দাবানল, দাবদাহ, খরা, বন্যা, মাত্রাতিরিক্ত বৃষ্টিপাত ও ঘূর্ণিঝড়ে বিশ্ব এখন বিপর্যস্ত। অঞ্চলভেদে বিভিন্ন দেশে এসব দুর্যোগ দেখা যাচ্ছে। চীন, ভারত ও জার্মানিতে চলতি মৌসুমে কয়েক দফা বন্যা, ঘূর্ণিঝড় হয়েছে। কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র স্মরণকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রার মুখে পড়েছে। গ্রিস, তুরস্ক, ইতালিসহ দক্ষিণ ইউরোপ পুড়ছে দাবানলে। বেলজিয়ামসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশ রেকর্ড বৃষ্টিপাত দেখেছে। ব্রাজিল, মাদাগাস্কারসহ গোটা আফ্রিকা খরায় বিপর্যস্ত। জলবায়ুর এমন চরম বৈরিতার মুখে বিশ্ব।
বর্তমান বিশ্বে ব্যাপকভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীতে প্রতি বছর ত্বরিত গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে গড় তাপমাত্রার পরিমাণ। সাম্প্রতিক সময়ে অতিমাত্রা জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এখন বিশ্বকে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের এই বিরূপ প্রভাবের কবলে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পৃথিবীর কোথায় নেই? পৃথিবীর প্রায় সব দেশ ছাপিয়ে পরিবেশ দূষণ আর জলবায়ু পরিবর্তন চলে গেছে পৃথিবীর দুই মেরু অ্যান্টার্কটিকা আর আর্কটিকে। পৃথিবীর উত্তরের মেরু অঞ্চল আর্কটিকের তাপমাত্রা বাড়ছে, গলছে বরফ।
চারদিকে বরফ গলে যাওয়ার নেতিবাচক খবর প্রকাশিত হচ্ছে। যা দেখে চিন্তিত পরিবেশবিদরা। বিভিন্ন সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, যেভাবে গ্রিনল্যান্ডের বরফ গলছে, তাতে অচিরেই নাকি ডুবে যাবে যুক্তরাষ্ট্র!
গত ১০০ বছরে যতটা উঠেছিল তার সমান তো বটেই তার চেয়েও বেশি উপরে উঠে আসতে পারে মহাসাগরের পানিস্তর। আগামী ৩০ বছরে। আমেরিকার পূর্ব ও পশ্চিম, দু’টি উপকূলেই। উষ্ণায়ন ও দ্রুত হারে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য আমেরিকার লাগোয়া প্রশান্ত মহাসাগর ও আটলান্টিক মহাসাগরের পানিস্তর ২০৫০ সালের মধ্যে অন্তত এক ফুট বা তার কিছু বেশি উপরে উঠে আসবে পশ্চিম উপকূলে। পূর্ব উপকূলে তা উঠে আসবে দু’ফুট বা তারও বেশি। তার ফলে, রৌদ্রজ্জ্বল দিনেও ঘনঘন বানভাসি হবে আমেরিকার দু’টি উপকূলের বহু শহর। ঘনিয়ে আসতে পারে আরও বড় বিপদও। আনন্দবাজারের খবর
উষ্ণায়নের ফলে দু’টি সুবিশাল মহাসাগর লাগোয়া আমেরিকার ভবিষ্যতে কতটা কালো রঙের দিন ঘনিয়ে আসতে চলেছে তা জরিপ করতে গিয়ে সে দেশের ন্যাশনাল ওশ্নিক অ্যান্ড অ্যাটমস্ফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (নোয়া) মঙ্গলবার ১১১ পাতার একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। সেই রিপোর্টেই এই হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে।
