সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলো (এসএনএস) হলো মূলত ভার্চ্যুয়াল জগৎ যেখানে ব্যবহারকারীরা ব্যক্তিগত সর্বজনীন প্রোফাইল তৈরি করতে পারেন, বাস্তব জীবনের বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন এবং জ্ঞান বিতরণ হোক আর আহরণ হোক এমন স্বার্থের ভিত্তিতে অনেক কিছু অন্য লোকেদের সঙ্গে ভাগাভাগি বা শেয়ার করা।
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম হচ্ছে কম্পিউটার, স্মার্টফোন ও আইফোন। এ প্রযুক্তির মাধ্যমে যে কোনো ব্যক্তি তথ্য, মতামত, ছবি, ভিডিও ইত্যাদি আদান-প্রদান করতে পারে। এগুলো হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রাণ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অনলাইন সামাজিক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে সহায়তা করে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের থাকে অনেক উৎস ও অনেক প্রাপক। প্রথাগত প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মাধ্যমের থাকে একটি উৎস ও অনেক প্রাপক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া থেকে আলাদা।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মধ্যে রয়েছে- facebook, messanger, google, instagram, linkedln, pinterest, tumbler, snapchat, twitter, viber, wechat, whatsApp, youtube ইত্যাদি। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং অগ্রপথিক হচ্ছে facebook. 2004 সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মার্ক জাকারবার্গ ফেসবুক নামের নেটওয়ার্কটি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। প্রতিষ্ঠাকালে এটি শুধু ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সীমিত ছিল। পরে এ ওয়েবসাইটটি অন্যান্য অঞ্চল ও বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে সমগ্র বিশ্বে জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
সামাজিক মাধ্যম আমাদের নানাভাবে প্রভাবিত করে। সমষ্টিগতভাবে এর অনেক উপকারিতা কিংবা প্রয়োজনীয়তা থাকলেও ব্যক্তিগতভাবে তা আমাদের অনেক ক্ষতি করছে, যা অনেকটা স্লো পয়জনিং বা ধীর গতির বিষ প্রয়োগের মতো। দীর্ঘ সময় ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার কিশোর-কিশোরীদের মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
কানাডার টরোন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য বিষয়ক মনোবিজ্ঞানী জুডিথ অ্যান্ডারসন বলেছেন, ‘অত্যধিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের ফলে মানুষের মধ্যে সরাসরি কথা বলা বা যোগাযোগ করার প্রবণতা কমে গেছে, যা বিষণ্ণতা এবং উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে দেয়।
তিনি বলেন, ‘আমি ইদানীং কিশোর-কিশোরীদের সাথে ঘটছে এমন একটি অস্বস্তিকর বিষয় লক্ষ্য করেছি—তারা জানে না তারা কী করতে চায় বা কী করবে জীবনে। বিশ্বব্যাপী মহামারি ছড়িয়ে পড়ার একটি নেতিবাচক দিক এটি। লকডাউনের ফলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তারা বেশি সময় ব্যয় করেছে এবং এটি তাদের মনোজগতকে আরও সংকীর্ণ করে তুলেছে’।
‘অত্যধিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের ফলে মানুষের মধ্যে সরাসরি কথা বলা বা যোগাযোগ করার প্রবণতা কমে গেছে, যা বিষণ্ণতা এবং উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে দেয়।
