দীর্ঘ হচ্ছে বেওয়ারিশ লাশের মিছিল। হত্যা, দুর্ঘটনা কিংবা অস্বাভাবিক মৃত্যুর শিকার হচ্ছে মানুষ। ব্যস্ত শহরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে জীবিকার জন্য অনেকে ছুটে আসেন। কখনো ভাগ্যকে আবার কখনো মৃত্যুকে বরণ করে জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করেন। শুধু মৃত্যুতে শেষ নয়। মৃত্যুর পরেও দেখা মেলে না স্বজনের। ঠাঁই হয় হাসপাতাল মর্গে। শেষমেশ বেওয়ারিশ লাশের পরিচয়ে দাফন হয়।
পুলিশ কেস হয়নি এমন ক্ষেত্রে পরিচয় বের করতে না পারলে বা কোনো স্বজনের সন্ধান না মিললে সেটি বিবেচিত হয় বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে। পুলিশি তদন্তে হাতেগোনা কয়েকটি লাশের পরিচয় শনাক্ত হলেও অধিকাংশ লাশের পরিচয় মিলে না। কারণ লাশ শনাক্তে পুলিশের কোনো উন্নত প্রযুক্তি নেই। এখনো সনাতন পদ্ধতিতে লাশের বিবরণ লিখে রাখার (সুরতহাল রিপোর্ট) মধ্য দিয়ে বেওয়ারিশ লাশের পরিচয় শনাক্তকরণ পদ্ধতি অবলম্বন করছে পুলিশ। যার কারণে এসব মানুষের লাশ শেষ পর্যন্ত বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয় আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের সহায়তায়।
১০০ বছরের বেশি সময় ধরে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম বেওয়ারিশ লাশ দাফনের কাজটি করছে। বেওয়ারিশ লাশ সৎকারের জন্যই ১৯০৫ সালে সংস্থাটির গোড়াপত্তন করা হয়। এখন বেওয়ারিশ লাশ দাফনের পাশাপাশি শিক্ষা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত রয়েছে সংস্থাটি।
আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম বলছে, এক যুগে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম ১৩ হাজার ৩২৪টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করেছে। এই হিসাবে প্রতিবছর গড়ে ১ হাজার ১০০–এর বেশি লাশ দাফন করে সংস্থাটি।
আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের ট্রাস্টি এবং সমন্বয় কমিটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আজিম বখশ প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনেক মানুষ নিখোঁজ স্বজনদের খোঁজে আমাদের কাছে আসে। কেউ কেউ হদিস পায়, কেউ পায় না। যারা আসেন, সবার ছবি আমরা দেখাতে পারি না। পুলিশ লাশগুলো যখন দেয়, তখন ছবি দেওয়ার কথা। ছবি নিয়মিত পাওয়া যায় না। এগুলো তোলে পুলিশ। এ বিষয়ে আরও যত্নবান হওয়া উচিত।’
পুলিশ বলছে, অজ্ঞাতপরিচয় লাশ উদ্ধার হলে সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। তারপর ময়নাতদন্তের জন্য হাসপাতালে লাশ পাঠানো হয়। লাশ দেখে হত্যার আলামত বোঝা গেলে হত্যা মামলা করে পুলিশ। অন্যথায় অপমৃত্যু মামলা করা হয়। লাশ সংরক্ষণের পর যখন বুঝতে পারে তার আর কোনো স্বজন পাওয়া যাবে না, তখন তারা লাশ আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের কাছে হস্তান্তর করে।
এক যুগে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম ১৩ হাজার ৩২৪টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করেছে। এই হিসাবে প্রতিবছর গড়ে ১ হাজার ১০০–এর বেশি লাশ দাফন করে সংস্থাটি।
অজ্ঞাতনামা লাশের পরিচয় শনাক্তে বিশেষায়িত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) তিন বছর ধরে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। নির্বাচন কমিশনের জাতীয় পরিচয়পত্র সার্ভারের তথ্যভান্ডারে সংরক্ষিত আঙুলের ছাপ মিলিয়ে তাদের পরিচয় শনাক্ত করেন পিবিআই কর্মকর্তারা। তবু উদ্ধার হওয়া লাশের বড় অংশ বেওয়ারিশ হিসেবেই থেকে যাচ্ছে।