বিশেষ করে আমেরিকার দুটি স্টেট লুইজিয়ানা ও টেক্সাসের বেশ কিছু এলাকার বিপদ সবচেয়ে বেশি। ওই দুটি স্টেটের লাগোয়া মহাসাগরের পানিস্তর এক ফুট বা তারও বেশি উপরে উঠে আসতে চলেছে আগামী ৩০ বছরে। আমেরিকার পূর্ব ও পশ্চিম উপকূলের বেশির ভাগ স্টেটের লাগোয়া মহাসাগরের পানিস্তর উঠে আসবে ১০ থেকে ১২ ইঞ্চি (বা ০.২৫ থেকে ০.৩ মিটার)।
বলা হয়েছে, বিশেষ করে আমেরিকার দুটি স্টেট লুইজিয়ানা ও টেক্সাসের বেশ কিছু এলাকার বিপদ সবচেয়ে বেশি। ওই দুটি স্টেটের লাগোয়া মহাসাগরের পানিস্তর এক ফুট বা তারও বেশি উপরে উঠে আসতে চলেছে আগামী ৩০ বছরে। আমেরিকার পূর্ব ও পশ্চিম উপকূলের বেশির ভাগ স্টেটের লাগোয়া মহাসাগরের পানিস্তর উঠে আসবে ১০ থেকে ১২ ইঞ্চি (বা ০.২৫ থেকে ০.৩ মিটার)।
উদ্বেগের কারণ, আমেরিকার পূর্ব উপকূলবর্তী আটলান্টিক মহাসাগরের জলস্তর গত ১০০ বছরে যতটা উপরে উঠে এসেছে দু’হাজার বছরেও তা ততটা উঠে আসেনি। আগামী মাত্র ৩০ বছরে সেই পানিস্তর যদি তার চেয়েও বেশি উঠে আসে তা হলে যে কী প্রভূত ক্ষয়ক্ষতি হবে আমেরিকার দুই উপকূলবর্তী স্টেট ও তার শহরগুলির তা সহজেই অনুমেয়।
উপকূলবর্তী প্রতিটি শহরই জনবহুল। আমেরিকার মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশই থাকেন তার দুই উপকূলবর্তী শহরগুলিতে, গ্রামাঞ্চলে। আমেরিকার অর্থনীতিরও একটি বড় অংশ নির্ভর করে এই উপকূলবর্তী শহরগুলির উপরেই।
তবে আন্টার্কটিকা ও গ্রিনল্যান্ডের পুরু বরফের চাঙর গলে যাওয়ার ফলে যে লাগোয়া মহাসাগরগুলির পানিস্তর আশঙ্কাজনক ভাবে উপরে উঠে আসতে শুরু করেছে গত কয়েক দশক ধরে তার ঢেউ আমেরিকার দুটি উপকূলের দুটি মহাসাগরে পৌঁছতে আরও ৮০ বছর সময় লাগবে বলে মনে করছেন নোয়া-র বিশেষজ্ঞরা।
নোয়া-র রিপোর্ট জানিয়েছে, ২০৬০ সালের মধ্যে টেক্সাস ও গ্যালভেস্টন লাগোয়া মহাসাগরের পানির স্তর ২৫ ইঞ্চি উপরে উঠে আসবে। সেন্ট পিটার্সবার্গ, ফ্লোরিডায় ২ ফুটের সামান্য কম। সিয়াট্লে ৯ ইঞ্চি, লস এঞ্জেলসে ১৪ ইঞ্চি।
বিজ্ঞানীদের গবেষণা বলছে, গেল কয়েক দশকে সারাবিশ্বে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা অন্তত ২৫ শতাংশ বেড়েছে শুধু গ্রিনল্যান্ড আর পৃথিবীর দক্ষিণ মেরুর বরফ অঞ্চল অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের হিমশৈল গলে।
আশঙ্কার বিষয় হলো, পৃথিবীর অন্য যে কোনো অঞ্চলের তুলনায় আর্কটিক অঞ্চলের তাপমাত্রা দ্রুত বাড়ছে। হিমশৈল মিশে আর্কটিক সাগরের পানির উচ্চতা বাড়াচ্ছে।
অথচ এ অঞ্চল বছরের অর্ধেক সময় বরফের অঞ্চল হয়ে থাকার কথা ছিল। বরফ গলায় অন্ধকারে থাকা বরফ বেরিয়ে আসছে, ধরে রাখছে সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মি।
গত বছর গ্রিনল্যান্ডের পূর্বাঞ্চলের তাপমাত্রা ছিলো ২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা উদ্বেগজনক। সাধারণত যে বরফ গলে, তার চেয়ে দ্বিগুণ বরফ গলছে। গ্রিনল্যান্ডে মূলত জুন থেকে সেপ্টেম্বরে বরফ গলে। কিন্তু ওই বছরে মাত্র ২ মাসে ১১ হাজার টন বরফ গলে সমুদ্রে মিশেছে।
