করোনা সংক্রমণের আতঙ্ক, মৃত্যু ভয়, বেকারত্ব, অর্থনৈতিক বিপর্যস্ততার কারণে বাড়ছে মানসিক সংকট। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ, আত্নীয় স্বজন বন্ধুদের সান্নিধ্য না পাওয়ায় বাড়ছে একাকিত্ব। অর্থাৎ হীনমন্যতা, একাকিত্ব থেকেই নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আত্মহত্যাকে সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ হিসেবে বেছে নেয়।
আত্মহত্যা একটা সাময়িক সমস্যার চিরস্থায়ী সমাধান। সমস্যাটা হয়তো সাময়িক এবং এর সমাধানও ভবিষ্যতে বিদ্যমান। তবে পরাজিত সৈনিকের ন্যায় সমস্যার মোকাবেলা না করে কাপুরুষের ন্যায় আত্মহত্যার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বর্তমান প্রজন্মের মাঝে আত্মহত্যা একটি মহামারির ন্যায় দেখা দিয়েছে।
দেশে করোনা মহামারিতে শিক্ষার্থীদের ১২৭টি আত্মহত্যার ঘটনা বিশ্লেষণ করে একটি গবেষণা প্রতিবেদন বের হয়েছে। এতে দেখা যায় আত্মহত্যাকারীদের ৭২ শতাংশই ছাত্রী। যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে বৈশ্বিক আত্মহত্যায় ছেলেদের হার মেয়েদের তুলনায় দ্বিগুণ। দেশে করোনার পূর্বে ছাত্রদের আত্মহত্যার হার ছিল ৭১ শতাংশ।
গত ২৮ ডিসেম্বর ইংল্যান্ডের কিংস কলেজ অব লন্ডনের ‘ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব সোশ্যাল সাইকিয়াট্রি’তে গবেষণা নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়। ‘মহামারিতে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যায় প্রবণতা ও লিঙ্গভিত্তিক সম্পর্ক’ শীর্ষক গবেষণাটি ২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে ২০২১ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত সারাদেশ ব্যাপী শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার তথ্যের উপর ভিত্তি করে করা হয়।
গবেষণার ফলাফলে উঠে আসে, ১৪ থেকে ১৮ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার ৪২ শতাংশ। যেখানে আত্মহত্যাকারীদের ৮০ শতাংশ গলায় ফাঁস দিয়ে এবং ১০ শতাংশ বিষ খেয়ে জীবন বিসর্জন দেয়।
আত্মহত্যার কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে ১৬ শতাংশ প্রেমঘটিত, ১৩ শতাংশ অতি আবেগপ্রবণতা, ১১ শতাংশ স্বপ্নপূরণে ব্যার্থতা, ৯ শতাংশ পারিবারিক কলহ, অতিরিক্ত শাসনের কারণে ৪ শতাংশ, শিক্ষাজীবনে অসফলতার কারণে ৯ শতাংশ, মানসিক ভারসাম্যজনিত ৯ শতাংশ এবং যৌন নির্যাতনের কারণে ৬ শতাংশ। এছাড়াও আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে মাধ্যমিক পর্যায়ের ৪৩ শতাংশ ও উচ্চ মাধ্যমিকের ২৬ শতাংশ শিক্ষার্থী।
অন্যদিকে করোনার আগে করা এক গবেষণা অনুযায়ী, ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার ঘটনা ছিল ৫৬টি। এক্ষেত্রে আত্মহত্যাকারী শিক্ষার্থীদের ৭১ শতাংশ ছিল ছেলে ও ২৮ শতাংশ মেয়ে। কিন্তু মহামারিতে আত্মহত্যার সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। এর কারণ মহামারিতে আত্মহত্যার ধরণে পরিবর্তন এসেছে।
গবেষণায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বরাত দিয়ে বলা হয়, ২০১৮ সালে সারা পৃথিবীতে ৮ লাখ লোক আত্মহত্যা করে। বিশ্বের ৮০ শতাংশ আত্মহত্যা বাংলাদেশের মতো নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে ঘটে থাকে।
দেশে করোনা মহামারিতে শিক্ষার্থীদের ১২৭টি আত্মহত্যার ঘটনা বিশ্লেষণ করে একটি গবেষণা প্রতিবেদন বের হয়েছে। এতে দেখা যায় আত্মহত্যাকারীদের ৭২ শতাংশই ছাত্রী। যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে বৈশ্বিক আত্মহত্যায় ছেলেদের হার মেয়েদের তুলনায় দ্বিগুণ। দেশে করোনার পূর্বে ছাত্রদের আত্মহত্যার হার ছিল ৭১ শতাংশ।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ২০১৮ সালের জরিপ অনুযায়ী, ১০ থেকে ২৪ বছর বয়সী মানুষের প্রায় ৫ শতাংশ একবারের জন্য হলেও আত্মহত্যা করার চিন্তা করেছেন। ১ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ একবারের জন্য হলেও পরিকল্পনা বা চেষ্টা করেছেন। সেই গবেষণায় দেখা গেছে, নারীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা পুরুষের তুলনায় প্রায় তিন গুণ। আবার গ্রামাঞ্চলের চেয়ে শহরাঞ্চলে আত্মহত্যার চিন্তা করার হার দ্বিগুণ।
