বাংলাদেশের সড়কগুলোতে মৃত্যুর মিছিল অব্যাহত রয়েছে। ৪ ডিসেম্বর ২০২০, শুক্রবার ছুটির দিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়কে ২১ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে মানিকগঞ্জের দৌলতপুরে সিএনজি ও বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে একই পরিবারের ৬ জনসহ ৭ জন, টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে ৬ জন নিহত হয়। এছাড়া মাগুরায় ৩ জন, গাজীপুরের কালীগঞ্জে ২ জন, ভোলা, বগুড়া ও যশোরে ১ জন করে নিহত হয়েছেন।
একদিনে সড়কে এত মানুষের মৃত্যু দেশবাসীর জন্য বড় এক আঘাত। তবে নিয়ম করে প্রতিদিনই সড়কে ঝরছে তাজা প্রাণ। যদিও এসব মৃত্যুকে দুর্ঘটনা হিসেবে দেখা হয়; কিন্তু প্রতিদিন যে এমন কিছু ঘটন ঘটবে, এটাও নিশ্চিত করে বলা যায় বিধায় অনেক বিশ্লেষক একে দুর্ঘটনা আখ্যা দিতে রাজী নন। তারা মনে করেন সড়কে অব্যবস্থাপনা ও যথাযথ তদারকি না থাকাই এত মানুষের মৃত্যুর কারণ। এগুলো এক ধরনের ‘সিস্টেমেটিক কিলিং’।
‘সড়কে এই যে প্রতিদিন নিয়ম করে মৃত্যুর মিছিল, এর দায় কার? নৌমন্ত্রী শাজাহান খান যে গরু-ছাগল চিনলেই ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়ার আর্জি জানিয়েছিলেন, তার কি কোনো দায় আছে? সরকারের রক্ষক পুলিশ বাহিনী যে সারাদিন ঘুষের বিনিময়ে অসংখ্য সড়ক আইন ভঙ্গকারীদের ছেড়ে দেয়, তাদের কি কোনো দায় আছে? সরকার যে এখন পর্যন্ত লেন মেনে গাড়ি চালানোর ব্যবস্থা করতে পারল না, উল্টো মন্ত্রী-এমপিরা সড়ক আইনভঙ্গের দায়ে অভিযুক্ত, তাদের কি কোনো দায় নেই? সড়কে যে প্রচুর বাতিল যানবাহন সদর্পে চলছে, বিআরটিএ যে তা থামাতে পারছে না, সেই দায় কি তারা নেবে? বাস মালিকরা যে বাতিল বাস নামাচ্ছে, তাদের কি কিছু দায় আছে? নাকি সব দায় কেবল গরিব ড্রাইভারকে দিয়েই পার পাওয়া যাবে!’ এমন প্রশ্ন উঠেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও।
মানিকগঞ্জ: মানিকগঞ্জের দৌলতপুরে সিএনজি ও বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে একই পরিবারের ৬ জনসহ ৭ জন নিহত হয়েছেন। শুক্রবার বেলা আড়াইটার দিকে ঘিওর-দৌলতপুর আঞ্চলিক সড়কের মূলকান্দি এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহতরা হলেন- টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর থানার চাষাভাদ্রা গ্রামের বাদ্যকরপাড়া গ্রামের গোবিন্দ বাদ্যকর (৩২), তার মেয়ে রাঁধে বাদ্যকর (৪), স্ত্রী ববিতা বাদ্যকর (২৫), বাবা হরে কৃষ্ণ (৫৫), চাচি খুশি বালা (৫০) ও চাচাতো ভাই রামপ্রসাদ বাদ্যকর (৩২)। আরেকজন হলেন দৌলতপুর উপজেলার সমেতপুর গ্রামের সিএনজিচালক জামাল (৩২)। নিহতের স্বজনদের উদ্ধৃতি দিয়ে পুলিশ জানায়, টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর উপজেলার চাষাভাদ্রা গ্রামের বাদ্যকরপাড়ার গোবিন্দ বাদ্যকর তার অসুস্থ মেয়ে রাঁধে বাদ্যকরকে নিয়ে মানিকগঞ্জে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে দৌলতপুর মূলকান্দি এলাকায় তাদের বহনকারী সিএনজিটি পৌঁছলে বিপরীত দিক থেকে আসা ভিলেজ লাইনের একটি যাত্রীবাহী বাস ও সিএনজির মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে সিএনজিতে থাকা পরিবারের সবাই নিহত হন। দৌলতপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দায়িত্বরত ডাক্তার নাফমুন রইস জানান, হাসপাতালে আনার আগেই সবাই মারা গেছেন। দৌলতপুর থানার ওসি রেজাউল করীম জানান, দুর্ঘটনাকবলিত ভিলেজ লাইনের বাসটি আটক করা হলেও চালক ও সহকারী পলাতক রয়েছেন।
