আফগানিস্তানে ১৫ বছর ধরে ৮০০ কোটি ডলারের বেশি অর্থ ব্যয় করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এর লক্ষ্য ছিল আফগানিস্তানের আফিম, হেরোইন ব্যবসা থেকে তালিবানের মুনাফা অর্জন বন্ধ করা। এই অভিযানে পপি চাষ নির্মূল থেকে শুরু করে সন্দেহভাজন ল্যাবে বিমান হামলাও চালিয়েছে মার্কিন বাহিনী। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই কৌশল ব্যর্থ হয়েছে। এখনো গোটা বিশ্বে আফিমজাত মাদকের সবচেয়ে বড় সরবরাহকারী তালিবানরাই। আফগানিস্তানে তাদের ক্ষমতা দখলের ধারাবাহিকতায় পৃথিবীজুড়েই মাদক সমস্যা আরো মারাত্মক আকার নিতে পারে বলে আশঙ্কা করছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম।
ইউরোপীয় ফাউন্ডেশন ফর সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের গবেষণা প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, আফগানিস্তানে মাদক ব্যবসার প্রসার কাবুলে তালিবান শাসনকে শক্তিশালী করেছে এবং পশ্চিমা রাজনৈতিক স্বার্থকে দুর্বল করছে।
এতে আরও বলা হয়েছে, আফগানিস্তানের বর্তমান যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে— তালিবান আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বৃহত্তর পরিসর থেকে স্বীকৃতি পাক বা না পাক— তা দেশটির ত্রুটিযুক্ত অর্থনীতির চিরস্থায়ী সমস্যার বহুমুখী পরিণতির দিকেই নির্দেশ করছে।
বরাবরই মাদক ব্যবসায় সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে তালিবান। গবেষণায় আশঙ্কা প্রকাশ করে বলা হয়েছে, যদি তালিবানরা যথাযোগ্য স্বীকৃতি না পায়, তাহলে মাদক ব্যবসার প্রসার অব্যাহত থাকতে পারে এবং সম্ভবত তালিবানদের হয়ে কাজ করার জন্য একটি অভ্যন্তরীণ নেটওয়ার্ক গড়ে উঠতে পারে। মাদক ব্যবসায় মুনাফার পরিমাণও বাড়তে পারে।
তাছাড়া, অবৈধ মাদক ব্যবসার প্রসারের সাথে সাথে তালিবানের লক্ষ্য ও আদর্শ আফগানিস্তানের বাইরেও ছড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ তৈরি করতে পারে। এতে মাদক ব্যবসা শুধু তালিবানের রাজস্ব আয়েরই উৎস হিসেবে সীমাবদ্ধ থাকবে না, এর নানা প্রভাব আফগানিস্তানের বাইরেও দেখা যাবে।
বিগত কয়েক দশক ধরে, একসময়ের বিদ্রোহী, তারপর ক্ষমতাচ্যুত এবং বর্তমানে ক্ষমতায় ফেরা জাতিসংঘের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী গোষ্ঠী তালিবানের প্রভাবশালী প্রকৃতি বিশ্ব প্রত্যক্ষ করেছে। ইউরোপিয়ান ফাউন্ডেশন ফর সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের প্রতিবেদন অনুসারে, এই প্রভাব কতটা স্পষ্ট তা বারবার দৃশ্যমান হয়েছে।
অবৈধ মাদক ব্যবসার প্রসারের সাথে সাথে তালিবানের লক্ষ্য ও আদর্শ আফগানিস্তানের বাইরেও ছড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ তৈরি করতে পারে। এতে মাদক ব্যবসা শুধু তালিবানের রাজস্ব আয়েরই উৎস হিসেবে সীমাবদ্ধ থাকবে না, এর নানা প্রভাব আফগানিস্তানের বাইরেও দেখা যাবে।
আফগনিস্তান বিশ্বের সবচেয়ে বড় আফিম উৎপাদনকারী দেশ। হেরোইন তৈরিতে এই আফিম প্রধান উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের তথ্যমতে, যুক্তরাজ্যে যে পরিমাণ হেরোইন যায়, এর ৯৫ শতাংশই আফগানিস্তান থেকে যায়। ।
