শুধু পুরুষদের নয়, নারীদেরও খৎনা হয়! যদিও এ বিষয়ে অনেকেই অবগত নন! তবে সত্যিই এমন প্রথা রয়েছে বিশ্বের কয়েকটি দেশে। আফ্রিকা মহাদেশের ২৭টি দেশসহ ইন্দোনেশিয়া, ইরাকের কুর্দিস্তান, ইয়েমেনে দেশগুলোতে নারীদের খৎনা একটি ধর্মীয় রীতি হিসেবেই প্রচলিত।
জাতিসংঘের হিসাবে, বিশ্বের প্রতিটি ২০জন মেয়ে শিশু বা নারীর মধ্যে একজনের খৎনা করা হয়ে থাকে, যাকে ইংরেজিতে বলা হয় এফিএম বা ফিমেল জেনিটাল মিউটিলেশন। মূলত আধুনিক বিশ্ব সৃষ্টি হওয়ার প্রায় শতবর্ষ আগে থেকেই এ রীতি মেনে আসছেন বহু মানুষ। আর সংখ্যাটাও একেবারেই নগণ্য নয়!
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও জাতিসংঘের মত অনুসারে ‘চিকিৎসা বহির্ভূত কোনো কারণে নারীদের যৌনাঙ্গের বাহ্যিক অংশের আংশিক বা পূর্ণ অপসারণ করানো হলো নারীর যৌন বিকৃতিকরণ যাকে ইংরেজিতে বলা হয় এফিএম বা ফিমেল জেনিটাল মিউটিলেশন (এফ জি এম)’অনেক সময় বয়ঃসন্ধির সময় এটি করা হয়।
অ্যামেনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ধারণায় প্রতি বছর প্রায় ১৩০ মিলিয়ন (১৩ কোটি) নারী এই নারী খৎনার কোন না কোনো একটি প্রক্রিয়া দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে। বর্তমানে নারী যৌনাঙ্গ ছাটাই-এর চর্চা প্রধানত আফ্রিকান দেশগুলোতেই হয়। এটা একটি সাধারণ বলয় যার বিস্তৃতি পশ্চিম আফ্রিকার সেনেগাল থেকে পূর্ব উপকূলের ইথিওপিয়া, সেই সাথে উত্তরে মিশর থেকে দক্ষিণে তানজানিয়া পর্যন্ত। এছাড়াও আরব উপদ্বীপের কিছু গোষ্ঠীর মধ্যেও এটির চর্চা দেখা যায়।
মেয়ে শিশুদের ওপর এ রকম খৎনা করার প্রবণতা বাড়ছে। নারী খৎনা চূড়ান্তভাবে নারী-অধিকার লঙ্ঘন। তাই নারীর যৌনাঙ্গচ্ছেদ রোধে জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে জাতিসঙ্ঘ বিশ্ব জনসংখ্যা তহবিল প্রতি বছর ৬ ফেব্রুয়ারী বিশ্ব জুড়ে আন্তর্জাতিক নারী খৎনা বা নারী যৌনাঙ্গ বিকৃতিকরণের ‘জিরো টলারেন্স’শূন্য সহনশীলতা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে।
নারীদের খৎনা কী?
