
আফগানিস্তানের মাদক রিহ্যাব কেন্দ্রে আটকে রাখা হয়েছে শত শত মাদকাসক্তকে। চিকিৎসার জন্য তাদেরকে রিহ্যাব কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হলেও তারা এখন আফিম কিংবা হেরোইনের বদলে খাচ্ছে বিড়াল ও মানুষের মাংস। সম্প্রতি আফগানিস্তানের রিহ্যাব কেন্দ্র পরিদর্শন করে আসা ডেনমার্কের এক সাংবাদিক এমনটিই দাবি করেছেন।
৬ মাস হয়ে গেল আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করেছে তালিবান। ক্ষমতার দখল নিয়েই তারা জানিয়েছিল, দেশকে ড্রাগ বা মাদক মুক্ত করা হবে। সেই কথা রাখতে অভিনব পন্থা নিয়েছে তারা। দেশের অধিকাংশ মাদকাসক্তকে তিন মাসের জন্য একটি রিহ্যাবে ভরেছে তারা। রিপোর্ট বলছে, সেই নেশামুক্তি কেন্দ্র বা রিহ্যাবে চূড়ান্ত অব্যবস্থা। এক-একটি খাটে রয়েছেন তিন জন করে। রিহ্যাববাসীর জন্য খাবারের উপযুক্ত ব্যবস্থা নেই।
ডেইলি মেল-এর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত মাসে ডেনমার্কের ওই সাংবাদিক রিহ্যাব কেন্দ্র থেকে মুক্তি পাওয়া এক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেন। ওই ব্যক্তি দাবি করেছেন, তালিবান পরিচালিত ওই রিহ্যাব সেন্টারের ভিতরের পরিবেশ ভয়ঙ্কর।
ঠিক মতো খেতে দেওয়া হয় না রোগীদের। বেশির ভাগ দিনই তাদের অভুক্ত অবস্থায় থাকতে হয়। রোগীদের স্বাস্থ্যের কোনও খেয়াল রাখা হয় না। খাবার, ঠিক মতো চিকিৎসা না পেয়ে অনেকের মৃত্যু হচ্ছে।
আব্দুল নামের ওই রোগীর দাবি, রিহ্যাব কেন্দ্রের পরিস্থিতি দিন দিন আরও খারাপ হচ্ছে। খাবার না পেয়ে ক্রমশ হিংস্র হয়ে উঠছেন রোগীরা।
আব্দুলের দাবি, সম্প্রতি এক ব্যক্তিকে খুন করে তার মাংস খেয়েছেন কয়েক জন। এমনকি ওই কেন্দ্রের ভিতরে থাকা একটি পার্কে একটি বিড়ালকে ধরে তার কাঁচা মাংস পর্যন্ত নাকি খেয়েছেন রোগীরা।
বিশ্বে নিষিদ্ধ মাদকের অন্যতম বড় জোগানদাতা আফগানিস্তান। হিন্দুকুশের পাহাড় থেকে হেরোইনের ব্যবসার রাশ ধরেছে তালিবান। আর সেই বিষ ছড়িয়ে পড়ছে গোটা দুনিয়ায়।
‘ইউরোপিয়ান ফাউন্ডেশন ফর সাউথ এশিয়ান স্টাডিস’রিপোর্টে বলা হয়েছে, ক্ষমতায় এসে আফিম চাষে লাগাম টানার কথা ঘোষণা করেছিল তালিবানের মুখপাত্র জাবিউল্লা মুজাহিদ। কিন্তু সেসব আন্তর্জাতিক ত্রাণ পাওয়ার জন্য শুধুমাত্র লোক দেখানো প্রতিশ্রুতি ছিল। আফগানিস্তানে তৈরি হওয়া আফিম থেকে পাকিস্তানে ল্যাবরেটরিতে বিশাল পরিমাণের হেরোইন তৈরি হচ্ছে এবং তা ইউরোপার বাজারে পৌঁছে যাচ্ছে। দেশেও সস্তা হচ্ছে মাদক। যার জেরে মাদকাসক্তের সংখ্যা বাড়ছে আফগানিস্তানেও।
সম্প্রতি এক ব্যক্তিকে খুন করে তার মাংস খেয়েছেন কয়েক জন। এমনকি ওই কেন্দ্রের ভিতরে থাকা একটি পার্কে একটি বিড়ালকে ধরে তার কাঁচা মাংস পর্যন্ত নাকি খেয়েছেন রোগীরা।
কাবুলে ইউনাইটেড নেশন অব ড্রাগস অ্যান্ড ক্রাইম (ইউএনওডিসি)-র প্রধান সিজার গুডস জানিয়েছেন, আফিমের উৎপাদন আরও বাড়িয়েছে তালিবান। ফলে মাদকের দাম আরও কমেছে, সহজলভ্য হচ্ছে মাদক। আরও বেশি সংখ্যক মানুষ মাদকাসক্ত হচ্ছেন।
