পৃথিবীর কোটি কোটি বছরের ইতিহাসে দু’বার পার্বত্যভূমি তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে নবতম হিমালয়। বর্তমানে পৃথিবীর বৃহত্তম শৃঙ্গ হিমালয়েই। এশিয়া মহাদেশের একটি বড় অংশ জুড়ে বিস্তৃত রয়েছে হিমালয় পর্বতমালা। কিন্তু হিমালয়ের চেয়েও বিস্তৃত পর্বতমালা যে একসময় পৃথিবীতে ছিল, তার প্রমাণ পেলেন অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির গবেষকরা। তারা এর নাম দিয়েছেন ‘মহাপর্বতমালা’। গবেষকদের দাবি, এই পৃথিবীর গঠনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে এই পর্বতমালা।
সম্প্রতি একটি ভূতাত্ত্বিক গবেষণা সংক্রান্ত জার্নালে এই ‘মহাপর্বতমালা’ নিয়ে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। হিমালয়ের চেয়ে চারগুণ বেশি এলাকা জুড়ে বিস্তৃত ছিল এই পর্বতমালা। হিমালয়ের বিস্তৃতি ২৩০০ কিলোমিটার। সেই তুলনায় সদ্য হদিশ পাওয়া পর্বতমালার বিস্তৃতি ৮ হাজার কিলোমিটার।
পৃথিবীর সৃষ্টির ইতিহাসে দু’টি পর্বে এই পর্বতমালা গঠিত হয়েছিল বলে গবেষকরা জানিয়েছেন। প্রথম বার গঠিত হয়েছিল ২০০ কোটি থেকে ১৮০ কোটি বছর আগে এবং দ্বিতীয় বার এর গঠন প্রক্রিয়া শুরু হয় ৬৫ থেকে ৫০ কোটি বছর আগে।
তবে গবেষকরা জানাচ্ছেন, এই পর্বতমালার এই দু’বার গঠিত হওয়ার সঙ্গে পৃথিবীর বির্বতনের ইতিহাসের যোগ রয়েছে।
‘আর্থ অ্যান্ড প্ল্যানেটারি সায়েন্স লেটার্স’ জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, এই সুউচ্চ পর্বতমালার শিকড়ে বেশ কিছু বিরল খনিজ উপাদানের সন্ধান মিলেছে যা সাধারণত তীব্র চাপের মধ্যে তৈরি হয়। এই থেকেই তারা মনে করছেন ‘মহাপর্বত’-এর উত্থানের সঙ্গে পৃথিবীর বির্বতন যুক্ত রয়েছে।
গবেষকদের মতে, জীবের বিবর্তনের ক্ষেত্রেও এই ‘মহাপর্বতমালা’গুলির ভূমিকা গুরত্বপূর্ণ। কারণ, যখন পর্বতগুলি ক্ষয়প্রাপ্ত হয় তারা সমুদ্রে ফসফরাস এবং লোহার মতো প্রয়োজনীয় পদার্থ সরবরাহ করে। যা জৈবিক চক্রকে গতি এবং বিবর্তনকে আরও জটিলতার দিকে নিয়ে যায়। ‘মহাপর্বতমালা’গুলির অস্তিত্বের কারণে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেনের মাত্রা বেড়েছে বলে তারা জানিয়েছেন। যার ফলে জীব ও উদ্ভিদ জগতের টিকে থাকা ও বিবর্তন সম্ভব হয়েছে।
হিমালয়ের চেয়ে চারগুণ বেশি এলাকা জুড়ে বিস্তৃত ছিল এই পর্বতমালা। হিমালয়ের বিস্তৃতি ২৩০০ কিলোমিটার। সেই তুলনায় সদ্য হদিশ পাওয়া পর্বতমালার বিস্তৃতি ৮ হাজার কিলোমিটার।
ক্যানবেরায় অস্ট্রিলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির গবেষক জিই ঝু জানিয়েছেন, প্রাচীন পর্বতমালা আর আস্ত নেই। শুধু উচ্চতাই নয় হিমালয়ের থেকেও বিস্তৃত ছিল এই পর্বতগুলি। অত্যন্ত দুর্গম ছিল এগুলি।
প্রাচীন শৃঙ্গগুলি গবেষণা করেছেন জিই ঝু ও তার সঙ্গীরা। আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি তাদের গবেষণাপত্র প্রকাশিত হবে আর্থ প্ল্যানেটারি সায়েন্স লেটারে। সুপার মাউন্টেন সৃষ্টি ও ধ্বংসের কারণ রয়েছে ওই গবেষণাপত্রে। আনুমানিক ২০০ কোটি বছর আগে পৃথিবীতে সৃষ্টি হয়েছিল সুপার মাউন্টেন। দ্বিতীয়বার ৫৪.১ কোটি বছর আগে কোটি বছর আগে সমুদ্রে ক্যামব্রিয়ান বিস্ফোরণে ফলে সৃষ্টি হয়েছিল সুউচ্চ পর্বত।