নারীদের খৎনার মানে হলো ইচ্ছাকৃতভাবে মেয়েদের যৌনাঙ্গের বাইরের অংশটি কেটে ফেলা। অনেক সময় ভগাঙ্কুর এর পাশের চামড়া কেটে ফেলা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছে, চিকিৎসার প্রয়োজন ব্যতীত এমন যে কোনো প্রক্রিয়া, যা নারীদের যৌনাঙ্গের ক্ষতি করে থাকে। নারী খৎনা সাধারণত ১৫ বছরের কম বয়সী তরুণীদের মধ্যে ঘটানো হয়।
বিশ্ব জুড়ে প্রায় ২০০ লাখ তরুণী ও নারী বিভিন্নভাবে নারী খৎনার শিকার, এবং তিন লাখ তরুণী এখনো এই মর্মান্তিক নারী খৎনার অধীনে আসার ঝুঁকিতে রয়েছে। সাধারণত মেয়ের বয়স পাঁচ বছর পার হওয়ার আগেই যৌনাঙ্গচ্ছেদ করা হয়। অনেকে ধর্মের দোহাই দিয়ে এটা করলেও কোরান এবং বাইবেলে এ রকম কিছু লেখা নেই বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। বরং যৌনাঙ্গচ্ছেদের কারণে রক্তক্ষরণ বা সংক্রমণে মেয়েদের মৃত্যুও ঘটে।
নারী খৎনা শধুমাত্র ক্ষতিই করে, এর কোনো শারীরিক উপকার নেই। বহু বছর ধরে সুদানে চলে আসছে বিভৎসা প্রথা নারী খৎনা। যেটার মাধ্যমে নারীদের উপরের অথবা ভেতরের লেবিয়া এবং ক্লিট কেটে ফেলা হয়। সেটা যে অভিজ্ঞ ডাক্তার দিয়ে করা হয়, এমন নয়।
এমন কাজে পারদর্শী গ্রামের কোনো নারীকে দিয়ে করানো হয়। যেটা মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকির। এটা করার কারণে মূত্রনালীতে সংক্রমণ, জরায়ুর সংক্রমণ, কিডনির সংক্রমণ, সিস্ট, গর্ভধারণে অক্ষমতা ও ব্যথাযুক্ত শারীরিক সম্পর্কের মতো নানারকম সমস্যা দেখা দেয়।
জাতিসংঘের মতে সুদানের ১৪ থেকে ৪৯ বছর বয়সী যে কোনো নারীকে এই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। তাদের উপরের অথবা ভেতরের লেবিয়া আংশিক কিংবা পুরোপুরিভাবে কেটে ফেলা হয়। কেটে ফেলা হয় ক্লিটও। মেয়েদের খৎনা দেয়ায় যুক্তরাষ্ট্রে নারী চিকিৎসকের বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে। জুমানা নাগাওয়াল নামে যুক্তরাষ্ট্রের ডেট্রয়েট শহরের এক নারী চিকিৎসকের বিরুদ্ধে মেয়েদের খৎনা দেয়ার অভিযোগে মামলা হয়।
প্রসিকিউটর কার্যালয় সূত্র জানায়, ঐ চিকিৎসক ১২ বছর ধরে ছয় থেকে আট বছর বয়সী মেয়েদের খৎনা দিয়ে আসছিলেন। ১৯৯৬ সাল থেকে মেয়েদের খৎনা দেয়াকে অবৈধ ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্রে। অভিযোগ ওঠার পর ঐ চিকিৎসকের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়েছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে। এ ধরনের মামলা দেশটিতে এই প্রথম। যদিও ডা. নাগারওয়ালা তার বিরুদ্ধে আনা এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
নারীদের ক্ষেত্রে চার ধরনের খৎনা হয়
১. ভগাঙ্কুর এবং আশেপাশের চামড়ার পুরোটাই বা আংশিক কেটে ফেলা
২. ভগাঙ্কুর, যৌনাঙ্গের বাইরের বা ভেতরের চামড়া অপসারণ করে ফেলা
৩. যৌনাঙ্গের বাইরের বা ভেতরের অংশের চামড়ার অংশটি কেটে ফেলে পুন:স্থাপন করা।
যৌনাঙ্গের বাইরের এবং ভেতরের চামড়া কেটে এমনভাবে পুনঃ স্থাপন করা হয়, যাতে শুধুমাত্র মূত্র ত্যাগের জন্য ছোট একটি ফাঁকা থাকে। এতে অনেক সময় নারীদের নানা সংক্রমণে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।
