অস্ট্রেলিয়ায় রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীদের আশ্রয় পাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম৷ দেশটির নিজস্ব উপকূলে পৌঁছার অনেক আগেই শরণার্থীদের নৌকা আটকে ফেলা হচ্ছে৷ তাদের আশ্রয়ের আবেদন প্রত্যাখ্যান করা সহ দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে৷
এদিকে দেশে আগত শরণার্থী-আশ্রয়প্রার্থীদের গড়ে দুই বছর ধরে আটকে রাখার রেকর্ড গড়েছে অস্ট্রেলিয়া। দেশটির এমন ইমিগ্রেশন ডিটেনশন (অভিবাসন হেফাজত) নীতির নিন্দা জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। সংস্থাটির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, অস্ট্রেলিয়ায় বর্তমানে শরণার্থীদের গড়ে ৬৮৯ দিন আটকে রাখা হয়! খবর বিবিসি
গবেষক ও শরণার্থী আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অভিবাসীদের আটক শাস্তি হিসেবে না দেখে বৈধ লক্ষ্য অর্জনের জন্য ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা নেয়া উচিত। বিষয়গুলো স্বেচ্ছাচারী এবং বেআইনি।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, দেশটির সেপ্টেম্বরে একটি সরকারি প্রতিবেদনে অভিবাসীদের ৬৮৯ দিন আটকে রাখার বিষয়টি উঠে আসে। যা কিনা নতুন একটি রেকর্ড ও পশ্চিমা দেশের দ্বারা এখন পর্যন্ত বেশি সময়কাল যাবৎ অভিবাসী আটকে রাখে বলে মনে করা হচ্ছে।
জানা যায়, বর্তমানে এক হাজার ৪৫৯ জনকে আটক করা হয়েছে, তাদের কতদিন আটকে রাখা হবে তার কোনও সময় উল্লেখ করা হয়নি। অস্ট্রেলিয়া মূলত ট্রলার-নৌকায় আসা অভিবাসীদের বাধ্যতামূলক আটকে রাখে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, অস্ট্রেলিয়া কমপক্ষে পাঁচ বছর ধরে ১১৭ জনকে আটক করেছে, যার মধ্যে আটজন লোক যারা ১২ বছরের বেশি সময় বন্দি অবস্থায় কাটিয়েছে।
পুরুষদের টেনিসে বিশ্বের এক নম্বর খেলোয়াড় সার্বিয়ান সুপারস্টার নোভাক জোকোভিচকে অস্ট্রেলিয়ার হোটেলে বন্দী রাখার এক মাস পরে এই তথ্যগুলো তুলে ধরল হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।
সংস্থাটির মতে, অভিবাসীদের আটকে রাখার এই নীতি অত্যন্ত নিষ্ঠুর ও নিপীড়নমূলক। জোকোভিচ যে হোটেলে ছিলেন, সেখানে এখনো ৩২ জন শরণার্থী ও রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী আটক আছেন বলে জানিয়েছেন মানবাধিকারকর্মীরা।
করোনাভাইরাসের টিকা না নেওয়ায় জোকোভিচের অস্ট্রেলিয়ার ভিসা নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি হয়। পাঁচ দিন মেলবোর্নের ওই হোটেলে আটক ছিলেন তিনি। সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে জোকোভিচ জানিয়েছেন, আরও কয়েকটি গ্র্যান্ড স্লাম বাদ গেলেও জোর করে কোভিড ভ্যাকসিন নেবেন না তিনি।
জোকোভিচের সাথে একই ভবনে আটক ছিলেন ২৪ বছর বয়সী ইরানি শরণার্থী মেহদি আলি। দুই বছর ধরে হোটেলে আটক থাকার পরেও তার মুক্তির কোনো নির্দেশনা আসেনি।
মাত্র ১৫ বছর বয়সে অস্ট্রেলিয়ায় পালিয়ে আসা মেহদি বলেন, ‘এই ভবনের বাসিন্দারা স্বাধীনতা চায়, মুক্তি চায়’।