দীর্ঘকাল ধরেই আফগানিস্তান বিশ্বের বৃহত্তম অবৈধ আফিম এবং হেরোইন সরবরাহকারী দেশ হিসেবে পরিচিত। ২০১৭ সালে বিশ্বের মোট সরবরাহের ৮০ শতাংশেরও বেশি আফিম উৎপাদন করেছিল দেশটি। জাতিসংঘের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ওই বছর ১.৪ বিলিয়ন ডলারের আফিম এবং হেরোইন উৎপাদন করেছিল আফগানিস্তান।
আফিম উৎপাদন ও বিদেশে রপ্তানিই মূলত তালিবানের আয়ের প্রধান উৎস। জাতিসংঘের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ২০১৮ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে মাদকব্যবসা থেকে তালিবান আনুমানিক ৪০০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি আয় করেছে।
২০২১ সালের মে মাসের এক প্রতিবেদনে একজন মার্কিন কর্মকর্তার উদ্ধৃতি উল্লেখ করে দাবি করা হয়েছে, তালিবান তাদের বার্ষিক আয়ের আনুমানিক ৬০ শতাংশ পর্যন্ত অবৈধ মাদকদ্রব্যের মাধ্যমেই অর্জন করে থাকে।
গেল বছরের শেষার্ধে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন বাহিনী প্রত্যাহারের পর কাবুলের ক্ষমতা দখল করে নেয় তালিবান। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত দেশটিতে প্রায় সব ধরনের আন্তর্জাতিক সহায়তা প্রত্যাহার করা হয়েছে। এ কারণে আফগানের অর্থনীতি এখন চরম সংকটের মুখে। বিশ্লেষকরা বলছেন, শীঘ্রই এই পরিস্থিতি পরিবর্তনের তেমন সম্ভাবনা নেই।
জাতিসংঘ সংস্থার মতে, গত চার বছরে আফগানিস্তানে সর্বোচ্চ পরিমাণ আফিম উৎপাদন হয়েছে। এমনকি করোনাভাইরাস মহামারিতেও গত বছর উৎপাদন বেড়েছে ৩৭ শতাংশ।
আফগানিস্তানে অবৈধ মাদক ব্যবসা নিয়ে গবেষণা করা ডেভিড ম্যান্সফিল্ডের মতে, এসব মাদকের কিছু চালান কঠোর নিরাপত্তা থাকা সীমান্ত দিয়ে ইরানের পাচারকারীদের কাছে পাঠানো হয়।
ম্যান্সফিল্ডের মতে, অবৈধ আফিম থেকে তালিবানের বার্ষিক আয় সর্বোচ্চ ৪০ মিলিয়ন ডলার হতে পারে। এই অর্থ আসে মূলত আফিম উৎপাদন, হেরোইন ল্যাব ও মাদক পাচারের চালান থেকে লেভি সংগ্রহের মাধ্যমে। কিন্তু বৈধ আমদানি ও রফতানি থেকে ফি নিয়ে মাদকের চেয়ে বেশি অর্থ সংগ্রহ করে তালিবান যোদ্ধারা।
আফগানিস্তান এমনিতে বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বড় আফিম রপ্তানিকারক দেশ। আফিম থেকে হেরোইনের মতো মাদক তৈরি করা হয়। তবে তারা যে কেবল আফিমই উৎপাদন করে তা নয়, এবার আরেক ভয়ঙ্কর মাদক মেথাম্ফেটামিনের উৎপাদনও বাড়ছে যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশটিতে। আফগানিস্তানের কিছু অংশে মেথাম্ফেটামিনের উৎপাদন এরই মধ্যে আফিমকেও ছাড়িয়ে গেছে। বিশেষজ্ঞদের দাবি, অবৈধ মাদক ব্যবসা বাড়তে থাকলেও সেদিকে নজর দেয়া হয়নি। এখন যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহারের পর সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের উদ্বেগ বাড়তে শুরু করেছে। তাদের আশঙ্কা, আফগানদের মেথাম্ফেটামিনের সারা ইউরোপে ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৪৫
আপনার মতামত জানানঃ