পৃথিবীর সর্বত্র মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি ছড়িয়ে পড়েছে। সাগরের তলদেশ থেকে শুরু করে বরফে ঢাকা অ্যান্টার্কটিকাও বাদ নেই। সর্বত্র ছড়িয়ে থাকার কারণে মানবদেহেও এর উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির এক গবেষণায় দেখা গেছে, শিশুদের মলে মাইক্রোপ্লাস্টিকের অপ্রত্যাশিত উপস্থিতি। শিশুর মলের সঙ্গে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের চেয়ে ১০ গুণ প্লাস্টিক-কণা নিঃসরিত হচ্ছে। আকারে পাঁচ মিলিমিটারের কম কণাগুলো নতুন করে পরিবেশে যুক্ত হচ্ছে। প্লাস্টিক-কণায় থাকে ক্ষতিকর নানা রাসায়নিক পদার্থ, যা মারাত্মক ঝুঁকির কারণ হতে পারে।
শিশুরা হাতের কাছে যা পায়, তা-ই মুখে দেয়। আকারে ছোট হলে খেয়েও ফেলে। এসবের মধ্যে থাকে প্লাস্টিকও। বিষয়টি তাদের কাছে আনন্দের হলেও নতুন করে উদ্বেগ বাড়িয়েছে এই গবেষণা।
এই গবেষণা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির গবেষকরা। তারা নিউইয়র্ক নগরীর প্রায় চার হাজার শিশুর মলের নমুনা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। এতে গড়ে এক বছর বয়সী ৬ শতাংশ শিশুর মলে প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির চেয়ে অনেক বেশি মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে। শিশুদের শরীরে বিভিন্ন আকারের প্লাস্টিক প্রবেশ করছে প্লাস্টিকের বোতল ও পাত্রের মাধ্যমে খাওয়া, খেলনা মুখে দেওয়া এবং হাতের কাছে কিছু পেলে গিলে ফেলায়। শিশুদের খেলনাসহ বিভিন্ন প্লাস্টিকে ১০০ ধরনেরও বেশি বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ থাকে, যা শরীরে নানা রোগের কারণ হতে পারে।
খাবারের মাধ্যমে মাইক্রোপ্লাস্টিক পেটে গেলে শরীরে কী ধরনের প্রভাব পড়ে, তা এখনও জানা যায়নি। তবে এর যে কোনো ক্ষতিকর প্রভাব নেই, তা আগের মতো বলা যাচ্ছে না। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, সেল মেমব্রেন থেকে সংবহনতন্ত্রে প্রবেশ করতে পারে মাইক্রোপ্লাস্টিক। এতে কোষের স্বাভাবিক ক্রিয়া পর্যন্ত ব্যাহত হতে পারে।
প্লাস্টিকের বাটিতে খাবার খাওয়ার কারণে বড় মানুষের মলেও মাইক্রোপ্লাস্টিকের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। তবে একই এলাকায় বসবাসরত প্রাপ্তবয়স্কদের চেয়ে শিশুদের পেটে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি বেশি পাওয়া গেছে বলে জানা যায় সম্প্রতি এক প্রাথমিক গবেষণায়।
শিশুর মলের সঙ্গে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের চেয়ে ১০ গুণ প্লাস্টিক-কণা নিঃসরিত হচ্ছে। আকারে পাঁচ মিলিমিটারের কম কণাগুলো নতুন করে পরিবেশে যুক্ত হচ্ছে। প্লাস্টিক-কণায় থাকে ক্ষতিকর নানা রাসায়নিক পদার্থ, যা মারাত্মক ঝুঁকির কারণ হতে পারে।
সায়েন্স এলার্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, সাম্প্রতিক গবেষণায় যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহরে গড়ে এক বছর বয়সি ছয়টি শিশুর মলে ১০ জন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির চেয়ে বেশি মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে।
গবেষণা অনুসন্ধানে বলা হয়, প্লাস্টিকের তৈরি চুষনি চোষা ও পাত্রে খাদ্যগ্রহণ, প্লাস্টিকের খেলনা মুখে দেয়ায় প্রাপ্তবয়স্কদের চেয়ে শিশুরা প্লাস্টিকের সান্নিধ্যে বেশি আসে।
গবেষণাপত্রে গবেষকরা বলেন, ‘আমাদের গবেষণায় শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের মলে মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া যায়। এ বিষয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে বলে আমরা মনে করি।’
নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির শিশু বিশেষজ্ঞ কুরুনথাচালাম কান্নানের নেতৃত্বাধীন গবেষণা দলটি মানবদেহের সংস্পর্শে আসা দুই ধরনের মাইক্রোপ্লাস্টিক মূল্যায়নে আগ্রহী ছিলেন।
এদের একটি পলিথিলিন টেরেফথালেট (পিইটি), যা খাবার প্যাকেটজাত ও পোশাক তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। অন্যটি খেলনা ও বোতলে ব্যবহৃত পলিকার্বনেট (পিসি)।