২০২০ সালের মার্চ থেকে গত বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সারাদেশে পুরুষের চেয়ে বেশি নারী আত্মহত্যা করেছেন। নারীদের ক্ষেত্রে এ সংখ্যাটা ৫৭ শতাংশ এবং পুরুষের ক্ষেত্রে ৪৩ শতাংশ। মোট আত্মহত্যার ঘটনা ১৪ হাজার ৪৩৬টি। এর মধ্যে নারীর আত্মহত্যার ঘটনা আট হাজার ২২৮টি এবং পুরুষের আত্মহত্যার ঘটনা ছয় হাজার ২০৮টি।
করোনাকালে আত্মহত্যার কারণ উল্লেখ করে বলা হয়, পারিবারিক সমস্যার কারণে আত্মহত্যা করেছেন ৩৫ শতাংশ। এর বাইরে ২৪ শতাংশ সম্পর্কে টানাপোড়েনের কারণে এবং অজানা কারণে ৩২ শতাংশ মানুষ আত্মহত্যা করেছেন। আর্থিক ও লেখাপড়ার কারণে আত্মহত্যা করেছেন যথাক্রমে ৪ ও ১ শতাংশ।
করোনার আঘাতে বিপর্যস্ত মানুষ। বিশেষ করে নিম্নবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে নেমে এসেছে চরম দুর্দশা। দিন দিন তারা আর্থিক ও মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে। এ অবস্থায় জেঁকে বসেছে হতাশা। শিক্ষা, চাকরি ও আর্থিকসহ সব ক্ষেত্রে বিরাজ করছে অনিশ্চয়তা। অভাব ঘরে হানা দেয়ায় কেউ কেউ বেছে নিয়েছেন আত্মহত্যার পথ। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, মানুষ যখন অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে তখন তুচ্ছ কারণেও আত্মহত্যার দিকে ঝুঁকে পড়েন।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা জানান, আত্মহত্যা করার ক্ষেত্রে অনেকগুলো বিষয় কাজ করে। ব্যক্তিবিশেষে ক্ষেত্রগুলো ভিন্ন হয়ে থাকে। নিজের স্বার্থে আঘাত লাগা, চাহিদার সঙ্গে প্রাপ্তির ব্যবধান, অসহায়ত্ব, কর্মহীনতা, নৈতিক মূল্যবোধ একেবারে ফুরিয়ে যাওয়া, অর্থসংকট ও চারপাশের পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে না নিতে পারাসহ বেশ কয়েকটি কারণে আত্মহননের পথ বেছে নেয়। বিশেষ করে করোনার ঘরবন্দি সময়ে মানসিক অস্থিরতা এর জন্য অন্যতম দায়ী।
তারা বলেন, করোনার সময়ে যেভাবে আত্মহত্যার সংখ্যা বেড়ে গেছে তা সত্যিই শঙ্কিত করে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে নজর দেওয়া জরুরি। পরিবারে জ্যেষ্ঠদের খেয়াল রাখতে হবে, তাদের ছেলে-মেয়ে কী করছে, কাদের সঙ্গে মিশছে। না হলে যে কেউ ভুল পথে পা বাড়াতে পারে। কারণ আত্মহত্যা করার পেছনে পরিবার, সমাজ ও দেশেরও দায় রয়েছে। মানুষ কেন আত্মহত্যা করে, তা নিয়ে ব্যাপকভাবে গবেষণা হওয়া দরকার।
আত্মহত্যা ঠেকানোর জন্য পরিবার এবং সমাজকে প্রধান দায়িত্ব নিতে হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এক্ষেত্রে পরিবারগুলোকে প্রধান দায়িত্ব নিতে হবে, তবে পরিবারকেও নিজেদের আচরণ এবং প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সচেতন হতে হবে।
তারা কিছু পদক্ষেপের কথা বলেছেন— পরিবারের ছোটদের সঙ্গে যোগাযোগ অনেক বাড়াতে হবে, তাদের বোঝার চেষ্টা করতে হবে। সন্তানদের খেলাধুলা করা এবং সামাজিক মেলামেশা করার সুযোগ বাড়িয়ে দিতে হবে। সন্তানকে চাপ মোকাবেলা করতে শেখাতে হবে, পড়াশোনা বা খেলাধুলা নিয়ে সন্তানের ওপর চাপ প্রয়োগ না করা। ব্যর্থতা মেনে নেয়া নিজেরাও শিখতে হবে, বাচ্চাকেও শেখাতে হবে। ব্যর্থতা জীবনের অংশ এটা বুঝতে হবে। তিরস্কার করা বা তাদের মর্যাদাহানিকর কিছু না বলা, মনে আঘাত দিয়ে বা সবসময় সমালোচনা না করা, সমবয়সী অন্যদের সঙ্গে তুলনা না করা। আত্মীয়, বন্ধু এবং আশেপাশের পরিবারসমূহকেও এ বিষয়ে সচেতন করা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬২১
আপনার মতামত জানানঃ