শরীরে গুড়ো মরিচ ছিটিয়ে নির্যাতন। এটা শারিরীক নির্যাতন। পরে বাথরুমে তালাবদ্ধ করে রাখা। এটা মানসিক নির্যাতন। কিশোর মেয়ে বয়স ১৩ থেকে পনেরো’র মধ্যেই হবে। ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে যাওয়াটা স্বাভাবিক। অথবা এই ধরণের পরিস্থিতির শিকার হয়ে সংজ্ঞাহীন হয়ে যাওয়ারই কথা।
গুড়ো মরিচ, দজি, চামুচ গরম করে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে ছ্যাকা দেয়ার ঘটনা তো আমাদের দেশে হরহামেশাই ঘটছে। দু’ মুঠো ডাল-ভাতের জন্য, মাসান্তে সামান্য ক’টা টাকা মা-বাবার কাছে পাঠানোর জন্যই এরা অন্যের ঘরে কাজ করতে আসে। আর বাকিটা ইতিহাস হয়ে থেকে যায়।
দেশে অব্যাহতভাবে গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ ও উৎকন্ঠা প্রকাশ করেছে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ)। সেইসাথে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছে সংস্থাটি।
দাবিটি তুলে ধরে গণমাধ্যমে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে এমজেএফ বলছে, সম্প্রতি নির্যাতনের শিকার হয়ে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের বেডে শুয়ে রয়েছে কিশোরী গৃহকর্মী ফারজানা। কিন্তু নির্মম নির্যাতনের সেই একমাত্র শিকার নয়, এরকম নির্যাতন ও নিপীড়ণের ঘটনা একের পর এক ঘটেই চলেছে।
‘আমরা লক্ষ্য করছি যে অপরাধীরা ধরা পড়লেও শাস্তি হচ্ছে না। ক্ষমতা খাটিয়ে বা আইনের ফাঁক গলে তারা বেরিয়ে আসছে। ফারজানাকে নিপীড়ণের অভিযোগে গ্রেপ্তারকৃত গৃহকত্রী সামিয়া ইউসুফেরও ইতোমধ্যে জামিন হয়েছে’।
বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র জানিয়েছে, ২০২১ সালে জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১১২ জন গৃহকর্মী ধর্ষণের পরে নিহত হয়েছেন। এদের ৫৭ জনের বয়স ১৩-১৮ বছর, ২৪ জনের বয়স ৭-১২ এবং ১২ জনের বয়স ৬- এর নীচে। রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে আরও ৫ শিশুর। এছাড়া অসংখ্য গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।
ফাউণ্ডেশন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি ২০১৫ আছে উল্লেখ করে বলেছে, তারা বহুদিন ধরে সরকারের সাথে এই নীতি প্রণয়নে কাজ করছে। সেই নীতিমালাতে গৃহকর্মীদের সাথে ভাল ব্যবহার, তাদের বেতনভাতা ঠিকমতো পরিশোধ, নির্যাতন না করা, শারীরিক ও মানসিক নিরাপত্তা বিধান, ভরণপোষণ, ছুটি ও প্রণোদনাসহ আরো সুবিধাদির কথা স্পষ্ট করে বলা আছে।
বর্তমান বাস্তবতায় এই নীতিমালা থেকে দ্রুত আইন প্রণয়নের জন্য দাবি জানিয়েছে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন।
গৃহকর্মীদের অধিকার নিশ্চিত ও নির্যাতন প্রতিরোধে সরকার ‘গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ’ নীতিমালা প্রণয়ন করলেও নেই এর বাস্তব প্রয়োগ। ৬ বছর থেকেই নীতিমালাটি আটকে আছে নীতির বৃত্তেই। নীতিমালাকে আইনে পরিণত করতেও নেই কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ। ফলে একদিকে যেমন গৃহকর্মীরা পেশা হিসেবে স্বীকৃতি পাচ্ছে না, অপরদিকে তারা নানাভাবে নির্যাতিত ও নিপীড়িত হলেও অধিকার ও সুবিচার পাচ্ছে না। কর্মস্থলে যেন ‘ক্রীতদাস’ হয়েই দিন কাটছে তাদের।
দেশে অব্যাহতভাবে গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ ও উৎকন্ঠা প্রকাশ করেছে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ)। সেইসাথে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছে সংস্থাটি।
মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, গৃহকর্মীর নির্যাতন প্রতিরোধে আইন না থাকায় একের পর এক গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনায় বিচারহীনতা, বেতন ঠিক না থাকা, ন্যূনতম অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে না পারার ঘটনা যেমন আছে, আইন না থাকায় তেমনই অনেক ক্ষেত্রে হেনস্তার শিকার হতে হয় গৃহকর্তাকেও।