এক বছর বয়সি ছয়টি শিশু ও ১০ জন প্রাপ্তবয়স্কের মলের নমুনা সংগ্রহ করেন গবেষকরা। পাশাপাশি তিনটি নবজাতকের কালো রঙের প্রথম মলের নমুনাও সংগ্রহ করা হয়। প্রতিটি মলের নমুনায় কমপক্ষে এক ধরনের প্লাস্টিক পাওয়া যায়। তবে প্রাপ্তবয়স্ক ও এক বছর বয়সি শিশুদের মলের মধ্যকার পার্থক্য লক্ষণীয় ছিল।
গবেষকরা বলেন, ‘অনুসন্ধানে শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের মলে দুই ধরনের মাইক্রোপ্লাস্টিকের প্যাটার্নের উল্লেখযোগ্য পার্থক্য আমাদের নজরে পড়ে। প্রাপ্তবয়স্কদের চেয়ে শিশুদের মলে পলিথিলিন টেরেফথালেট উল্লেখযোগ্য হারে বেশি ছিল।’
‘অবশ্য তাদের মলে পলিকার্বনেট মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতির মধ্যে বড় ধরনের পার্থক্য ছিল না।’
গবেষকরা আরও জানান, প্রাপ্তবয়স্কদের চেয়ে এক বছর বয়সি শিশুদের মলে পলিথিলিন টেরেফথালেটের উপস্থিতি গড়ে ১০ গুণের বেশি ছিল।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি শরীরের জন্য ক্ষতিকর কি না তা দ্রুত পরীক্ষা করে দেখা জরুরি। এর ক্ষতিকর দিক পরীক্ষিত হলে, মাইক্রোপ্লাস্টিক কোন কোন উপায়ে পাকস্থলীতে প্রবেশ করছে বা চিহ্নিত করে দ্রুত সময়ে তা বর্জন করা উচিৎ।
সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞান মানু্ষকে অনেক কিছু উপহার দিয়েছে, যা জীবনযাপনকে করেছে সহজতর৷ কিন্তু বিজ্ঞানের সেই আশীর্বাদ মানুষের বিবেচনার অভাবে পরিণত হয়েছে অভিশাপে৷ প্লাস্টিক বর্জ্য তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ৷
আমাদের প্রতিদিনের বেঁচে থাকায় প্লাস্টিকের ব্যবহার আজ অপরিহার্য৷ জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে বিকল্প সামগ্রী হিসেবে পলিমারের ব্যবহার হচ্ছে৷ ক্যারি ব্যাগ থেকে ওষুধের বোতল, খাদ্য পরিবেশনের পাত্র থেকে ফুলেব টব— বিভিন্ন ক্ষেত্রে চটের ব্যাগ হোক কিংবা কাঁচের শিশি অথবা চিনেমাটির থালা কিংবা মাটির টব— এ সব কিছুরই বিকল্প হিসেব ব্যবহৃত হচ্ছে প্লাস্টিক৷ অপেক্ষাকৃত সস্তা, বহনযোগ্য হওয়ার কারণে দ্রুত জনপ্রিয়তা পেয়েছ পলিমারে তৈরি সামগ্রী৷ এর ব্যবহার নিয়ে আপত্তি নেই, কিন্তু ব্যবহারের পর যেভাবে এগুলিকে যত্রতত্র ফেলে দেওয়া হচ্ছে, আপত্তি তাতেই৷ সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব থাকায় তারা ব্যবহার করা প্লাস্টিকের সামগ্রী যেখানে-সেখানে ফেলে দিচ্ছে৷ যেহেতু প্লাস্টিকের সামগ্রী মাটিতে মিশে যায় না, এর একাংশ পুনর্ব্যবহারযোগ্য নয়, তাই ক্রমশ তা বর্জ্য হিসেবে জমা হচ্ছে লোকালয়ের বুকে৷ আর তা থেকেই ছড়াচ্ছে দূষণ৷ পলিমার সামগ্রী পুড়িয়ে ফেললে আরও বিপদ, হাইড্রোকার্বন হয়ে বাতাসে মিশে তা বাড়িয়ে দিচ্ছে দূষণের মাত্রা৷
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবেশের ওপর ইতিবাচক প্রভাব নিশ্চিতে পলিথিন শপিং ব্যাগের উৎপাদন, ব্যবহার, বিপণন ও বাজারজাতকরণের ওপর জারিকৃত নিষেধাজ্ঞা পালনে দেশের জনগণকে সম্পৃক্ত করা দরকার।
তারা বলেন, সরকারের পরিবেশ অধিদপ্তর, পুলিশ প্রশাসন ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদিচ্ছা, আন্তরিকতা, সততা, দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ এবং জবাবদিহিতার অভাব ও রাজনৈতিক অঙ্গীকারের অভাবে বর্তমানে পলিথিনের উৎপাদন ও ব্যবহার আগের চেয়ে অনেকগুণ বেড়ে গেছে। একইসঙ্গে রয়েছে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের অবহেলা।
তারা বলেন, ‘আগামী বছরগুলোতে প্লাস্টিকের ব্যবহার কি বাড়বে? আমরা অনায়াসে বলতে পারি বাড়বে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে হাত মিলিয়েই বাড়ছে প্লাস্টিকের ব্যবহার। তারা বলেন, অর্থনীতিতে যত বেশি প্রবৃদ্ধি আসছে প্লাস্টিকের ব্যবহারও বাড়ছে। প্লাস্টিক ব্যবহার হচ্ছে নির্মাণে, অবকাঠামো উন্নয়নে, ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিকস শিল্পে এবং পরিবহনে।
তারা বলেন, আপনার ছোট ছোট পদক্ষেপে সমুদ্র দূষণ কমতে পারে। সবাইকে এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে এবং চারপাশের মানুষকেও সমুদ্রের গুরুত্ব সম্পর্কে জানাতে হবে। সমুদ্রে বেড়াতে গেলে আমরা জেনে বা না বুঝে বিভিন্ন খাবারের প্যাকেটসহ বোতল বা প্লাস্টিক ইত্যাদি পানিতে ফেলে দূষিত করি। এবিষয়েও সচেতন থাকতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪১১
আপনার মতামত জানানঃ