করোনাভাইরাসের নতুন ধরন অমিক্রনের প্রভাবে সারা বিশ্বে নতুন করে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার কারণে অর্থনীতিতে আবারও কিছুটা স্থবিরতা তৈরি হয়েছে। অনেক জায়গায় লকডাউন ও বিধিনিষেধের কারণে এমনটা ঘটছে। এই বাস্তবতায় চলতি বছর বৈশ্বিক শ্রম সময় কমবে বলেই শঙ্কা আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও)। অর্থাৎ এ বছরও শ্রমবাজার মহামারির আগের ধারায় ফিরতে পারবে না।
আইএলওর ‘বিশ্ব কর্মসংস্থান ও সামাজিক পূর্বাভাস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ সালে মহামারি শুরুর সময়ের তুলনায় পৃথিবী অনেকটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে, কিন্তু ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২২ সালেও পিছিয়ে থাকবে অর্থনীতি। আর তাতে কর্মঘণ্টা কমবে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) তথ্যানুসারে, ২০২২ সালে বৈশ্বিক কর্মসময় ২০১৯ সালের তুলনায় ২ শতাংশ কম থাকবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই ২ শতাংশের প্রকৃত পরিমাণ নিছক কম নয়—৫ কোটি ২০ লাখ পূর্ণকালীন কাজের সমপরিমাণ কর্ম সময়। অথচ গত বছরের মে মাসেও আইএলওর পূর্বাভাসে বলা হয়েছিল, কর্মসময় নষ্টের পরিমাণ দাঁড়াবে এর অর্ধেক।
শ্রমসময় কমে যাওয়ার অর্থ হলো বেকারত্বের হারও বেড়ে যাওয়া। প্রতিবেদনের তথ্যানুসারে, ২০২২ সালে বৈশ্বিক বেকারত্বের হার দাঁড়াবে ২০ কোটি ৭০ লাখ, ২০১৯ সালে যা ছিল আরও ২ কোটি ১০ লাখ কম।
এই সংখ্যাটা কম মনে হচ্ছে। সে জন্যই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেকারের সংখ্যা দিয়ে সংকটের পুরোটা বোঝা যাবে না। বিষয়টি হলো, মহামারির শুরু থেকেই কয়েক কোটি মানুষ কাজের বাজার থেকে ঝরে গেছে। এই মানুষদের অনেকেই এখনো বেকার থাকলেও তাঁদের নাম বেকারত্বের তালিকায় ওঠেনি। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২২ সালে চার কোটি মানুষ শ্রমবাজারে আর থাকবেই না।
সে কারণে আইএলওর পূর্বাভাস তেমন একটা শক্তিশালী নয়, কারণ, মহামারির পথপরিক্রমায় একধরনের অনিশ্চয়তা আছে।
অতিমারির ফলে প্রায় প্রতিটি দেশে লকডাউন হয়েছে। অর্থনীতিতে তার প্রভাব পড়েছে। প্রচুর মানুষ চাকরি হারিয়েছেন। বহু মানুষ গরিব হয়েছেন। গরিব আরও গরিব হয়েছে। অন্যদিকে বিশ্বে অতিধনীর সংখ্যা বেড়েছে।
করোনাভাইরাসের কারণে সারাবিশ্বের অর্থনীতিতে যখন বিপর্যয়কর অবস্থায় তখন ঠিকই নিজেদের সম্পদ বাড়িয়ে নিয়েছেন বিশ্বের শীর্ষ ১০ ধনী। এর বিপরীতে দারিদ্র্য ও অসমতা বেড়েছে। সোমবার (১৭ জানুয়ারি) আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা অক্সফাম জানিয়েছে।
দারিদ্র্য বিমোচনে কাজ করা এই প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে আরও বলা হয়েছে, এই মহামারিকালে যে পরিমাণ সম্পদ ধনীদের বেড়েছে, গত ১৪ বছরে সেই পরিমাণ সম্পদ বাড়েনি। কিন্তু এমন সময়ে সম্পদ বাড়ছে, যখন বিশ্ব অর্থনীতি সংকটের মুখে রয়েছে।