অনেক সময় এই ফাঁকা জায়গাটি এতো ছোট হয়ে থাকে যে, যৌন মিলনের জন্য পরবর্তীতে আবার কেটে বড় করতে হয়। অনেক সময় সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মা ও শিশুর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে।
৪. ওপরের তিনটির বাইরে ভগাঙ্কুরের বা যৌনাঙ্গের সবরকম কাটা ছেঁড়া বা ক্ষত তৈরি করা
নারী খৎনার জটিলতা
নারী খৎনার শুরুতেই গুরুতর ব্যথা, শক, রক্তক্ষরণ (রক্তপাত), টিটেনাস বা সেপিসিস (ব্যাক্টেরিয়াল সংক্রমণ), প্রস্রাব ধারণ ক্ষমতা কমে যাওয়া, যৌন-অঞ্চলে ক্ষত ও জখম, এবং মৃত্যু ।
দীর্ঘমেয়াদী ফলাফল, মূত্রসংক্রান্ত সমস্যা (প্রস্রাবে বেদনা, মূত্রনালীর সংক্রমণ), যোনি সমস্যা (স্রাব, চুলকুনি, ব্যাকটেরিয়াল ভেজিনসিস ও অন্যান্য সংক্রমণ), মাসিক সমস্যা (বেদনাদায়ক স্রাব, স্রাবজনিত রক্ত নি:সরণে অসুবিধে), খুঁতযুক্ত কলা এবং কেলাসাকার গঠন, বন্ধ্যাত্ব, যৌন সমস্যা (যৌন মিলনের সময় ব্যথা, সঙ্গমে অসন্তোষ), প্রসবকালীন জটিলতা (যেমন প্রসবে সংকটজনক অবস্থা, অতিরিক্ত রক্তপাত, সিজারিয়ান সেকশন) এবং নবজাতকের মৃত্যু, পুনরায় সার্জারির প্রয়োজন হতে পারে, মানসিক সমস্যা (যেমন বিষণ্নতা, উদ্বেগ, পোস্ট-ট্রমাটিক মানসিক চাপ, আত্মসম্মান হানি)।
এর ফলে নারীদের শারীরিক এবং মানসিক সমস্যার তৈরি হয়, যা পরবর্তীতে তাদের সারাজীবন ধরে বয়ে বেড়াতে হয়। বর্তমান বিশ্বে এ রকম ২০ কোটি নারী রয়েছেন, যাদের আংশিক অথবা পুরো খৎনা অর্থাৎ যৌনাঙ্গ কেটে ফেলা হয়েছে। অনেক নারী ও মেয়ের শিশু অবস্থাতেই এ রকম খৎনা করা হয়, এমনকি শিশুদেরও।
এই বর্বরতার শিকার অর্ধেক নারীর অবস্থান মিশর, ইথিওপিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ায়। ২০২০ সালের তুলনায় এই হিসেব প্রায় সাত কোটি বেশি। ২০২১ সালে জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী ১৫ বছরে যৌনাঙ্গচ্ছেদের শিকার মেয়ে ও নারীর সংখ্যা অনেক বেড়ে যাবে।
ইউনিসেফের প্রতিবেদন অনুযায়ী, আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের ২৯টি দেশে ব্যাপকভাবে এ রীতি চালু রয়েছে, যদিও এদের মধ্যে ২৪টি দেশেই এটি নিষিদ্ধ। অনেকে দেশে বেআইনি হওয়া সত্ত্বেও পরিবারের ঘনিষ্ঠজনদের সাজা হতে পারে, এ রকম আশঙ্কা থেকে ভুক্তভোগীরা আর অভিযোগ সামনে আনেন না।
যদিও নারী খৎনা কোনোভাবেই স্বাস্থ্যসম্মত নয়, তবুও অনেক দেশে স্বাস্থ্যসেবা-কর্মী দিয়ে এই নারী খৎনা সম্পন্ন করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উপদেশবিধি অনুযায়ী এক্ষেত্রে একজন স্বাস্থ্যসেবা-কর্মীর যা যা জানা উচিত, নারী খৎনা হলো কঠোরভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন, নারী খৎনা কখনো কোনভাবেই যেন সম্পাদিত ও সংঘটিত না হয় (এমনকি স্বাস্থ্যসেবা-কর্মী দিয়েও নয়), যদি এই চর্চাটি আজও চলতে থাকে তবে ২০৩০ সালের মধ্যে আরো ৮৬ লাখ কন্যাসন্তান এই অত্যাচার ও বিকৃতিকরণের শিকার হবে।
কেন করা হয় এটি?
