একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আমাদের ব্যর্থতার গ্লানি ছাড়া আর কিছু দিতে পারেনি। ওই নির্বাচনে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’-এর অস্তিত্ব ছিল না। যদিও সিইসি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড আছে বলে দাবি করেন। জেলা প্রশাসকেরা রিটার্নিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করায় বিদ্যমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সিটিং এমপিদের বিষয়ে তাদের নিরপেক্ষতা অবলম্বন করা সম্ভব ছিল বলে মনে করি না। একাদশ জাতীয় নির্বাচনে ২১৩টি কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে, এতেই বোঝা যায় নির্বাচন কেমন হয়েছে? এভাবে না অবাধ, না সুষ্ঠু, না নিরপেক্ষ, না আইনানুগ, না গ্রহণযোগ্য একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
নির্বাচন নিয়ে এমনই মন্তব্য করলেন নানা কারণে সমালোচিত নির্বাচন কমিশনের সদস্য মাহবুব তালুকদার। প্রসঙ্গত, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে ১৪ ফেব্রুয়ারি।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালট পেপার ভর্তি বাক্সের ছবি বিবিসির সাংবাদিক প্রকাশ করেন। এই অভিযোগ প্রসঙ্গে মাহবুব তালুকদার বলেন, এই অভিযোগ খণ্ডনের কোনো উপায় ছিল না। কারণ, এটি প্রতিষ্ঠিত সত্য। আদালতের নির্দেশ ছাড়া রাতের ভোটের তদন্ত করা যেত না, তা ঠিক নয়। নির্বাচন যথাযথ হয়নি মনে করলে কমিশন ফলাফল ঘোষণার পরও নির্বাচন বাতিল করতে পারে।
জাতীয় নির্বাচনে দিনের ভোট রাতে করা নিয়ে আমাদের মধ্যে কোনো আলোচনা হয়নি। নির্বাচনের পরদিন সংবাদ সম্মেলন করে সিইসি বলেছিলেন,─‘এই নির্বাচনের বিষয়ে আমি অতৃপ্ত নই, তৃপ্ত। শুধু আমি নই, পুরো কমিশনই সন্তুষ্ট। কেউ তো আমাকে তাঁর অসন্তুষ্টির কথা বলেননি।’
এমনকি তিনি জানান, সংসদ নির্বাচনের আগে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ইসির নিয়ন্ত্রণে ছিল না। বর্তমান নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় এটাই তো স্বাভাবিক। নির্বাচনে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানেন, নির্বাচন কমিশন সাময়িকভাবে তাদের ‘বস’ হলেও স্থায়ী ‘বস’ হচ্ছেন যারা সংসদ সদস্যের চেয়ারে আসীন থেকে পুনরায় নির্বাচনে সংসদ সদস্য হবেন। রিটার্নিং কর্মকর্তাদের নিরপেক্ষহীনতার কথা আগেই বলেছি। আমার মতে, জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে জনপ্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নির্বাচন কমিশনের অধীনে ন্যস্ত হওয়া উচিত।
তিনি বলেন, গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন আমি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে এর স্বরূপ সন্ধান করি। এর বিশদ প্রতিবেদন তৈরি করি আর বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আমি একক দায়িত্ব পালন করেছি। অনিয়মের কারণে বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচন বন্ধ করতে চেয়েও সহকর্মীদের অসহযোগিতায় আমি তা পারিনি। এ দুটি নির্বাচনে কমিশনের কোনো কর্তৃত্ব ছিল বলে মনে হয় না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষপাতিত্ব ছিল দৃশ্যমান। আবার চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন ছিল অনিয়মের মডেল। বাকি সিটি করপোরেশন নির্বাচনেরও তথৈবচ অবস্থা। যেনতেন প্রকারে নির্বাচন হয়েছে।
৩০ জুলাই ২০১৯ তারিখে অনুষ্ঠিত বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচন প্রসঙ্গে বলেন, এই নির্বাচন তদারকিতে আমি একক দায়িত্বে ছিলাম। নির্বাচনপূর্বে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রার্থী, নির্বাচনসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাবৃন্দ, সবার সঙ্গে আলোচনা করে একটি অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করি। সকাল ৮টায় টেলিভিশনে ভোটকেন্দ্রে ভিড় দেখে আমি খুবই আশাবাদী হই যে বরিশালে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।