আফগানিস্তানে আফিমের চাষ অপরাধ হিসেবে বিবেচিত। তারপরও দরিদ্র কৃষকরা অর্থের জন্যে এই পপি চাষে উৎসাহিত হন।
জাতিসংঘের তথ্যমতে, গত ২০ বছরে দেশটির আফিম উৎপাদন ব্যাপক বেড়েছে। দেশটির ৩৪টি প্রদেশের ১২টি ছাড়া সব কটিতে আফিম চাষ হয়। পপি চাষ বন্ধ করার জন্য চাষীদের নানা ধরনের বিকল্প পণ্য যেমন আনার ও জাফরান চাষের জন্য উৎসাহিত করার চেষ্টা হয়েছে, কিন্তু তার পরও এই অবস্থা।
পপি চাষে আফগানিস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম কেন্দ্র কান্দাহার প্রদেশ। হেলমান্দের পর এর অবস্থান। কান্দাহারের ২ একর জমিতে পপি বুনেছিলেন ৩৫ বছর বয়সী কৃষক মোহাম্মদ নাদির। রয়টার্সকে তিনি বলেন, গম বা অন্যান্য ফসল চাষ করলে তাদের যথেষ্ট লাভ হয় না। তার ক্ষেতে চাষ করা পপি থেকে আয় হবে ৩ হাজার ডলার। অথচ ওই একই জমিতে যদি তিনি গম চাষ করতেন তাহলে তার আয় হতো ১ হাজার ডলার কম। যদিও পপি চাষ করে পাওয়া টাকা তিনি একাই নিতে পারবেন না। জমি রক্ষা করার জন্য তালিবান ও মাদক বিক্রির জন্য দেশি ও আন্তর্জাতিক চোরাকারবারীদেরকে ভাগ দিতে হবে।
কাবুলের পতনের পর গোটা আফগান অর্থনীতিতে চরম মাত্রায় ধস নেমেছে। আসন্ন দিনগুলোয় দেশটিতে মারাত্মক অস্থিতিশীলতার আশঙ্কা করছেন পর্যবেক্ষকরা। গৃহযুদ্ধের কারণে এরই মধ্যে দেশটিতে বাস্তুচ্যুত হয়েছে অসংখ্য মানুষ। অদূরভবিষ্যতে এ সংখ্যা আরো বাড়ার জোর আশঙ্কা রয়েছে।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হয়ে পড়া এ আফগান নাগরিকদের দুরবস্থার সুযোগ নিতে পারে তালিবানরা। তাদের নিয়োজিত করা হতে পারে মাদক উৎপাদন ও বাণিজ্যের সঙ্গে।
এছাড়া আফগানিস্তানের অর্থনীতিতে বৈদেশিক অনুদাননির্ভরতা অনেক বেশি। তালিবানদের কাবুল দখলের পর এ অনুদানের বড় একটি অংশ বন্ধ হয়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে তালিবানরা আয়ের জন্য নিশ্চিতভাবেই মাদক বাণিজ্যের ওপর আরো নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম মানিকন্ট্রোলে প্রকাশিত এক নিবন্ধে সাংবাদিক প্রবীণ স্বামী জানাচ্ছেন, মাদক ব্যবসা এখন আফগান অর্থনীতির প্রকৃত মেরুদণ্ড হয়ে উঠছে। ২০০৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত তালিবানদের মোট আয়ের অর্ধেকই এসেছে মাদক ব্যবসা থেকে। এজন্য নারকোটিক ফসল উৎপাদন ও চাষাবাদ, এর সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং মধ্য এশিয়ার ভেতর দিয়ে অপরাধীনির্ভর সরবরাহ রুটের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হয়েছে তাদের। এখন তাদের হাতে আগের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতা। স্বাভাবিকভাবেই নিজেদের ব্যবসা সম্প্রসারণের এ প্রকৃত সুযোগকে কাজে লাগাবে তারা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মার্কিনদের এসব উদ্যোগে শেষ পর্যন্ত হিতে বিপরীত হয়েছে। আফিম চাষের ওপর নির্ভরশীল আফগান কৃষকদের কাছ থেকে ক্রমেই দূরে সরে গিয়েছে কাবুলের সরকার ও তাদের বিদেশী পৃষ্ঠপোষকরা। এ আফিমচাষী কৃষকরা শেষ পর্যন্ত তালিবানদেরই অনুগত হয়ে উঠেছেন।