গৃহকর্মীদের শ্রমকে ‘শ্রম’ হিসেবে ধরা হয়নি শ্রম আইনেও। শ্রমিক হিসেবে তাদের নেই কোনো আইনগত স্বীকৃতি। কাজের জন্য নির্ধারিত নেই কোনো কর্মঘণ্টা। নেই বেতন কাঠামো। সাপ্তাহিক ছুটি বা অবসর নেই। এমনকী ঘুমানোর কোনো নির্দিষ্ট স্থানও নেই। সামান্য ত্রুটিতে মারধর, ঠিকমতো খাবার না দেয়া, বেতন কম দেয়া, বাড়িত যেতে না দেয়ার অভিযোগ তো আছেই।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো তথ্য অনুসারে, প্রতিবছর গড়ে ৩০ জন গৃহকর্মী নির্যাতনের কারণে মারা যাচ্ছেন। বিভিন্নভাবে নির্যাতিত হচ্ছেন আরো হাজার হাজার কর্মী। নির্যাতনের প্রায় ৯০ ভাগ ঘটনাই নানাভাবে চাপা পড়ে যায়। হত্যাকাণ্ড ঘটলে বা মুমূর্ষু অবস্থায় কোনো গৃহকর্মী হাসপাতালে ভর্তি হলেই কেবল তা প্রকাশ পায়। অপরদিকে কোনো কোনো ঘটনায় নির্যাতনকারীদের গ্রেফতার করা হলেও তারা বের হয়ে যান আইনের ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে।
বিলসের তথ্যমতে, ঢাকাসহ সারা দেশে যারা গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করেন তাদের ৯৫ ভাগেরও বেশি নারী। তাদের মধ্যে যারা হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণের শিকার হয়েছেন তাদের অধিকাংশেরই বয়স ১০ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে। তাদের জরিপ অনুযায়ী, গত বছরের প্রথম ৬ মাসে (জানুয়ারি-জুন) মোট ২২ জন গৃহকর্মী নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে মারা গেছেন ৮ জন। ৩ জন হত্যাকাণ্ডের শিকার এবং ৫ জনের রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে। আত্মহত্যা করেছেন ২ জন। ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৩ জন আর শারীরিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন ১২ জন। অজ্ঞাতনামা আরো ১ জন তীব্র মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
সংস্থাটি আরো বলছে, ২০১১ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত হতাহত হয়েছেন ৫৯১ জন গৃহশ্রমিক। তাদের মধ্যে হত্যার শিকার হয়েছেন ২৮৪ জন, আত্মহত্যা করেছেন ১২ জন, নিখোঁজ হয়েছেন ২ জন। বাকিরা নির্যাতিত হয়ে গুরুতর আহত হয়েছেন।
আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর তথ্যমতে, গত বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে ৩৮ জন নারী গৃহকর্মী সহিংসতার শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে ১২ জন নিহত আর ৩ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এর আগে ২০২০ সালে সহিংসতার শিকার হয়েছেন ৪৫ জন। এর মধ্যে ১৩ জন হত্যার শিকার ও ৮ জন ধর্ষিত হয়েছেন। ২০১৯ সালে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে ৩৪টি। হত্যার শিকার ১০ জন, ধর্ষণের শিকার ১২ জন।
বিশ্লেষকরা বলেন, গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনায় মামলা দায়ের করা হলেও অধিকাংশ মামলার রায় হওয়ার আগে আপস মীমাংসা হয়ে যায়। কারণ গৃহকর্মীদের বেশিরভাগই নিম্নবৃত্ত পরিবারের সন্তান। তাদের বাবা-মায়েরা অনেক সময় মামলার খরচ চালাতে ব্যর্থ হয়ে কিংবা প্রভাবশালীদের চাপে পড়ে আপসে চলে যান। অপরাধীরা পার পেয়ে যাক তা আমরা চাই না। এসব ঘটনায় কিছু দৃষ্টান্তমূলক রায় হলে অপরাধ অনেকটা কমে যেত।
তারা বলেন, আমাদের গৃহকর্মী নির্যাতন প্রতিরোধে ‘সুরক্ষা ও কল্যাণ’ নীতিমালা আছে। কিন্তু নানা কারণে এর পুরোপুরি বাস্তবায়ন হচ্ছে না। নীতিমালা পুরোপুরি বাস্তবায়ন হলে অপরাধটা অনেক কমে যেত।
আরও বলেন, গৃহকর্মীরা নির্যাতিত হলে কিন্তু নারী শিশু নির্যাতন আইনসহ বিভিন্ন আইনে মামলা করে বিচার চাইতে পারেন। তবে তাদের বেতনের নিশ্চয়তাসহ সকল অধিকার নিশ্চিতের জন্য একটি আলাদা আইন দরকার। তবে শুধু আইন করলেই চলবে না; যথাযথভাবে তা বাস্তবায়ন করতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০২৭
আপনার মতামত জানানঃ