এই অর্থনৈতিক অসমতার কারণে বিভিন্ন ধরনের সংকট দেখা দিয়েছে। এর কারণে স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছেন না দারিদ্ররা। ক্ষুধা, লিঙ্গবৈষম্যগত সহিংসতা বেড়েছে। অক্সফাম বলছে, আর্থিক অসমতার কারণে স্বাস্থ্যসেবা সংকট, ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও জলবায়ু পরিবর্তনে প্রভাব পড়ছে। এতে প্রতিদিন ২১ হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে।
প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে আরও বলা হয়েছে, মহামারির কারণে ১৬ কোটি মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে। অসমতা বেড়ে যাওয়ায় সবচেয়ে বেশি ভুগছে অশ্বেতাঙ্গ সংখ্যালঘু জাতিসত্তার মানুষ ও নারীরা।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, করোনা প্রতিরোধে বিধিনিষেধ চলাকালে বিশ্ব অর্থনীতিতে অতিধনীদের সম্পদ ফুলে–ফেঁপে উঠেছে, বিশেষ করে যারা অনলাইনভিত্তিক ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে জড়িত। বৈশ্বিক পুনরুদ্ধারের গতি জোরদার হওয়ার সুবাদে আর্থিক বাজারগুলোয় চাঙাভাব দেখা দেওয়ার কারণে অন্যদের সম্পদ বেড়েছে।
২০২০ সালে মহামারি শুরুর সময়ের তুলনায় পৃথিবী অনেকটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে, কিন্তু ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২২ সালেও পিছিয়ে থাকবে অর্থনীতি। আর তাতে কর্মঘণ্টা কমবে।
এদিকে চলতি বছর বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান সমস্যা হবে কর্মসংস্থান ও জীবিকার সংকট। এ ছাড়া পরিবেশ বিপর্যয়, সাইবার দুর্বলতা, ডিজিটাল বৈষম্যও অর্থনীতির ঝুঁকির তালিকায় থাকছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের বৈশ্বিক ঝুঁকি প্রতিবেদন-২০২২ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব ঝুঁকির কথা উঠে এসেছে। এই সংকটের কারণে প্রবৃদ্ধি আরও বেশি অসম হয়ে ওঠে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদেরা।
কর্মসংস্থান ও জীবিকার পাশাপাশি বাংলাদেশের জন্য আরেকটি বড় ঝুঁকি চিহ্নিত করা হয়েছে প্রতিবেদনে। সেটা হলো দেশের কৌশলগত সম্পদের ভূরাজনীতিকীকরণ। বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত কিছু বলা না হলেও এটা স্পষ্ট যে দেশের বিভিন্ন কৌশলগত স্থানে স্থাপনা নির্মাণে এশিয়ার বৃহৎ দুটি দেশের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ চলছে, তার দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। এই প্রতিযোগিতার সুবিধা হচ্ছে, বাংলাদেশ এখন বড় প্রকল্পে সহজেই বিনিয়োগ পাচ্ছে। কিন্তু এই পরিস্থিতি দীর্ঘদিন চললে উন্নয়নের পরিবেশ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কাও থাকে।