নারী খৎনার দুঃসহ অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন বিশারা নামের এক নারী। তিনি বলেন, ‘আমার চোখ বেঁধে দুই হাত পেছনে শক্ত করে বাঁধা হয়। দুই পা দু’দিকে মেলে ধরে যৌনাঙ্গের বাইরের চামড়া দু’টি শক্ত করে পিন কিছু দিয়ে আটকে দেয়া হয়। আমি তীক্ষ্ণ একটি ব্যথা অনুভব করে চিৎকার করতে থাকি। আমার আর্তনাদে কেউ সাড়া দেয়নি। আমি লাথি মেরে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করলাম। দানবের মতো কেউ একজন আমার পা চেপে ধরেছিল।’
বিশারা বলেন, এটি ছিল অত্যন্ত কষ্টকর। অন্য সব মেয়েদেরও একই অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যেতে হয়। ব্যথা নিরাময়ের জন্য ছিল শুধু স্থানীয়ভাবে তৈরি ভেষজ ওষুধ। একটি ছাগলের মতো করে তারা আমার দুই পা টেনে ধরে ক্ষত স্থানে সেই ভেজষ ওষুধ মাখিয়ে দেয়। এভাবেই প্রত্যেক নারীকে খৎনা দেয়া হয়।
নারীদের খৎনার পেছনে যেসব কারণ মূলত কাজ করে,সেগুলো হল সামাজিক রীতি, ধর্ম, পরিছন্নতার বিষয়ে ভুল ধারণা, কৌমার্য রক্ষার একটি ধারণা, নারীদের বিয়ের উপযোগী করে তোলা এবং পুরুষের যৌন আনন্দ বৃদ্ধি করার মতো বিষয়।
অনেক সংস্কৃতিতে নারীদের খৎনাকে মেয়েদের সাবালিকা হয়ে ওঠা মনে করা হয়। এটিকে অনেক সময় বিয়ের পূর্বশর্ত হিসাবেও দেখা হয়।
যদিও পরিছন্নতার বা স্বাস্থ্যগত কোন সুবিধা নেই, কিন্তু এ ধরণের রীতিতে অভ্যস্ত সমাজগুলোর মানুষেরা মনে করেন, যেসব মেয়েদের এরকম খৎনা করা হয়নি, তারা তারা অস্বাস্থ্যকর, অপরিছন্ন বা গুরুত্বহীন।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারীদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এটি করা হয় এবং বিশ্বের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এটি নারীদের বিরুদ্ধে একটি সহিংস আচরণ।
এটি আইনত অপরাধ
জাতিসংঘ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ বিভিন্ন সংগঠন ও দেশ সুদানের এই বর্বরোচিত প্রথার বিলুপ্তি ঘটানোর জন্য কাজ করে যাচ্ছিলো বহু বছর ধরে। অবশেষে ২০২০ সালের মে মাসে সুদানে নারীর খৎনাকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
এই অপরাধে তিন বছরের কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি এখবর জানিয়েছে। শুধু কি সুদান? মধ্যপ্রাচ্য, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা, এশিয়া, উত্তর আমেরিকার অনেক দেশে রয়েছে এই প্রথা।
সম্প্রতি রাশিয়ায় একটি বিল আনা হয়েছে, যেখানে নারীদের মুসলমানিকে (FGM- Female Genital Mutilation) একটি আইনি অপরাধ হিসেবেই দেখা হবে। অপরাধী যেই হোক না কেন, শাস্তি হতে পারে ১০ বছরের কারাবাস। রাশিয়ার পার্লামেন্টে এ বিলের সপেক্ষে বলা হয়, সভ্য সমাজে নারী যৌনাঙ্গের অঙ্গহানি বা নারীদের মুসলমানির মতো বর্বর প্রথার কোনো স্থান নেই।
এসডব্লিউ/এসএস/১৯৪০
আপনার মতামত জানানঃ