অতীতে তালিবানরা ক্ষমতায় থাকা অবস্থায়ও আফগানিস্তানের আফিম চাষ বিশ্বব্যাপী উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছিল। অব্যাহত আন্তর্জাতিক চাপের মুখে তৎকালীন তালিবান সরকার আফিম চাষ বন্ধের ঘোষণা দেয়। পুরোপুরি বন্ধ না করলেও ওই সময় পপি চাষ কমিয়ে আনে তালিবানরা। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় আফিমচাষীদের বড় একটি অংশ তালিবানদের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। পরে আফগানিস্তানে মার্কিন সৈন্যদের তালিবানবিরোধী অভিযান শুরু হলে সে সময় তারা তালিবানদের পক্ষ ত্যাগ করে।
জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকজন কর্মকর্তা আশঙ্কা করছেন, আফগানিস্তান বিশৃঙ্খলায় পতিত হলে অবৈধ আফিম উৎপাদন আরও বেড়ে যেতে পারে। যা তালিবানের জন্য সম্ভাব্য আশীর্বাদ হতে পারে।
কাবুলে জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ সংস্থার প্রধান সিজার গুডেস বলেন, তালিবানরা নিজেদের আয়ের অন্যতম উৎস হিসেবে আফিম ব্যবসাকে বিবেচনা করে। বেশি উৎপাদন হলে মাদকের মূল্য কম ও আকর্ষণীয় হবে। ফলে তা একেবারে সহজে পাওয়া যাবে।
জাতিসংঘ সংস্থার মতে, গত চার বছরে আফগানিস্তানে সর্বোচ্চ পরিমাণ আফিম উৎপাদন হয়েছে। এমনকি করোনাভাইরাস মহামারিতেও গত বছর উৎপাদন বেড়েছে ৩৭ শতাংশ।
আফগানিস্তানে অবৈধ মাদক ব্যবসা নিয়ে গবেষণা করা ডেভিড ম্যান্সফিল্ডের মতে, এসব মাদকের কিছু চালান কঠোর নিরাপত্তা থাকা সীমান্ত দিয়ে ইরানের পাচারকারীদের কাছে পাঠানো হয়।
জাতিসংঘ কর্মকর্তারা এক প্রতিবেদনে জানিয়েছেন, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে মাদক ব্যবসা থেকে ৪০০ মিলিয়নের বেশি মুনাফা অর্জন করেছে তালিবান।
মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের এক প্রতিবেদনে একজন কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে উল্লেখ করা হয়েছে, তালিবানের বার্ষিক আয়ের প্রায় ৬০ শতাংশ আসে অবৈধ মাদক থেকে।
ম্যান্সফিল্ডের মতে, অবৈধ আফিম থেকে তালিবানের বার্ষিক আয় সর্বোচ্চ ৪০ মিলিয়ন ডলার হতে পারে। এই অর্থ আসে মূলত আফিম উৎপাদন, হেরোইন ল্যাব ও মাদক পাচারের চালান থেকে লেভি সংগ্রহের মাধ্যমে। কিন্তু বৈধ আমদানি ও রপ্তানি থেকে ফি নিয়ে মাদকের চেয়ে বেশি অর্থ সংগ্রহ করে তালিবান যোদ্ধারা।
আফগানিস্তান এমনিতে বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বড় আফিম রপ্তানিকারক দেশ। আফিম থেকে হেরোইনের মতো মাদক তৈরি করা হয়। তবে তারা যে কেবল আফিমই উৎপাদন করে তা নয়, এবার আরেক ভয়ঙ্কর মাদক মেথাম্ফেটামিনের উৎপাদনও বাড়ছে যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশটিতে। আফগানিস্তানের কিছু অংশে মেথাম্ফেটামিনের উৎপাদন এরই মধ্যে আফিমকেও ছাড়িয়ে গেছে। বিশেষজ্ঞদের দাবি, অবৈধ মাদক ব্যবসা বাড়তে থাকলেও সেদিকে নজর দেয়া হয়নি। এখন যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহার ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের উদ্বেগ বাড়তে শুরু করেছে। তাদের আশঙ্কা, আফগানদের মেথাম্ফেটামিনের সারা ইউরোপে ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৩২
আপনার মতামত জানানঃ