মহামারির শুরু থেকেই সরবরাহ–সংকট বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২০ সালের তুলনায় পণ্যমূল্য ৩০ শতাংশ বেড়েছে। জ্বালানি–সংকট নিয়ে ইউরোপ, রাশিয়া ও চীনের দ্বন্দ্বের কারণে পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে। তবে এখন সারা বিশ্বে যে উচ্চ মূল্যস্ফীতি দেখা যাচ্ছে, তার প্রধান কারণ সরবরাহ–সংকট। অর্থাৎ এই মূল্যস্ফীতি চাহিদাজনিত নয়, বরং সরবরাহজনিত। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরবরাহ–সংকট ২০২২ সালেও চলবে। অর্থাৎ আইএমএফসহ অন্যান্য বৈশ্বিক সংস্থা যে বলে আসছিল, এ বছরের মাঝামাঝি নাগাদ মূল্যস্ফীতি কমে আসবে, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম তা মনে করছে না।
মহামারির কারণে অধিকাংশ দেশেরই রাজস্ব আয় কমেছে। উন্নত দেশগুলো অনেক প্রণোদনা দিয়েছে। ২০২০ সালে বিভিন্ন দেশের সরকারি ঋণ ১৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে জিডিপির ৯৭ শতাংশে উঠেছে। এতে ডলারের সাপেক্ষে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মুদ্রার অবনমন হতে পারে। জরিপে অংশগ্রহণকারীরা আগামী এক দশকের জন্য ঋণবৃদ্ধিকে গুরুতর সংকট হিসেব চিহ্নিত করেছেন। তবে বাংলাদেশ সরকারের ঋণ এখনো খুব বেশি নয়।
প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অন্যান্য যেসব ঝুঁকি চিহ্নিত করা হয়েছে, সেগুলো হলো পরিবেশ বিপর্যয়, সাইবার দুর্বলতা, ডিজিটাল অসমতা ইত্যাদি। বিশ্বের প্রায় এক হাজার বিশেষজ্ঞ ও বিভিন্ন খাতের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে এই জরিপ করা হয়েছে।
বৈশ্বিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ সালের তুলনায় পণ্যমূল্য এখন ৩০ শতাংশ বেড়েছে। জ্বালানি সংকট নিয়ে ইউরোপ, রাশিয়া ও চীনের দ্বন্দ্বের কারণে পরিস্থিতির আরো অবনতি হতে পারে। তবে এখন সারা বিশ্বে যে উচ্চ মূল্যস্ফীতি দেখা যাচ্ছে, তার প্রধান কারণ সরবরাহ সংকট। অর্থাৎ এই মূল্যস্ফীতি চাহিদাজনিত নয়, বরং সরবরাহজনিত।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সরবরাহ সংকট ২০২২ সালেও চলবে। আইএমএফসহ অন্যান্য বৈশ্বিক সংস্থা এ বছরের মাঝামাঝি মূল্যস্ফীতি কমে আসবে বলে পূর্বাভাস দিলেও সংস্থাটি সেটি মনে করছে না।
বিশ্লেষকরা বলেন, ‘দেশে কর্মসংস্থানবিহীন প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। এ রকম প্রবৃদ্ধি আরো বৈষম্য সৃষ্টি করবে। বৈষম্য থাকলে সমাজ টেকসই হয় না। জনগোষ্ঠীর বিরাট একটি অংশ চাকরির বাজারের বাইরে থাকলে তাদের অবদান থেকে সমাজ বঞ্চিত হয়। শুধু তারাই নয়, অর্থনীতিও বঞ্চিত হয়। কোনো না কোনো সময় গিয়ে সেই প্রবৃদ্ধি আর ধরে রাখা সম্ভব হয় না।’
ডিজিটাল বৈষম্যও বাড়ছে উল্লেখ করে তারা বলেন, যারা উচ্চ আয়ের মানুষ তারাই বেশি ডিজিটাল সুবিধা পাচ্ছে। সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের স্বার্থে সামগ্রিক ডিজিটাল বৈষম্য কমানোর ক্ষেত্রে নজর দিতে হবে।
তারা বলেন, ‘ডিজিটাল প্রযুক্তির যত প্রসার ঘটছে, বৈষম্যও তত বাড়ছে। যেকোনো প্রযুক্তির বিকাশের প্রথম পর্যায়ে এই বৈষম্য থাকবে। কিন্তু ডিজিটাল বৈষম্য কমানোর কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৫৫
আপনার মতামত জানানঃ