গবেষকদের মতে, সুপার মাউন্টের সমুদ্রের মিলিয়ে গিয়েছে। এর ফলে সমুদ্রে অণুজীব ভরে উঠেছিল। প্রাণের জন্মে তা অনুঘটক হয়েছিল। সাধারণভাবে টেকটনিক প্লেটের সংঘর্ষে জন্ম হয় পর্বতের। ঠিক যেমনভাবে সমতল ভূমিতে কাগজ রেখে দুধারে চাপ দিলে তা উপর-নীচ ঢেউ খেলে।
জিই জানিয়েছেন, কোটি কোটি বছর ধরে চলে পর্বতের সৃষ্টি প্রক্রিয়া। সেই সঙ্গে তাদের ধ্বংসের সময়ও স্থির হয়ে যায়। জল ও অন্যান্য প্রাকৃতিক শক্তির জন্য ক্ষয় হতে থাকে। ভূমির উপরের অংশ অর্থাৎ ক্রস্ট। তার নীচের অংশ জিরকন ক্রিস্টল। সুপার মাউন্টেন সৃষ্টির সময় জিরকন ক্রিস্টল তৈরি হয়েছিল। মাটির নীচে বিপুল চাপ ও তাপ সহ্য করে এই স্তর।
গবেষণাপত্র অনুযায়ী,জিরকন্সে সামান্য মাত্রায় লুটেটিয়ম খনিজ মিলেছে। দুনিয়ায় দুর্লভ খনিজের মধ্যে এটি একটি। এটি সাধারণ পাহাড়ের নীচে পাওয়া যায়। প্রাচীন সুপার মাউন্টেনের নির্মাণ হয়েছিল ২০০ থেকে ১৮০ বছর আগে।
আর একটি ঘটনা ৬৫ থেকে ৫০ বছর আগের। সেই সময় ট্রান্সগোন্ডওয়ানা সুপারমাউন্টেনের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়েছিল গোন্ডওয়ানা সুপারকন্টিনেন্টের। গোন্ডওয়ানা সুপার কন্টিনেন্টের অংশ ছিল আধুনিক আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, আন্টার্কটিকা এবং পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপসমূহ। তখন সর্বোচ্চ শৃঙ্গের পর্বতের নাম ছিল নুনা সুপারমাউন্টেন। গোন্ডওয়ানা তৈরির পর এর সৃষ্টি হয়েছিল।
গবেষকরা জানতে পেরেছেন সুপারমাউন্টেন বিস্তৃত ছিল ৮০০০ কিলোমিটার জুড়ে। অর্থাৎ শ্রীনগর থেকে কন্যাকুমারীর দু’বার করলে যে পথ। গোন্ডওয়ানা ভেঙে আলাদা আলাদা মহাদেশে পরিণত হওয়ার পর সমুদ্রে মিলিয়ে যায় সুপারমাউন্টেন। ফলে লোহা ও ফসফরাসের মতো খনিজ মেশে সমুদ্রে। এতে গতি পায় প্রাণের সৃষ্টি।
লোহা ও ফসফরাস জলে মেশায় শুরু হয় রাসায়নিক বিক্রিয়া। জীবন ক্রমশ জটিল হতে শুরু করে। অণুজীব থেকে বহুকোষের জীব, মাছ, সরীসৃপের উদ্ভব হয়। শুধু তাই নয় বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেনের পরিমাণও বাড়ে। জীবনের সূচনায় তা সাহায্য করে।
নুনা সুপারমাউন্টেন সৃষ্টি ও ধ্বংসের সময়ে ধীরে ধীরে ইউক্যারিয়োটিক কোষ অর্থাৎ নিউক্লিয়াসযুক্ত কোষের জন্ম হচ্ছিল। পরবর্তীকালে গাছপালা ও ছত্রাক হিসেবে হিসেবে বিকশিত হয়।
ট্রান্সগোন্ডয়ানা সুপারমাউন্টেন থাকার সময় প্রায় ৫৭.৫ কোটি বছর আগে জীবের বিকাশ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। ১৭০ থেকে ৭৫ কোটি বছর আগে পৃথিবীরে পর্বত সৃষ্টির প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়
এই বন্ধ হয়ে যাওয়াকে বোরিং বিলিং তকমা দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তখন পৃথিবীতে জীবের নানা রূপে বিকশিত হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছিল।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৪৭
আপনার মতামত জানানঃ