এই অঞ্চলের আয়তন ১৭ লাখ স্কয়ার কিলোমিটার, যার প্রায় পুরোটাই শ্বেতশুভ্র বরফে ঢাকা। এ দ্বীপের মোট বাসিন্দা ৫৭ হাজার। গ্রিনল্যান্ড আর অ্যান্টার্কটিকায় পৃথিবীর বিশুদ্ধ পানির ৯৯ শতাংশ মজুদ আছে। ১৯৯৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত এই দুই অঞ্চল ৭ ট্রিলিয়ন টন বরফ হারিয়েছে।
২০১১ সাল থেকে ২০২০ সাল সময়ে গ্রিনল্যান্ডে ৩ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন টন বরফ গলেছে। বলা হচ্ছে, এই পরিমাণ বরফগলা পানি গোটা নিউ ইয়র্ক শহরকে ১৪ হাজার ৭০০ ফুট তলায় ডুবিয়ে দেবে!
গ্রিনল্যান্ডের বরফ নিয়ে গবেষণার কাজ শুরু হয়েছিল ২০১৯ সালে। ড্যানিশ রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সঙ্গে কাজ করতে থাকা পোলার পোর্টাল জানিয়েছে, ২০২২ সাল পর্যন্ত ৪৭ বিলিয়ন টন গলেছে গ্রিনল্যান্ডের। এর মানে ৪৭০০ কিউবিক কিলোমিটার পানি।
এই পানি গোটা আমেরিকাকে দুই ফুট নিচে ডুবিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। অথবা পৃথিবীর সমুদ্রগুলোতে ১ দশমিক ২ সেন্টিমিটার বেড়ে যেতে পারে পানিস্তর।
বিশ্লেষকরা বলছেন, উন্নত দেশগুলো অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে যেভাবে প্রকৃতির সঙ্গে যথেচ্ছাচার করেছে, তাতে প্রকৃতি রুষ্ট হয়ে উঠেছে। কারণ, প্রকৃতি একটি জীবন্ত সত্তা, তাকে শুধু সম্পদ লাভের ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। অথচ এ বিষয়টিকে আমলে না নিয়ে উন্নত দেশগুলো নিজেদের তথাকথিত উন্নয়নের স্বার্থে জলবায়ু তহবিল, কার্বন ট্রেড প্রভৃতি তৈরি করে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে টোপ দিয়ে যাচ্ছে।
তারা বলেন, জলবায়ু সম্মেলনগুলোর মূল সুরে সমস্যা সমাধানের কোনো ব্যাপার থাকে না। কারণ, এর মধ্য দিয়ে কার্বন নিঃসরণ কমানোর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। কিন্তু এমন একটা ভাব করা হয় যে সমস্যাটি আমলে নেওয়া হয়েছে। কথা হচ্ছে, দুনিয়ার উন্নয়নের মডেল যেন প্রকৃতির ওপর আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা না করে প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়, সেটাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত।
তারা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যাটি যেমন পরিবেশগত, তেমনি একই সঙ্গে তা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকও বটে। উন্নত দেশগুলোর কারণেই এই জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে, ফলে তাদের কার্বন উদ্গিরণ হ্রাসে বাধ্য করতে হবে। তার জন্য প্রয়োজন সদিচ্ছা, কার্যকর কূটনীতি ও রাজনীতি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৩২
আপনার মতামত জানানঃ