বাংলাদেশ এবং দুর্নীতি; যেন একে অন্যের পরিপূরক। বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে ‘সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত’ দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৩তম বলে জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই)। যা গতবার ছিল ১২তম।
অবশ্য দুর্নীতির এই সূচকের মৌলিক বিষয়, অর্থাৎ স্কোরের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কোনো অগ্রগতি নেই। ১০০–এর মধ্যে বাংলাদেশের স্কোর ২৬, যা গতবারও একই ছিল। এমনকি চার বছর ধরে স্কোরটি একই আছে।
তবে দক্ষিণ এশিয়ার দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় বাংলাদেশ। একমাত্র আফগানিস্তানই রয়েছে বাংলাদেশের নিচে।
বার্লিনভিত্তিক দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) পরিচালিত ‘দুর্নীতির ধারণা সূচক ২০২১’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনটি আজ মঙ্গলবার প্রকাশ করা হয়েছে।
তবে বিপরীত দিক দিয়ে, অর্থাৎ সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৮০ দেশের মধ্য এক ধাপ পিছিয়ে হয়েছে ১৪৭তম। গতবার ছিল ১৪৬তম।
বাংলাদেশে এক ভার্চ্যুয়াল সংবাদ সম্মেলনে দুর্নীতির এই ধারণা সূচকের বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। তিনি এসব তথ্য তুলে ধরেন বলেন, বাংলাদেশের অবস্থান হতাশাজনক। কারণ, ১০ বছর ধরে প্রবণতা হলো স্কোরটি এক জায়গায় স্থবির হয়ে আছে।
ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা দেখানোর রাজনৈতিক অঙ্গীকার থাকলেও সেটি ঠিকমতো কার্যকর হচ্ছে না। কারণ, যাদের হাতে এই দায়িত্ব, তাদের একাংশই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত।
অবশ্য দুর্নীতির এই সূচকের মৌলিক বিষয়, অর্থাৎ স্কোরের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কোনো অগ্রগতি নেই। ১০০–এর মধ্যে বাংলাদেশের স্কোর ২৬, যা গতবারও একই ছিল। এমনকি চার বছর ধরে স্কোরটি একই আছে।
২০২১ সালের পরিস্থিতি বিবেচনায় এবার সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকার যৌথভাবে শীর্ষে রয়েছে ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ড। দুর্নীতির ধারণা সূচকের (সিপিআই) ১০০ স্কোরের মধ্যে এই তিনটি দেশ পেয়েছে ৮৮ করে।
কম দুর্নীতিগ্রস্থ ১০টি দেশের তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে নরওয়ে, সিঙ্গাপুর ও সুইডেন; এই তিনটি দেশেরই স্কোর ৮৫। আর ৮৪ স্কোর নিয়ে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে সুইজারল্যান্ড।
এরপর চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে নেদারল্যান্ড (স্কোর ৮২), পঞ্চম লুক্সেমবার্গ (৮১), ষষ্ঠ জার্মানি (স্কোর ৮০), সপ্তম যুক্তরাজ্য (স্কোর ৭৮) ও অষ্টম স্থানে রয়েছে হংকং (৭৬)।
৭৪ স্কোর নিয়ে যৌথভাবে নবম স্থানে আছে কানাডা, আয়ারল্যান্ড, এস্তোনিয়া ও অস্ট্রিয়া। যৌথভাবে দশম স্থানে আছে ৭৩ স্কোর নিয়ে অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম, জাপান ও উরুগুয়ে।
তালিকাটির একদম নিচে বা ‘সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত’ দেশ দক্ষিণ সুদান। দেশটির স্কোর ১১। এর পরে রয়েছে সিরিয়া ও সোমালিয়া। তাদের স্কোর ১৩। এছাড়া ১৪ স্কোর নিয়ে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে ভেনেজুয়েলা। মূলত এদিক থেকেই ১৩তম বাংলাদেশ। তবে দক্ষিণ এশিয়ার দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় বাংলাদেশ। একমাত্র আফগানিস্তানই রয়েছে বাংলাদেশের নিচে। তবে দেশটির স্কোর ১৬, যা বাংলাদেশের চেয়ে বেশ কম।
পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তান ও মিয়ানমারের স্কোর রয়েছে ২৮। তবে ভারতের স্কোর ৪০। এদিকে একই স্কোর নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে রয়েছে মাদাগাস্কার ও মোজাম্বিক।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দুর্নীতিবিরোধী সাফল্য সন্তোষজনক না হওয়ার একটা বড় কারণ হল প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি এখন পর্যন্ত কার্যকরভাবে প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়নি। বিশেষ করে ব্যাংকিং খাতে হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে। বেসিক ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংকে বিগত বছরগুলোয় হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির খবর বেরিয়েছে। এসব দুর্নীতির সঙ্গে সমাজের উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিদের যোগসাজশের খবর গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রযন্ত্রের কার্যকর কোনো ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান নয়। যদিও দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলায় সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর কিছু কর্মকর্তা এখন জেলে আছেন, কিন্তু প্রকৃত দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে শুধু আদেশ তামিলকারী কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ দুর্নীতি প্রতিরোধে তেমন ভূমিকা রাখবে বলে মনে হয় না। দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত রাঘববোয়ালদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করে কার্যকরভাবে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হলেই কেবল প্রকৃত অর্থে দুর্নীতিবিরোধী বড় অগ্রগতি অর্জন হবে। এ জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনকে শক্তিশালী করা ও স্বাধীন ভূমিকা রাখার সুযোগ দেয়ার পাশাপাশি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্নীতি প্রতিরোধের ব্যবস্থা কার্যকর করতে হবে।
তারা বলেন, ব্যাংক খাতের দুর্নীতি রোধে বাংলাদেশ ব্যাংকের গোয়েন্দা ইউনিটকে আরও শক্তিশালী করার পাশাপাশি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ প্রদানের প্রবণতা বন্ধ করতে হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারকে শুধু বক্তব্য-বিবৃতি দেয়া নয়, আপসহীন ও জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে হবে। যে কোনো মূল্যে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। সব ধরনের দুর্নীতিবাজের জন্য আইনের সমান প্রয়োগ নিশ্চিত করার পাশাপাশি দুর্নীতিবিরোধী সচেতনতা বাড়াতে হবে। অবশ্য এসব ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা একান্তভাবে জরুরি। সরকারের তথা রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছা ছাড়া দুর্নীতি বন্ধ করা সহজ নয়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৪৫
আপনার মতামত জানানঃ