সংস্থাটি জানায়, ২০১৯ সালের শুরু থেকে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে আড়াই হাজার লাশের পরিচয় শনাক্ত করে পিবিআই। এই সময়ে ১ হাজার ১০০ লাশের পরিচয় শনাক্ত করতে পারেনি সংস্থাটি। যেসব লাশের পরিচয় পাওয়া যায়, এর মধ্যে একটি বড় অংশ সড়ক এবং রেল দুর্ঘটনায় মারা যায়। আবার কেউ কেউ আছে ভবঘুরে বা ছিন্নমূল। একইভাবে আগুনে পুড়ে মৃত্যু হওয়া অজ্ঞাতনামা অনেকের পরিচয়ও মেলানো যায় না।
পিবিআইয়ের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ফরেনসিক) মো. মোস্তফা কামাল রাশেদ প্রথম আলোকে বলেন, গলে যাওয়া, পচে যাওয়া লাশের আঙুলের ছাপ মেলানো যায় না। অনেক সময় দেখা যায় মৃত ব্যক্তির রক্তসঞ্চালন না থাকায় আঙুল কুঁচকে যায়। তখন আঙুলের ছাপ মেলানো যায় না। ২০১০ সালের আগে এনআইডি করেছেন, তাদের ক্ষেত্রেও আঙুলের ছাপ মেলানো কঠিন। ভবঘুরে এবং ছিন্নমূল মানুষের এনআইডি না থাকায় তাদের লাশ শনাক্তেও সমস্যা তৈরি হয়।
এক যুগে গড়ে ১ হাজার ১০০–এর বেশি লাশ দাফন করলেও গত তিন বছরের হিসাব ধরলে গড়ে ৬১৫ জনের লাশ দাফন করেছে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম। তিন বছর ধরে এই সংখ্যা নিম্নমুখী। ২০১৯ সালে বেওয়ারিশ লাশ দাফন করেছে ৭৯৫টি। পরবর্তী দুই বছরে এই সংখ্যা ৬৩৩ এবং ৪১৬।
এ বিষয়ে পিবিআইয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, এনআইডি সার্ভারে সংরক্ষিত আঙুলের ছাপ মিলিয়ে লাশের পরিচয় শনাক্ত এবং মুঠোফোনের সূত্র ধরে অনেক লাশের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে। এ কারণে হয়তো তিন বছরে বেওয়ারিশ লাশের সংখ্যা কমছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বের উন্নত দেশগুলোয় বেওয়ারিশ কোনো মরদেহ নেই। সবারই শনাক্তকরণের জন্য নিজস্ব পরিচিতি আছে। ওই দেশগুলোতে পুলিশ দুর্ঘটনার স্পটে গিয়ে পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ডিজিটাইজেশনের মাধ্যমে লাশের পরিচয় শনাক্ত করে ফেলে। কিন্তু বাংলাদেশে পুলিশ শনাক্তের কাজটি করলে এখনো অনেক পিছিয়ে আছে। কারণ এখনো দেশের সব নাগরিককে কোনো নির্দিষ্ট ডিজিটাল ডাটাবেইসে আনা যায়নি। ফলে এখানে ভবঘুরেসহ বিভিন্ন দুর্ঘটনার লাশ বেওয়ারিশ হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। জাতীয় পরিচয়পত্রের মতো জন্ম নিবন্ধনেও আঙুলের ছাপ নেওয়া বাধ্যতামূলক করা দরকার। যারা এনআইডির অন্তর্ভুক্তির বাইরে আছে তাদের আওতায় নিয়ে আসতে নির্বাচন কমিশনকে আরো সক্রিয় থাকতে হবে। এ ছাড়া সবাই তাদের সঙ্গে পরিচয়পত্র/ঠিকানা রাখলে কোনো দুর্ঘটনায় লাশ বেওয়ারিশ হওয়ার ঝুঁকি থাকবে না। এ ক্ষেত্রে পরিবার, হাসপাতাল, পুলিশ ও ইসিকে আরো সক্রিয়তার পরিচয় দিতে হবে।
তারা বলেন, ‘আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত সবার জন্য বাধ্যতামূলক কোনো কেন্দ্রীয় ডাটাবেইস নেই। যখন কোনো ব্যক্তি নিখোঁজ হয়, প্রথমে পরিবারকে থানাসহ সংশ্লিষ্ট জায়গায় জানাতে হয়। না জানালে এটা কারো নজরে আসার সুযোগ নেই। কিন্তু পরিবার অনেক সময় পাঁচ-সাত দিন পরে থানায় জিডি করে। এ ক্ষেত্রে মামলার মতো ভালোভাবে তদন্ত হয় না। মূলত এসব কারণে অনেক লাশ নিখোঁজ থেকে যায়। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, যারা ভ্রাম্যমাণ, যাদের দৃশ্যমান কোনো অভিভাবক নেই। তারা ছাড়াও অনেকের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) নেই। মূলত এসব লোকজনই পরিবার থেকে নানা কারণে দূরে গিয়ে মারা গেলে তাদের পরিচয় নিয়ে সংকটে পড়েন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যরা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭২১
আপনার মতামত জানানঃ