বায়ুদূষণের দিক থেকে গত তিন বছরের মতো এবারও বিশ্বের শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। রাজধানী ঢাকাও বিশ্বের দূষিত বায়ুর শহরগুলোর মধ্যে বরাবরের মতোই শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে। বৈশ্বিক বায়ুমান পর্যবেক্ষক প্রতিষ্ঠান আইকিউ এয়ারের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত শুক্রবার বিশ্বের ১০০টি বড় শহরের মধ্যে বায়ুদূষণের দিক থেকে ঢাকা ছিল শীর্ষে। আর্থসামাজিক নানা উন্নয়নে বাংলাদেশের সাফল্য বৈশ্বিক পরিসংখ্যান ও গবেষণাগুলোতে উঠে আসছে, সেখানে বায়ুদূষণে ঢাকার এমন অবস্থান আমাদের জন্য উদ্বেগ তৈরি করে।
আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনগুলো বলছে, বিশ্বের যে পাঁচটি দেশের শতভাগ মানুষ দূষিত বায়ুর মধ্যে বসবাস করে, বাংলাদেশ সেগুলোর অন্যতম। গত বছর ঢাকার বায়ু ৩৬৫ দিনের মধ্যে ২০০ দিনের চেয়েও বেশি সময়জুড়ে অনিরাপদ বা অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় ছিল। এটা ২০১৮ সাল পর্যন্ত ছিল ১২০ থেকে ১৩০ দিন। এতেই বোঝা যাচ্ছে, ঢাকার বায়ুর মান দিন দিন কেমন অবনতি হচ্ছে। ভয়াবহ বায়ুদূষণের শহর দিল্লিকেও প্রায় সময় ছাড়িয়ে যাচ্ছে এ শহর।
একিউআই অনুযায়ী, শুক্রবার সকালে ঢাকায় বায়ুদূষণের মাত্রা ছিল ২৮৯। এ সময় দিল্লির বায়ুদূষণের মাত্রা ছিল ১৯৬। বায়ুমানের সূচক ২০০ অতিক্রম করলে একে ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’ বলে ধরা হয়। গত শুক্রবার পর্যন্ত টানা তিন দিন সেই মাত্রা অতিক্রম করে আরও বহুদূর চলে গেছে ঢাকা।
জাতিসংঘের তথ্যমতে, বিশ্বব্যাপী প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৯ জন দূষিত বাতাসে শ্বাস নেন এবং বায়ুদূষণের কারণে প্রতিবছর প্রধানত নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশে আনুমানিক ৭০ লাখ মানুষের অকালমৃত্যু ঘটে।
বায়ুদূষণ যে ঢাকার বাসিন্দাদের আয়ু কতটা কমিয়ে দিচ্ছে, সেটি আমরা দেখতে পাই সম্প্রতি শিকাগো ইউনিভার্সিটির এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউটের একটি প্রতিবেদনে। সেখানকার ‘এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স’–এর তথ্যমতে, ঢাকায় বায়ুদূষণ না থাকলে মানুষ আরও প্রায় সাত বছর সাত মাস বেশি বাঁচতে পারত। এ ছাড়া একই কারণে সারা দেশে মানুষের গড় আয়ু কমেছে প্রায় পাঁচ বছর চার মাস। আরেকটি গবেষণায় আমরা জানতে পারছি, বায়ুদূষণের ক্ষতিকর প্রভাবের ফলে মৃত্যুর সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ পঞ্চম। ২০১৭ সালে বাংলাদেশে ১ লাখ ২৩ হাজার মানুষ বায়ুদূষণের কারণে মারা গেছে।
একটা সময় ঢাকার বায়ুদূষণের জন্য দায়ী করা হতো ইটভাটার ধোঁয়াকে। সেই জায়গা পরে দখল করে নেয় মোটরযান ও শিল্পকলকারখানার ধোঁয়া। এখন কয়েক বছর ধরে বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প ও ছোট–বড় আবাসন প্রকল্পের উন্মুক্ত পরিবেশে অনিয়ন্ত্রিতভাবে নির্মাণযজ্ঞ বাড়িয়েছে ধুলাদূষণ। ফলে কোথাও কোথাও স্বাভাবিকের তুলনায় ১০ গুণ বেশি ধুলার সৃষ্টি হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে গত বছর পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বায়ুদূষণ রোধে যে নির্দেশিকা দিয়েছিল, সেটির তেমন বাস্তবায়ন দেখা যায়নি। নির্দেশিকায় রাস্তা নির্মাণের সময় নির্মাণসামগ্রী ঢেকে রাখা, বিটুমিনের ওপর বালু না ছিটিয়ে মিনি অ্যাসফল্ট প্ল্যান্টের মতো উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার, রাস্তার পাশের মাটি কংক্রিট বা ঘাসে ঢেকে দেওয়া, রাস্তা পরিষ্কারের ঝাড়ুর পরিবর্তে ভ্যাকুয়াম সুইপিং ট্রাক ব্যবহার, বড় সড়কে কমপক্ষে দুবার পানি ছিটানোর কথা বলা হয়েছিল। এর কোনোটি কার্যকর করার উদ্যোগ লক্ষ করা যায়নি। এর আগেও এমন নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল, তখনো সে অনুযায়ী কিছু হয়নি।