মির্জাপুর (টাঙ্গাইল): টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় ৬ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অন্তত ১০ জন। শুক্রবার সকালে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে উপজেলার ইচাইল এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। হতাহতদের মধ্যে বাসের যাত্রী ও পথচারী রয়েছে। বিষয়টি মির্জাপুর গোড়াই হাইওয়ে থানার ওসি মোজাফর হোসেন নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, রংপুর থেকে ছেড়ে আসা সেবা ক্লাসিক পরিবহনের একটি বাস ইচাইল এলাকায় বিকল হয়ে পড়ে। পরে মেরামতের জন্য বাসটি রাস্তার পাশে দাঁড় করানো হয়। সকাল ৭টার দিকে ঢাকাগামী সবজিভর্তি ট্রাক বাসটিকে ধাক্কা দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই চারজন নিহত হন। পরে হাসপাতালে নেয়ার পথে আরও দুজন মারা যায়। দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন বেশ কয়েকজন। খবর পেয়ে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে পৌঁছে আহতদের উদ্ধার করে মির্জাপুর কুমুদিনী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে।
মাগুরা: মাগুরায় ট্রাক উল্টে চাপা পড়ে প্রাণ ২ নারীর মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া পৃথক আরেকটি দুর্ঘটনায় আরেকজনের মৃত্যু হয়েছে। শুক্রবার জেলার পৃথক স্থানে এ দুর্ঘটনাগুলো ঘটে। নিহতরা হলেন- স্বর্ণলতা মজুমদার (২৫), সাথী মজুমদার (৩৫) এবং আহাদ আলি মোল্যা (৬০)। পুলিশ জানায়, শালিখার থৈপাড়া গ্রামের মিল্টন বিশ্বাসের স্ত্রী স্বর্ণলতা তার ভাইয়ের স্ত্রী সাথী মজুমদারকে নিয়ে একটি অটোরিকশায় মাগুরার রামনগর এলাকায় এক নিকটাত্মীয়ের বাড়িতে যাচ্ছিলেন। বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে তারা মাগুরা-ফরিদপুর সড়কের ঠাকুরবাড়ি এলাকায় পৌঁছে অটোরিকশা থেকে নেমে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এ সময় ঢাকাগামী সবজিবোঝাই একটি ট্রাক অন্য একটি অটোরিকশাকে সাইড দিতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পড়ে যায়। এতে ট্রাকের নিচে চাপা পড়েন স্বর্ণলতা, সাথী এবং একই পরিবারের সেতু এবং অপর্ণা। এদিকে আহাদ আলি মোল্যা (৬০) নামে এক পল্লী চিকিৎসক সকালে মহম্মদপুর উপজেলার রাজাপুর এলাকায় নছিমনের ধাক্কায় গুরুতর আহত হন। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে মাগুরা ২৫০ শয্যা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে সন্ধ্যায় তার মৃত্যু হয়েছে।
কালীগঞ্জ (গাজীপুর): গাজীপুরের কালীগঞ্জে গাড়ি চাপায় নুরুল ইসলাম (৪৩) ও মোকারম (৩৫) নামের দুইজন নিহত হওয়ার সংবাদ পাওয়া গেছে। ঘটনাটি ঘটেছে বৃহস্পতিবার রাতে টঙ্গী-ঘোড়াশাল মহাসড়কের কালীগঞ্জ উপজেলার বাগারপাড়া নামকস্থানে। নিহত নুরুল ইসলাম কালীগঞ্জ পৌরসভার মুনসুরপুর গ্রামের মৃত তরব আলী খন্দকারের ছেলে। সে পেশায় অটোচালক এবং নিহত মোকারম একই উপজেলার মোক্তারপুর ইউনিয়নের সাওরাইদ গ্রামের মোস্তফার ছেলে। পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শী