গত অর্থবছরে (২০২০-২১) সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) ১ হাজার ৯৫৪ টি প্রকল্পে বরাদ্দ দেয় সরকার। এর মধ্যে ৬৬২ টি প্রকল্পের বাস্তবায়ন হার (অর্থ ব্যয়) সন্তোষজনক নয়, বরং হতাশাব্যঞ্জক বলে উঠে এসেছে বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) পর্যালচনায়।
আইএমইডি’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাস্তবায়ন কাজের (ফিজিকাল প্রোগ্রেস) কোনো অগ্রগতি হয়নি এমন প্রকল্পে সংখ্যা ১১৭টি। অথচ বাস্তব অগ্রগতি শূন্য হলেও এই ১১৭টি উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ৪১৯ কোটি ১৮ লাখ কোটি টাকা। আর এক টাকাও খরচ হয়নি অন্য ৯০টি প্রকল্পে। এছাড়া ৮১৪টি প্রকল্পের আর্থিক ও বাস্তব অগ্রগতি সন্তোষজনক নয়।
আইএমইডি’র কর্মকর্তরা জানান, বুধবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভায় প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করা হবে।
কী উল্লেখ আছে প্রতিবেদনে
অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বাস্তবায়ন অগ্রগতি ২৫ শতাংশের নিচে এমন প্রকল্পের সংখ্যা ১০৮টি। ২৬ থেকে ৫০ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে ১৩১টি প্রকল্প। এবং ৫১ থেকে ৭৫ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে এমন প্রকল্প রয়েছে ২৩৩টি। এসব প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ মোটেই সন্তোষজনক নয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০-২১ অর্থবছরের এডিপিতে মোট প্রকল্প সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৯৫৪টি। এর মধ্যে ১১৭টি প্রকল্পের অনুকূলে বরাদ্দ দেওয়া হয় প্রায় ৩ হাজার ১৫০ কোটি টাকা। বিভিন্ন প্রকল্পে খরচও হয়েছে প্রায় ৪১৯ কোটি ১৮ লাখ টাকা। কিন্তু বাস্তব অগ্রগতি ছিল শূন্য। এছাড়া ৯০টি প্রকল্পের অনুকূলে বরাদ্দ ছিল ১ হাজার ৭৮৯ কোটি টাকা। কিন্তু পুরো অর্থবছরে এক পয়সাও খরচ করতে পারেনি মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো।
আইএমইডি’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, মোট ১ হাজার ৯৫৪টি প্রকল্পের মধ্যে ২৬ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত অর্থ ব্যয় হয়েছে ১৩০ প্রকল্পের। আর ৫১ শতাংশ থেকে ৭৫ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয়েছে ৩২০ টি প্রকল্পের। এসব প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতিও সন্তোষজনক নয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোকে সরকার চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দ দিলেও তা ঠিকভাবে ব্যয় করতে পারছে না তারা। ফলে অর্থবছরের মঝপথে এডিপি সংশোধন করেও ব্যয় কমানো হয়। এরপরেও অনেক প্রকল্পে অর্থ ব্যয় সম্ভব হয় না।
আইএমইডির প্রতিবেদন অনুযায়ী বেশ কিছু মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে চিহ্নিত করা হয়েছে, যেগুলো বৈদেশিক সহায়তার অর্থ ব্যয়ে ব্যর্থ হয়েছে। এর মধ্যে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ, প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়, আইন ও বিচার বিভাগ, খাদ্য মন্ত্রণালয়, ভূমি মন্ত্রণালয়, সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়সহ ১১টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ রয়েছে, যারা লক্ষ্যমাত্রার ৫০ শতাংশ বা তারচেয়েও কম অর্থ ব্যয় করতে পেরেছে।
অর্থ ব্যয় হলেও অগ্রগতি শূন্য থাকা প্রকল্পগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ল্যান্ড ইকুইজিশন অ্যান্ড ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফর ইমপ্লিমেন্টেশন অব পটুয়াখালী ১৩২০ মেগাওয়াট কোল ফায়ারড থার্মাল পাওয়ার প্লান্ট প্রকল্প। এটির মোট ব্যয় ধরা হয় ৮৬৯ কোটি ৭০ লাখ টাকা। এর মধ্যে ২০২০-২১ অর্থবছরের এডিপিতে বরাদ্দ ছিল ১১২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ব্যয় করা হয় ৮৭ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। কিন্তু বাস্তব অগ্রগতি শূন্য রয়েছে।