ঢাকা দীর্ঘদিন ধরে বায়ু দূষণে ভুগছে। এর বাতাসের গুণমান সাধারণত শীতকালে অস্বাস্থ্যকর হয়ে যায় এবং বর্ষাকালে কিছুটা উন্নত হয়।
২০১৯ সালের মার্চ মাসে পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ঢাকার বায়ু দূষণের ৩টি প্রধান উৎস হল, ইটভাটা, যানবাহনের ধোঁয়া ও নির্মাণ সাইটের ধুলো।
শীতের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে নির্মাণ কাজ, রাস্তার ধুলা ও অন্যান্য উৎস থেকে দূষিত কণার ব্যাপক নিঃসরণের কারণে শহরের বাতাসের গুণমান দ্রুত খারাপ হতে শুরু করে।
বেশ কয়েকটি গবেষণা অনুসারে, বায়ু দূষণ ক্রমাগত বিশ্বব্যাপী মৃত্যু ও অক্ষমতার জন্য ঝুঁকির কারণগুলোর মধ্যে একটি। দীর্ঘদিন দূষিত বায়ুতে শ্বাস নেওয়ার ফলে একজন ব্যক্তি হৃদরোগ, শ্বাসযন্ত্রের রোগ, ফুসফুসের সংক্রমণ ও ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বিশ্বের যে পাঁচটি দেশের শতভাগ মানুষ দূষিত বায়ুর মধ্যে বসবাস করে, বাংলাদেশ সেগুলোর অন্যতম। গত বছর ঢাকার বায়ু ৩৬৫ দিনের মধ্যে ২০০ দিনের চেয়েও বেশি সময়জুড়ে অনিরাপদ বা অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় ছিল। এটা ২০১৮ সাল পর্যন্ত ছিল ১২০ থেকে ১৩০ দিন। এতেই বোঝা যাচ্ছে, ঢাকার বায়ুর মান দিন দিন কেমন অবনতি হচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতে, বায়ু দূষণে বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর মূলত স্ট্রোক, হৃদরোগ, দীর্ঘস্থায়ী বাধা পালমোনারি রোগ, ফুসফুসের ক্যান্সার ও তীব্র শ্বাসকষ্ট সংক্রমণের ফলে আনুমানিক ৭০ হাজার মানুষের মৃত্যু হচ্ছে।
রাজধানী ঢাকার বায়ু দূষণের মাত্রা বিপজ্জনক পর্যায়ে অবস্থান করছে। বিশ্বে শীর্ষ দূষিত কয়েকটি শহরের অন্যতম ঢাকার মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর সর্বাধিক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। মানুষের গড় আয়ু কমছে দীর্ঘমেয়াদী বায়ু দূষণের কারণে।
বায়ু দূষণের কারণে বাংলাদেশে মানুষের গড় আয়ু কমেছে প্রায় পাঁচ বছর চার মাস এবং ঢাকায় কমেছে প্রায় সাত বছর সাত মাস। এমনটা দাবি করেছে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো।
ঢাকার রাস্তায় চলাচলকারী অতিরিক্ত যানবাহন যানজট সৃষ্টির পাশাপাশি রাজধানীর বায়ুদূষণেও অন্যতম ভূমিকা পালন করছে বলেও উল্লেখ করেন পরিবেশবাদীরা। ঢাকা শহরে প্রতিদিন গড়ে প্রায় তিন লাখ যান্ত্রিক যানবাহন চলাচল করে। নগরীতে চলাচলকারী গণপরিবহনের প্রায় সবগুলো বাস-মিনিবাস, প্রাইভেটকার, সিএনজি অটোরিকশা, টেম্পোসহ গাড়িগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে পড়েছে। ফিটনেসবিহীন এসব গাড়ি থেকে নির্গত ধোঁয়া বায়ুদূষণের জন্য দায়ী।
এদিকে সাম্প্রতিক একটি গবেষণা জানিয়েছে, বায়ুদূষণের ফলে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমাদের হৃৎপিণ্ড, বেড়ে যাচ্ছে উচ্চ রক্তচাপের মতো রোগ। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কিডনির নানা জটিল অসুখও।
গবেষকরা দেখেছেন, দীর্ঘদিন ধরে কিডনির অসুখে ভুগছেন এমন প্রাপ্তবয়স্কদের উচ্চ রক্তচাপের সঙ্গে সঙ্গে গ্যালেক্টিন প্রোটিনের পরিমাণও বেড়ে যাচ্ছে বায়ুদূষণের মাত্রাবৃদ্ধির কারণে। এই গ্যালেক্টিন প্রোটিনের পরিমাণ দেহে বাড়লেই হৃৎপিণ্ডে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়। আর সেই ক্ষত কিছুতেই সারিয়ে তোলা সম্ভব হয় না। চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষায় যার নাম ‘মায়োকার্ডিয়াল ফাইব্রোসিস’।
গবেষকরা দেখেছেন, বাতাসে বিশেষ ধরনের দূষণ কণার (পার্টিকুলেট ম্যাটার ২.৫) পরিমাণ বাড়লেই এটা হচ্ছে। সেই কণা বাতাসে কম থাকলে বা একেবারে না থাকলে কিডনি, হৃৎপিণ্ডের ততটা ক্ষতি হচ্ছে না। খুব ক্ষতি হচ্ছে কিডনিরও। গবেষকরা দুবছর ধরে প্রায় দেড় হাজার রোগীর উপর ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালিয়ে এই ঘটনা ঘটতে দেখেছেন।
