মৃত্যু হতে না হতেই নেতা-কর্মীদের অন্য দলে যোগদান, বহিষ্কার-প্রত্যাহার নাটক, গঠনতন্ত্র অনুসরণ না করে বিশেষ ক্ষমতাবলে পদোন্নতির রাজনীতি গিলে খেয়েছে জাপার সাংগঠনিক শক্তি।
সংসদের প্রধান বিরোধী দল হলেও মাঠের রাজনীতিতে দলটির নেই কোনো জনসম্পৃক্ত কর্মসূচি। এজন্য আগের তুলনায় স্থবির হয়ে পড়েছে দলীয় কর্মকাণ্ড। জোটবন্ধু আওয়ামী লীগের সঙ্গেও দূরত্ব বাড়ছে জাপার। প্রতিবেশী দেশগুলোও আর আগের মতো কাছে টানছে না এই দলটিকে।
সারাদেশে জাপার দলীয় কর্মকাণ্ড নেই। নেই কোনো পেশাজীবীর সঙ্গে সম্পর্ক। এছাড়া সিভিল সোসাইটির সঙ্গেও নেই কোনো সম্পর্ক। বিরোধী দল হিসেবে জাপার যেভাবে ভূমিকা রাখার কথা সেভাবে কোনো দৃশ্যমান ভূমিকা নেই। নেই কোনো জনসম্পৃক্ত কর্মসূচিও
জাতীয় পার্টিকে গুরুত্ব দেয় না বাংলাদেশে নিযুক্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতরা। দশম ও একাদশ সংসদে প্রধান বিরোধী দলের দায়িত্ব টানা দুইবার বর্তেছে জাতীয় পার্টির উপর।
এর পর থেকেই দলের গুরুত্ব বাড়াতে বিদেশিদের কাছে চিঠি দেন দলটির নেতারা। এর পরও জাপাকে তেমন একটা পাত্তাই দিচ্ছে না তারা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে দলটির একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য বলেন, গত কয়েকদিনে বাংলাদেশ সফর করে গেলেও ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রধান বিরোধী দল জাপার সঙ্গে বৈঠকে বসেনি।
দলটির একজন সাংগঠনিক সম্পাদক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, নিজেদের সঙ্গে ভারতের সুসম্পর্ক রয়েছে- এমন বলে কয়েকজন সিনিয়র নেতা দলের শীর্ষ কমান্ডকে বিভ্রান্ত করে আসছেন। আসলে এসব সঠিক নয়। এসব কথা বলে অতীতে পদ-পদবি আদায় করেছেন ওই নেতারা।
যেসব কারণে জাতীয় পার্টি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার মধ্যে মনোনয়ন বাণিজ্য অন্যতম। জাতীয় পার্টির মনোনয়ন বাণিজ্যের ধরনটা অন্য দলগুলোর সঙ্গে মেলে না। বছরের পর বছর একজন শ্রম-ঘাম দিয়ে পার্টিকে সংগঠিত করেন আর ভোটের সময় চিলের মতো ছোঁ মেরে মনোনয়ন বাগিয়ে নেন অতিথি পাখিরা।
নতুন নেতার আর্বিভাব হলে ভালো হওয়ার কথা, যদি ভোটের পরে তারা দলের সঙ্গে থাকতেন। কিন্তু সমীকরণ বলছে এসব হায়ারিং নেতা একজন ছাড়া কেউই জাতীয় পার্টির সঙ্গে থাকেননি। ভোটের পরে কেউ দ্রুত, কেউ সময়ের ব্যবধানে হাওয়ার মিলিয়ে গেছেন।
অন্যদিকে ত্যাগী মনোনয়ন বঞ্চিত নেতারাও ক্ষোভে অভিমানে কেউ দল ছেড়েছেন। অন্যরা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন। এতে জেলায় জেলায় এক ধরনের নেতৃত্বের শূন্যতা তৈরি হয়েছে। এভাবে দিনে দিনে ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়ছে জাতীয় পার্টি।
বাইরে থেকে লোক এনে প্রার্থী করাকে লোকজন হায়ার করা প্রার্থী বলে অভিহিত করেন। পার্টির সিনিয়র নেতারাও এমন মন্তব্য করে থাকেন। তবে মাঠের কর্মীরা একে বলেন মুরগি ধরা। ভোটের মুখে এসে টাকাওয়ালা দেখে মুরগি বানানো হয়। একেক সময় একেকজনকে মুরগি বানানো হয়। এখানে ধুয়া তোলা হয়, তার টাকা আছে, ভোটে খরচ করে ভালো ফল করতে পারবেন।