কিন্তু মেহদি নিজেই নয় বছর যাবত কর্তৃপক্ষের নিয়মের বেড়াজালে বন্দি। হোটেলের ভেতরে থাকা তার জন্যে একটি দুঃস্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বছরের পর বছর আটক থাকতে থাকতে ভবনের বাসিন্দাদের মধ্যে আত্মঘাতী মনোভাব প্রবল হয়ে উঠেছে বলেও জানান তিনি।
দেশটির সেপ্টেম্বরে একটি সরকারি প্রতিবেদনে অভিবাসীদের ৬৮৯ দিন আটকে রাখার বিষয়টি উঠে আসে। যা কিনা নতুন একটি রেকর্ড ও পশ্চিমা দেশের দ্বারা এখন পর্যন্ত বেশি সময়কাল যাবৎ অভিবাসী আটকে রাখে বলে মনে করা হচ্ছে।
সরকারি তথ্য ঘেঁটে এইচআরডব্লিউ জানিয়েছে, অস্ট্রেলিয়ায় সাম্প্রতিক সময়ে শরণার্থী ও আশ্রয় প্রার্থীদের বন্দি রাখার সময়সীমা আশঙ্কাজনক ভাবে বাড়ছে। এর আগে কখনো এমনটা ঘটার রেকর্ড অস্ট্রেলিয়াতে নেই। পশ্চিমা বিশ্বের বেলাতেও যেটা বিরল ঘটনা।
অন্যান্য দেশ অবস্থা বিবেচনায় আশ্রয় প্রত্যাশীদের মুক্তভাবে চলাচলে সুযোগ দেয়। তবে অস্ট্রেলিয়া সরকার নৌকায় করে সে দেশে পৌঁছানো মানুষদের বাধ্যতামূলকভাবে ডিটেনশন সেন্টারে রাখে। কোনো রকম নিরাপত্তা ব্যবস্থা করা ছাড়াই একই নিয়মে এ পর্যন্ত সাড়ে চৌদ্দশ’র বেশি মানুষকে আটকে রাখা হয়েছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের হিসেবে অস্ট্রেলিয়া কর্তৃপক্ষ অন্তত ১১৭ জন আশ্রয় প্রত্যাশীকে পাঁচ বছর ধরে আটকে রেখেছে। যাদের আট জন আবার এক দশকের বেশি সময় ধরে বন্দিশালায় আছেন। গবেষক সোফি ম্যাকনেইল বলেন, ‘আন্তর্জাতিক আইনে শরণার্থী কিংবা আশ্রয় প্রার্থীদের আটকে রাখার বিধানকে শান্তি হিসেবে ব্যবহার করার কোনো নিয়ম নেই। কিন্তু অস্ট্রেলিয়া বছরের পর বছর তেমনটাই করছে।’
এ প্রসঙ্গে গবেষক সোফি ম্যাকনিল বিবিসিকে বলেন, ‘এসব পরিসংখ্যান দেখেই বোঝা যায় অভিবাসী ও শরণার্থীদের ক্ষেত্রে সমমনা দেশগুলোর চাইতে অস্ট্রেলিয়ার নীতি কতটা আলাদা। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, ইমিগ্রেশন ডিটেনশন কোনো শাস্তি হিসেবে নয়, বরং একটি বৈধ লক্ষ্য অর্জনের জন্য শেষ পন্থা হিসেবে দেখা উচিত’।
২০১৩ সাল থেকেই সমুদ্র উপকূল দিয়ে দেশে আগত সব শরণার্থীকে আটকে রাখার নিয়ম করেছে অস্ট্রেলিয়া সরকার। বৈধ শরণার্থী হোক বা অবৈধ, কাউকেই তারা দেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ দেবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ার দাবি, মানুষকে অস্ট্রেলিয়ায় আশ্রয় খুঁজতে নিরুৎসাহিত করার জন্যই এমন কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। উপকূলে অভিবাসী নৌকা আটক করায় সমুদ্রে ডুবে মারা যাওয়ার হারও কমেছে।
কিন্তু চিকিৎসকরা বলছেন, অনির্দিষ্টকালের জন্য শরণার্থীদের হোটেলে আটকে রাখার মাধ্যমে তাদের ‘মানসিক নির্যাতন’ করা হচ্ছে। গত এক দশকে ডিটেনশন ক্যাম্পগুলোতে আধডজন ব্যক্তি আত্মহত্যা করার চেষ্টাও করেছেন। তবে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে দাবি করেছেন, তাদের অনেককে লাখ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণও দিয়েছে সরকার।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২১০৪
আপনার মতামত জানানঃ