নগর সভ্যতার ডামাডোলে গোটা বিশ্ব এমন এক অবস্থায় এসে পৌঁছেছে যেখানে প্রাণ ধারণের জন্য ন্যূনতম বিশুদ্ধ আলো, বাতাস ও পানির মতো প্রকৃতির অফুরান দানগুলো অবশিষ্ট থাকার সুযোগ নেই। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে নানা বিরূপ প্রভাবসহ মানবসৃষ্ট পরিবেশ দূষণের কবলে পড়ে ক্রমেই হুমকির মুখে এগিয়ে চলছে জনজীবন। অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও দ্রুত শিল্পায়নের এই অশুভ প্রতিযোগিতার করাল গ্রাসে পড়ে প্রাকৃতিক পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে, লাগামহীনভাবে বেড়ে চলছে দূষণ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নগরবাসীর কাছে যানজটের পাশাপাশি আরেক যন্ত্রণার নাম বায়ুদূষণ। মাত্রাতিরিক্ত দূষণের কবলে নগরজীবন বিভীষিকাময় হয়ে উঠেছে। বাড়িয়ে তুলছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে শিশু, বৃদ্ধ ও শ্বাসতন্ত্রের রোগীরা।
প্রতিনিয়ত বায়ুদূষণে ফুসফুসের অক্সিজেন গ্রহণক্ষমতা কমে শ্বাসকষ্ট ক্রমাগত বাড়ে বলে জানান সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, প্রথমে শ্বাসনালি ও চোখে সমস্যা তৈরি করে। ফলে অ্যাজমা ও নিউমোনিয়ার রোগীর সংখ্যা বেড়ে চলেছে বলে উল্লেখ করেন। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদে এ দূষিত বায়ু গ্রহণ ব্রঙ্কাইটিস থেকে ফুসফুস ক্যান্সারের কারণ হতে পারে বলে উল্লেখ করেন। এদিকে বায়ুদূষণের কারণে ক্রনিক অবস্ট্রাক্টিভ পালমোনারি ডিজিজ (সিওপিডি) বেশি দেখা দেয় বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।
এ জন্য বায়ুদূষণের সঙ্গে মানুষের গড় আয়ুর বিষয়টি জড়িত। আমাদের গড় আয়ু বেড়েছে কিন্তু সেটা কতটা মানসম্মত সেটাও খতিয়ে দেখা উচিত। আমাদের জীবদ্দশায় কতটা সময় হাসপাতালে কাটাতে হয়, সেটাও হিসাব করা উচিত বলে জানান তারা।
নির্মল বায়ুর জন্য স্থায়ী কোনো নীতি যেটি জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমাতে পারে, সেটা গড় আয়ু বাড়ানোর পাশাপাশি জলবায়ুর ইতিবাচক পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। তারা এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে চীনকে উল্লেখ করে বলেছেন, ২০১১ সালের তারা যে নীতি গ্রহণ করেছে, তাতে তাদের গড় আয়ু বেড়েছে ২.৬ বছর।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ছয় ধরনের পদার্থ এবং গ্যাসের কারণে ঢাকায় দূষণের মাত্রা সম্প্রতি অনেক বেড়ে গেছে। এরমধ্যে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ধূলিকণা অর্থাৎ পিএম ২ দশমিক ৫-এর কারণেই ঢাকায় দূষণ অতিমাত্রায় বেড়ে গেলেই পরিস্থিতি নাজুক হয়ে উঠছে। ঢাকার বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে গর্ভবতীদের বিরাট স্বাস্থ্য ঝুকির মধ্যে থাকতে হয়। অতিমাত্রায় বায়ুদূষণের কারণে অনেকক্ষেত্রে বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকার যানবাহনের ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণের কাজটি মূলত সরকারি সংস্থাগুলোর। আর ধোঁয়া ও ধুলা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও সিটি করপোরেশনগুলো থেকে নিয়মিত তদারকি এবং রাস্তায় পানি ছিটানোর কাজ করলেই পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব। কিন্তু এ নিয়মিত কাজটিও ঠিকমতো না করায় বায়ুদূষণ পরিস্থিতির বেশি অবনতি হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে ঢাকার পরিবেশ সুরক্ষায় সরকারের সংস্থাগুলোর সমন্বিত কার্যক্রমের বিকল্প নেই। এ জন্য সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে কার্যকর ভূমিকা রাখা প্রয়োজন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৪২
আপনার মতামত জানানঃ