পার্টির নেতাদের ভাষায় এসব মুরগি অভিযানে দল ক্ষতিগ্রস্ত হলেও চেয়ারম্যানের আশপাশে থাকা নেতারা ঠিকই লাভবান হয়েছেন। কখনও কখনও খোদ পার্টির চেয়ারম্যান সুবিধা পাওয়ার কথা ওপেন সিক্রেট বিষয়। জিএম কাদের পার্টির চেয়ারম্যান হওয়ার পর দীর্ঘদিনের এই রেওয়াজ বন্ধ হয়ে যাবে এমন আশায় বুক বেঁধেছিলেন নেতাকর্মীরা। কিন্তু তার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বরং ক্ষেত্র বিশেষে বেড়ে গেছে।
জাপা প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘‘তাদের তো রাজনীতিতেই থাকার কথা না৷ এরশাদের বিরুদ্ধে তো জনঅভ্যুত্থান হয়েছে৷ তারপর আমরা গণতন্ত্রে এলাম৷ সেখানে এসে দেখলাম, তিনি আবার এর মধ্যে ঢুকে গেছেন৷ তাদের আসলে জনগণের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই৷ তাদের অবস্থান সব সময় সুবিধাবাদী৷ সরকারে, আবার বিরোধী দলে, এটা তো কৌতুকের মতো হয়ে গেছে৷”
তিনি বলেন, ‘‘সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে এ ধরনের জিনিস পাওয়া যাবে না৷ সাম্প্রতিককালে তো পাওয়া যাবেই না৷ এদের হাতে আসলে টাকা আছে, তারা সরকার এবং বিরোধী দলে থাকার কারণে সংসদীয় গণতন্ত্রের অভূতপূর্ব ক্ষতি হয়েছে৷ বিরোধী দলের দায়িত্ব হচ্ছে সরকারের নীতির গঠনমূলক সমালোচনা করা৷ তারা যে কথাগুলো বলেছে, তা সরকারি দলও বলেছে৷ সরকারকে কোনোরকম জবাবদিহিতার মধ্যে তারা আনতে পারেনি৷ আমরা তো দেখেছি, সংসদে বিরোধী দলীয় নেত্রী প্রশ্ন করছেন, আমাদের ভূমিকা কী?”
জাতীয় পার্টির সবচেয়ে বড় শক্তি এরশাদ। জাতীয় পার্টির সবচেয়ে বড় দুর্বলতাও ছিলেন এরশাদই।জাতীয় পার্টির আদর্শিক দৃঢ়তা কোনকালেই ছিল না। ব্যক্তি এরশাদকে ঘিরেই জাতীয় পার্টির বিবর্তন। সংবিধান লঙ্ঘন করে ক্ষমতায় এসেছেন এবং নিষ্ঠুর কায়দায় আন্দোলন দমন করেছেন, এটা ঠিক।
আবার এরশাদের নয় বছরে বাংলাদেশে উন্নয়নও কম হয়নি। এরশাদ উন্নয়ন দিয়ে গণতন্ত্রের ঘাটতি পুষিয়ে দিতে চাইতেন। বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নটা শুরু হয়েছিল এরশাদের হাত ধরেই। নানান প্রশাসনিক সংস্কারও করেছিলেন তিনি। আজকের উপজেলা পদ্ধতি এরশাতের প্রবর্তন করা।
এছাড়া এরশাদ আমলে প্রণীত স্বাস্থ্যনীতিও ব্যাপক প্রশংসিত। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগেও এরশাদকে পাশে পেয়েছে সাধারণ মানুষ। আর রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারটা সবচেয়ে ভালোভাবে করতে পেরেছিলেন এরশাদ। তাই তার কিছু জনপ্রিয়তা আছে দেশজুড়ে। তাছাড়া স্বৈরাচার এরশাদ পতনের পর গত ৩ দশকে আওয়ামী লীগ আর বিএনপি যেভাবে দেশ চালিয়েছে, তাতে তুলনামূলক বিচারে এরশাদের পাপ অনেকটাই কমে গেছে। কেউ কেউ এমনও বলেন, এরশাদ আমলই ভালো ছিল।
সব মিলিয়ে ব্যক্তি এরশাদের একটা জনপ্রিয়তা ছিল। তাছাড়া প্রায় চার দশক ধরে বাংলাদেশের প্রধান দুই দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন দুজন নারী। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এর বিপরীতে কারো কারো কাছে এরশাদ ভালো বিকল্প। কিন্তু গত প্রায় ১১ বছর ধরে সরকারি দলের লেজুড় হিসেবে থাকতে থাকতে জাতীয় পার্টির জনপ্রিয়তায় ধ্বস নেমেছে। তাই বাস্তবে জাতীয় পার্টি এখন একটি ক্ষয়িষ্ণু আঞ্চলিক দল। টিকে থাকা শুধু নাম সর্বস্ব।
এসডব্লিউ/এসএস/১৭০০
আপনার মতামত জানানঃ