এছাড়া পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন অ্যান্ড সিস্টেম ডেভেলপমেন্ট চিটাগাং জোন (সেকেন্ড ফেজ) প্রকল্পটির অনুকূলে বরাদ্দ ছিল ৩১৫ কোটি টাকা। ব্যয় করা হয় ১৯৯ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। অগ্রগতি শূন্য। জয়িতা টাওয়ার স্থাপন প্রকল্পের অনুকূলে বরাদ্দ ছিল ১ কোটি ৭২ লাখ টাকা। খরচ হয়ে গেছে তারও বেশি ৩ কোটি ২৭ লাখ টাকা। কিন্তু বাস্তব অগ্রগতি নেই। নতুন জন্ম নেওয়া শিশুদের উন্নত চিকিৎসার জন্য হাতে নেওয়া প্রকল্পে বরাদ্দ ছিল ১০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যয় হয়ে যায় ৯ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। এরপরও অগ্রগতি শূন্য রয়েছে।
অর্থ ব্যয় হলেও বাস্তব অগ্রগতি শূন্য আরও কয়েকটি প্রকল্প হচ্ছে, এনহ্যান্সিং ক্যাপাসিটি ইন কটন ভ্যারাইটিজ ডেভেলপমেন্ট প্রকল্প, মডার্নাইজেশন অব এক্সজিসটিং চরমুগুরিয়া ইকোপার্ক আন্ডার মাদারীপুর ডিস্ট্রিক্টস প্রকল্প এবং প্রকিউরমেন্ট অব ভুয়াপুর-তারাকান্দি রোড থ্রো প্রটেকশন অব লিফট ব্যাংক অব যমুনা রিভার ইন সরিষাবাড়ী উপজেলা অব জামালপুর ডিস্ট্রিক্টস প্রকল্প। রিপাওয়ারিং প্রজেক্ট অব ঘোড়াশাল চতুর্থ ইউনিট। প্রকিউরমেন্ট অব সার্ভিস ভেসেল ফর মোংলা পোর্ট প্রকল্প এবং স্ট্র্যাটেজিক মাস্টার প্ল্যান ফর মোংলা পোর্ট প্রকল্প।
এদিকে, গত অর্থবছরে শূন্য আর্থিক অগ্রগতির প্রকল্পের সংখ্যাও ৯০টি। এসব প্রকল্পে কোনো অর্থ ব্যয় করা হয়নি। শূন্য আর্থিক অগ্রগতির এসব প্রকল্পের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগত বেশ কিছু প্রকল্পও রয়েছে। গত অর্থবছরের সংশোধিত শূন্য ব্যয়ের প্রকল্পে মোট ১ হাজার ৭৮৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল।
এছাড়া, ১২২ টি প্রকল্পে অর্থ ব্যয় হয়েছে বরাদ্দের ২৫ শতাংশেরও কম। এসব প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি হতাশাজনক বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
এর কারণ কী?
এর কারণ হিসাবে বলা হয়েছে, করোনা মহামারির প্রভাব, অর্থছাড় না হওয়া বা দেরিতে ছাড় হওয়া এবং ভূমি অধিগ্রহণ না হওয়া। এছাড়া দরপত্র আহ্বানে দেরি হওয়া, দরপত্র রেসপন্সিভ না হওয়া, প্রকল্পের ঋণ না পাওয়া, মামলাজনিত সমস্যা, ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) সংশোধন, সংশোধিত এডিপি অনুমোদনে দেরি এবং উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে ঋণ চুক্তিতে দেরি হওয়ার কারণে প্রকল্পগুলোর এই অবস্থা হয়েছে।
আইএমইডির সাবেক সচিব ও বর্তমান পরিকল্পনা সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, সাধারণত এমনটা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু যেহেতু হয়েছে, সেহেতু আইএমইডির দায়িত্বের অংশ হচ্ছে প্রকল্প ধরে ধরে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রশ্ন করা। বরাদ্দ আছে, অর্থ ব্যয় হয়েছে, কিন্তু বাস্তব কোনো অগ্রগতি নেই। এমন কেন হয়েছে তা খুঁজে দেখতে হবে।
আইএমইডি’র প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, অর্থছাড় না হওয়া, ভূমি অধিগ্রহণ না হওয়া, দরপত্র আহ্বানে বিলম্ব, দরপত্রে সাড়া না পাওয়া, সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ছাড়াই প্রকল্প হাতে নেওয়া, ভৌত কাজের সঠিক নকশা না থাকা, বৈদেশিক ঋণ নিশ্চিত না করে প্রকল্প নেওয়া, অপ্রতুল বরাদ্দ, যথা সময়ে প্রকল্প সংশোধন না করা, কর্মপরিকল্পনা ও ক্রয় পরিকল্পনা না থাকার কারণে এসব বরাদ্দে অর্থ ব্যয় করা সম্ভব হয় না।
সংশ্লিষ্টদের মতামত
গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ
ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস)-এর সাবেক গবেষণা পরিচালক জায়েদ বখত বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আন্তরিকতার অভাবেই প্রতি বছর এমনটি ঘটছে বলে মনে হয়।
এ বিষয়ে তিনি ৩টি প্রধান বাস্তবায়নজনিত ত্রুটির কথা উল্লেখ করেন- অনিশ্চিত ভূমি অধিগ্রহণ, সময়মতো প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দিতে না পারা এবং তহবিল নিশ্চিত না করে প্রকল্প হাতে নেওয়া।
বিআইডিএস’র সাবেক এই গবেষক আন্তরিকতা, প্রকল্প নেওয়ার আগে সঠিক পরিকল্পনা এবং সক্ষমতার চেয়ে বেশি প্রকল্প গ্রহণ না করার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫২২
আপনার মতামত জানানঃ