জানান, সন্ধ্যা রাতে ঘোড়াশালগামী অটোটি কালীগঞ্জ বাইপাস সড়কের বাঘারপাড়া এলাকায় পৌছলে বিপরীত দিক থেকে আসা বেপরোয়া একটি গাড়ি অটো উপরে উঠিয়ে দেয় এতে করে অটোচালকসহ যাত্রী ঘটনাস্থলেই নিহত হন। এদিকে তাদের চাপা দিয়ে গাড়িটি পালিয়ে যায়। কালীগঞ্জ থানার ওসি একে এম মিজানুল হক বলেন, খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠানো হয়েছে। নিহতদের পরিবারের কোনো আপত্তি না থাকায় ময়নাতদন্ত ছাড়া তাদের পরিবারের নিকট লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে।
ভোলা: ভোলায় মালবাহী ট্রলির ধাক্কায় নিজাম উদ্দিন মিরণ (৪২) নামের এক মোটরসাইকেল আরোহী মৃত্যু হয়েছে। নিহত নিজাম উদ্দিন মিরণ ভোলা সদর উপজেলার ধনিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা। শুক্রবার দুপুরে ভোলা-চরফ্যাশন আঞ্চলিক মহাসড়কের বাংলাবাজার এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। বাংলাবাজার পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ গোলাম মোস্তফা বলেন, দুপুরের দিকে ৩ জন আরোহী নিয়ে মোটরসাইকেলে করে ভোলা শহরের দিকে আসছিল। এ সময় বিপরীত দিক থেকে আসা অপর একটি মালবাহী ট্রলির সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে ঘটনাস্থলেই নিজাম উদ্দিন মিরন নামের এক মোটরসাইকেল আরোহী নিহত হয়।
বগুড়া: বগুড়ার নন্দীগ্রামে খেলতে গিয়ে ধান বোঝাই অটো ভ্যানের চাপায় জাহিদ হোসেন নামে চার বছরের এক শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। শুক্রবার বিকালে উপজেলার বেলঘড়িয়া গ্রামে এ হৃদয় বিদারক ঘটনা ঘটে। শিশুটির মৃত্যুতে শুধু তার পরিবারে নয়, পুরো গ্রামে শোকের ছায়া নেমে আসে। স্বজনরা জানান, শিশু জাহিদ হোসেন নন্দীগ্রাম উপজেলার বেলঘড়িয়া গ্রামের ফারুক হোসেনের ছেলে। শিশুটি শুক্রবার বিকালে খেলার জন্য বাড়ি থেকে বের হয়। বাড়ির পাশে রাস্তায় অন্য শিশুদের সঙ্গে খেলা করছিল। এ সময় ধানবোঝাই ব্যাটারিচালিত একটি অটোভ্যান তাকে চাপা দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই জাহিদের মৃত্যু হয়। চালক ভ্যান রেখে পালিয়ে যান।
যশোর: যশোরে অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়ে ট্রেনের ধাক্কায় মোটরসাইকেল আরোহী এক ব্যবসায়ী নিহত হয়েছেন। শুক্রবার সকালে শহরের খোলাডাঙ্গা এলাকায় এই দুর্ঘটনা ঘটে। নিহত আবদুর রহমান (৪৫) সদর উপজেলার মন্ডলগাতি গ্রামের বাসিন্দা। তিনি শহরের ভোলাট্যাংক রোডে টাইলসের দোকান এসএ ট্রেডার্সের মালিক। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে আব্দুর রহমান মোটর সাইকেল নিয়ে খড়কি ধোপাপাড়া রেলক্রসিং পার হওয়ার সময় রেললাইনের ফাঁকে চাকা আটকে যায়। এসময় মোটরসাইকেলের ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়। তিনি মোটরসাইকেলের চাকা ছাড়ানোর চেষ্টা করছিলেন। এর মধ্যে ট্রেন চলে আসে। ট্রেনের চাপায় গুরুত্বর আহত হন। তাকে যশোর জেনারেল হাসাপাতালে ভর্তি করা হয়। এই হাসপাতালের চিকিৎসক সৌরভ হোসেন জানান, ট্রেনের ধাক্কায় আহত আবদুর রহমানের মাথায় হেলমেট থাকলেও তিন স্থানে গভীর ক্ষত হয়। এছাড়া হাত-পাসহ শরীরের অন্যান্য স্থানের আঘাতও ছিল গুরুতর। চিকিৎসাধীন অবস্থায় বেলা ১১টা ৫০ মিনিটে তিনি মারা যান।
এসডাব্লিউ/মিই/আরা/১২১০
আপনার মতামত জানানঃ