তবে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শান্তি ও শৃঙ্খলা পাল্টে যেতে থাকে। এরপর থেকে বিভিন্ন নেতিবাচক সংবাদ ও প্রতিবেদন আসতে থাকে। আমরা সিইসির অফিসকক্ষে বসে নির্বাচন মনিটর করছিলাম। একজন কমিশনার প্রথমে খবর দেন যে সাড়ে আটটায় নির্বাচনী কাজে ব্যবহৃত ট্যাব ছিনতাই হয়েছে। পরে আরও খবর আসে, কমিশনের একজন মহিলা সিস্টেম এনালিস্টকে নাজেহাল করা হয়েছে। বে
লা ১১টার দিকে বরিশালের আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে আমার ধারণা হয়, বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচন পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া উচিত। আমার অভিমতের সঙ্গে প্রাথমিকভাবে সিইসিসহ সব কমিশনার একমত হন। কিন্তু কোন আইনে আমরা নির্বাচন বন্ধ করতে পারি, যুগ্ম সচিব (আইন)-কে ডেকে তা জিজ্ঞাসা করা হয়। তিনি নির্বাচন ম্যানুয়েল দেখে বলেন, ৯০ ধারা মোতাবেক এই ব্যবস্থা নেওয়া যায়। আমি আশ্বস্ত হই।
এই পর্যায়ে একজন কমিশনার বলেন, যেহেতু আমি বরিশাল সিটি নির্বাচনের সার্বিক দায়িত্বে, সেহেতু আমি এতদসংক্রান্ত নথিতে নির্বাচন বন্ধে বিষয়টি লিখে দিলে তারা সমর্থন করবেন। আমি একটি কাগজে নোটে কী লিখব, তার খসড়া লিখে দিই। সিইসি সেটা পড়ে বললেন, ঠিক আছে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে নির্বাচন বন্ধ করার বিষয়টিতে তারা গড়িমসি করতে থাকেন। আমার প্রস্তাবিত সিদ্ধান্ত ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হয়।
দুপুরবেলা একজন কমিশনার বলেন, এখন নির্বাচন বন্ধ করলে আমাদের লোকজনের ওপর হামলা হবে, নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। সবাই তাতে সায় দেন। অবশেষে সহকর্মীদের অসহযোগিতায় নির্বাচন আর বন্ধ করা যায়নি।
আগামী সংসদ নির্বাচন নিয়ে উদ্বিগ্ন মাহবুব তালুকদার। তার মতে, বিরোধী দলগুলো অংশগ্রহণ না করলে সেই নির্বাচন ঘরে ও বাইরে গ্রহণযোগ্য হবে না। বিগত দুটি নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে বলি, বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে বলে মনে হয় না। এ পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে যেসব জাতীয় নির্বাচন হয়েছে, তা গ্রহণযোগ্য হয়েছে। সংবিধান সংশোধন ছাড়া এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন সম্ভব নয়।
বর্তমান বাস্তবতায় সুষ্ঠু নির্বাচনে প্রধান প্রধান অন্তরায় কী, এ প্রসঙ্গে মাহবুব তালুকদার বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রধান অন্তরায় নির্বাচন বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতা না হওয়া। এ ছাড়া নির্বাচনে ম্যানিপুলেশনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা বা ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার মনস্তাত্ত্বিক অভিলাষ দূর করতে হবে। স্বাভাবিকভাবে ক্ষমতার পরিবর্তন ও হস্তান্তর বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা থাকা অত্যাবশ্যক। নির্বাচনকালে যে অনিয়ম, উচ্ছৃঙ্খলতা ও অরাজকতা দেখা যায়, কঠোরভাবে তা প্রতিহত করে ভোটারদের মধ্যে ইচ্ছানুযায়ী ভোট প্রদানের আস্থা ফেরানো জরুরি।
ইভিএম নিয়ে তিনি বলেন, ইভিএমের আরম্ভলগ্নে আমি ইভিএমের বিরোধিতা করেছি। জনগণ অভ্যস্ত না হলে এর ব্যবহার ঠিক হবে না বলেছি। ইভিএম ব্যবহারের আগে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। সে প্রতিশ্রুতি রক্ষিত হয়নি। অজ্ঞাত কারণে আমাদের ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্তের আগেই ইভিএম কেনা হয়ে যায়। আমার কাছে ইভিএম মেশিন অপূর্ণাঙ্গ মনে হয়। নাসিক নির্বাচনে দেখেছি ইভিএমের কার্যকারিতা বেশ স্লো।
ইভিএম সম্পর্কে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের একটি ঐতিহাসিক নির্দেশনা আছে। তাতে বলা হয়েছে, ইভিএমে ভোটার ভ্যারিফায়েড পেপার অডিট ট্রেইল যুক্ত থাকতে হবে। এতে ভোটার দেখতে পারবেন, তার ভোটটি ঠিকমতো দেওয়া হয়েছে কি না। বিশ্বাসযোগ্যতার জন্য আমাদের ইভিএমে এটি যুক্ত করা উচিত। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার ঠিক হবে কি না, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে তার সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩৩০
আপনার মতামত জানানঃ