অ্যান্ডারসন বলেন, অনলাইনে সামাজিক মাধ্যমের নিউজফিডে অনেক সময় ধরে চোখ বুলালে সেখানে থাকা মিথ্যা তথ্য থেকে বিভ্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বিশেষ করে, কিশোর বয়সে সহজেই যেকোনো কিছু বিশ্বাস করার মানসিকতা থাকে। দীর্ঘসময় ধরে স্ক্রোলিংয়ের ফলে মানসিক উদ্বেগ, পেশিতে টান, মাথা ব্যথা এবং মস্তিষ্কের ক্লান্তিও হতে পারে। এই বিষয়গুলো জৈবিক ও শারীরিক দিক থেকেও পরিমাপ করা যায়। এতে টিনএজারদের শারীরিক ও মানসিক শক্তি হ্রাস পায়, যা তাদের পড়াশুনা ও অন্যান্য কাজে ব্যাঘাত ঘটায় বলে গবেষকরা জানতে পেরেছেন।
এ বিষয়ে আগের গবেষণাগুলো অ্যান্ডারসনের দাবিকে সমর্থন করে। পিউ রিসার্চ ইনস্টিটিউটের একটি গবেষণার তথ্য অনুসারে, প্রায় ৪৫ শতাংশ কিশোর-কিশোরী অনলাইনে নিয়মিত বা দিনের বেশি সময় কাটিয়ে থাকে।
কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির অ্যানজাইটি অ্যান্ড রিলেটেড ডিসঅর্ডারস-এর ডিরেক্টর অ্যান মেরি অ্যালবানো বলেছেন, ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশি সময় কাটানো উদ্বিগ্নের বিষয়। কারণ হয়রানি শুধুমাত্র স্কুলের গেটের ভিতরেই সীমাবদ্ধ থাকে না। অনলাইনে হওয়া কোনো হয়রানির নির্ভরযোগ্য তথ্য বা প্রমাণ পাওয়া অনেক সময় কঠিন হয়ে দাঁড়ায়’।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট উপকমিটির ভোক্তা সুরক্ষা বিষয়ক প্রেসিডেন্ট- সেন রিচার্ড ব্লুমেনথাল টিনএজারদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ক্ষতিকর প্রভাবগুলিকে ‘আসক্তি’ বলে আগে একবার সতর্ক করেছিলেন। তিনি সে সময় বলেছিলেন, ইনস্টাগ্রাম এবং টিকটকের মতো অ্যাপগুলি বিশেষ অ্যালগরিদমের সাহায্যে তৈরি করা হয়েছে যা শিশুদের উদ্বেগ ও আসক্তি বাড়িয়ে তুলে তা থেকে ব্যবসায়িক লাভ করে থাকে।
সমস্যাটি সমাধানে অ্যান্ডারসন মনে করেন, প্রথম পদক্ষেপ হতে পারে অভিভাবকদের মধ্যে পরিবর্তন আনা। অভিভাবকদের আগে স্মার্টফোন ও অন্যান্য ডিভাইসের ব্যবহার কমাতে হবে। তাহলেই তারা তাদের সন্তানদের ক্ষেত্রে একই নিয়ম চালু করতে পারবেন। যেমন- কখন ও কতক্ষণ সময় তাদের সন্তানেরা সামাজিক মাধ্যমে বিচরণ করতে পারবে এবং খাবার সময় বা অন্য কাজের সময় সামাজিক মাধ্যম নিয়ে ব্যস্ত না থাকা ইত্যাদি।
তিনি আরও বলেন, মহামারি চলাকালীন পারিবারিক জীবনে নতুন নিয়ম তৈরি করে বাচ্চাদের ওপর সামাজিক মাধ্যমের ব্যবহার কমানোর পদক্ষেপ বেশ কঠিনই হবে। তবে এক্ষেত্রে ছোট থেকে শুরু করা যায়। এতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নেতিবাচক প্রভাব হ্রাস পাবে। আর সেজন্য কাউকে পুরো জীবনযাপন বদলে ফেলতেও হবে না।
তিনি বলেন, পিতামাতারা তাদের সন্তানদের সামাজিক মাধ্যমের অ্যালগরিদম কীভাবে কাজ করে সে বিষয়ে শিক্ষা দিতে পারেন। এই জ্ঞান থাকলে, তারা নেতিবাচক বিষয়ের পরিবর্তে ভালো বা ইতিবাচক বিষয়বস্তুকে অগ্রাধিকার দিতে পারে। উদাহরণস্বরূপ; টিকটক ও ইনস্টাগ্রাম ব্যবহারকারীদের তাই দেখায় যা তারা পোস্ট করে বা যে ধরনের পোস্টে যুক্ত হয়। সুতরাং, কেউ যদি ছোট কুকুরছানার ভিডিও বেশি দেখেন; তার টাইমলাইনেও এমন মজার ভিডিও ততো বেশি আসবে। এটা তার মধ্যে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। অন্যদিকে কেউ যদি নেতিবাচক ছবি বা ভিডিও বেশি দেখে, একইরকম কন্টেট ভবিষ্যতে তার টাইমলাইনে চলে আসে।
অ্যান্ডারসন বলেন, আপনি কি দেখছেন বিষয়টি তা নয়, আপনি কতক্ষণ এটি দেখছেন তার ওপরই এমনটি হয়ে থাকে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৩৮
আপনার মতামত জানানঃ