করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যেও দেশে নারী ও শিশুর প্রতি ধর্ষণ, হত্যা ও পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে অব্যাহত রয়েছে। ২০২১ সালে ৩ হাজার ৭০৩ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১২৩৫ জন। এর মধ্যে ৬২৯ জন কন্যাশিশুসহ ১০১৮ জন ধর্ষণের শিকার, ৬২ জন কন্যাশিশুসহ ১৭৯ জন দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার, ২২ জন কন্যাশিশুসহ ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন ৩১ জন, ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যা করেছেন ৭ জন।
১৩টি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে এ তথ্য দিয়েছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় লিগ্যাল এইড উপ-পরিষদ। আজ (সোমবার) দুপুরে মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম এবং সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ৯৩ জন কন্যাশিশুসহ ১৫৫ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। ১৪ জন কন্যাশিশুসহ ৩৩ জন শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছেন। ৬২ জন কন্যাশিশুসহ ৯৫ জন যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। ৫ জন কন্যাশিশুসহ এসিডদগ্ধের শিকার হয়েছে ২২ জন, এর মধ্যে মারা গেছেন চার জন।
অগ্নিদগ্ধের শিকার হয়েছেন ৩ জন কন্যাশিশুসহ ২৩ জন। এর মধ্যে ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। অপহৃত হয়েছেন ১৮০ জন নারী ও কন্যাশিশু। আর অপহরণের চেষ্টা করা হয়েছে ৮ জন কন্যাশিশুসহ ১১ জনকে।
৬ জন কন্যাশিশুসহ ৪২ জন নারী ও কন্যাশিশুকে পাচার করা হয়েছে। ২ জনকে পতিতালয়ে বিক্রি করা হয়েছে।
১ জন কন্যাশিশুসহ যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১৩৮ জন, এরমধ্যে ৪৫ জনকে যৌতুকের কারণে হত্যা করা হয়েছে। ৫৮ জন কন্যাশিশুসহ শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ২০৮ জন।
১১৪ জন কন্যাশিশুসহ ৪৪৪ জন নারী ও কন্যাশিশুকে হত্যা করা হয়েছে। এছাড়াও ১৯ জন কন্যাশিশুসহ ৮৭ জনকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। ১৩১ জন কন্যাশিশুসহ ৪২৭ জনের রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে। ৪৩ জন কন্যাশিশুসহ ১২১ জনের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। আত্মহত্যার প্ররোচনার ঘটনা ঘটেছে ৪টি। ৫ জন কন্যাশিশুসহ আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন ১১ জন।
ফতোয়ার ঘটনা ঘটেছে ২টি। বাল্যবিবাহ সংক্রান্ত ঘটনা ঘটেছে ৩২৭টি, এর মধ্যে প্রতিরোধ করা হয়েছে ৪৩টি। ২৩ জন কন্যাশিশুসহ ৬৩ জন সাইবার অপরাধের শিকার হয়েছেন। এছাড়াও ২৬ জন নারী ও কন্যাশিশু অন্যান্য নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১২৩৫ জন। এর মধ্যে ৬২৯ জন কন্যাশিশুসহ ১০১৮ জন ধর্ষণের শিকার, ৬২ জন কন্যাশিশুসহ ১৭৯ জন দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার, ২২ জন কন্যাশিশুসহ ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন ৩১ জন, ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যা করেছেন ৭ জন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে চলমান করোনা পরিস্থিতি সমাজে এক ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। অপরাধপ্রবণতা বেড়ে গেছে সর্বক্ষেত্রে। নারী নির্যাতনের মতো অপরাধও সে কারণেই বাড়ছে। শহর থেকে শুরু করে গ্রামগঞ্জ পর্যন্ত বহু মানুষের মধ্যে উচ্ছৃঙ্খল আচরণ লক্ষ করা যায়।
এইসব ঘটনার জন্য দীর্ঘদিন ধরেই বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে দায়ী করে আসছেন মানবাধিকার কর্মীরা। তারা বলছেন, এইসব ধর্ষণ বা গণধর্ষণের ঘটনাগুলোর সঙ্গে ক্ষমতাশালীরা জড়িত থাকায় তাদের বিচার হয় না। আবার অনেক সময় পুলিশ এইসব ক্ষমতাশালীদের গ্রেপ্তারও করে না। কেউ কেউ গ্রেপ্তার হলেও তারা আবার জামিনে ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে। ফলে এই অপরাধীদের বিরুদ্ধে সমাজে খুব ভালো বার্তা যাচ্ছে না। এই কারণে এদের থামানোও যাচ্ছে না। এই অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে অবশ্যই অপরাধ কমে যাবে।
গত বছরের অক্টোবরে বাংলাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধন করে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান যোগ করা হয়। এর ফলে বাংলাদেশে ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ধর্ষণ, ধর্ষণ জনিত কারণে মৃত্যুর শাস্তি প্রসঙ্গে ৯(১) ধারায় এতদিন ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। তবে ধর্ষণের শিকার নারী বা শিশুর যদি মৃত্যু হয় বা গণধর্ষণের শিকার নারী বা শিশুর মৃত্যু হয় বা আহত হন, তাহলেই সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছিল। সেই সঙ্গে উভয় ক্ষেত্রেই ন্যূনতম এক লক্ষ টাকা করে অর্থ দণ্ডের বিধান ছিল। সেই আইনে পরিবর্তন এনে ধর্ষণের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলেই মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবনের বিধান রাখা হয়েছে। সেই সঙ্গে অর্থদণ্ডের বিধানও থাকছে।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন অনুযায়ী, ধর্ষণ বা ধর্ষণ-পরবর্তী অন্যবিধ কার্যকলাপের ফলে ধর্ষণের শিকার নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটলেও একই শাস্তি হবে। যদি কোনো ব্যক্তি তার যৌন কামনা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে শ্লীলতাহানি করেন তাহলে এটি যৌন নিপীড়ন বলে বিবেচিত হবে। এজন্য ওই ব্যক্তির অনধিক ১০ বছর এবং ন্যূনতম তিন বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে এবং অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত করা হবে।
এছাড়া পুলিশ হেফাজতে থাকাকালীন সময়ে যদি কোনো নারী ধর্ষণের শিকার হন, তাহলে যাদের হেফাজতে থাকাকালীন ওই ধর্ষণ সংঘটিত হয়েছে, তিনি বা তারা প্রত্যেকে হেফাজতের ব্যর্থতার জন্য, সর্বোচ্চ ১০ বছর কিন্তু ন্যূনতম পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং ন্যূনতম ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন।
নারী নির্যাতন কেন বাড়ছে এবং এ অপরাধ বন্ধ করতে কী করণীয়? এ সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নারী নির্যাতন মানবাধিকার লঙ্ঘন, এটি সবাইকে বুঝতে হবে। এ মানবাধিকার রক্ষার দায়িত্ব সমাজ ও সরকার উভয়ের। নারী নির্যাতন বন্ধের ক্ষেত্রে বিচারহীনতা বড় অন্তরায়। পরিস্থিতির কারণে নির্যাতনের শিকার নারীদের মধ্যে মাত্র ২০ শতাংশ আইনের আশ্রয় নেয়, বিচারপ্রার্থী হয়। বিচারপ্রার্থীদের মধ্যে চার শতাংশের কম নারী বিচার পায়। নারী নির্যাতন রোধ করতে প্রথমেই প্রয়োজন অপরাধীর বিচার নিশ্চিত করা।
তারা বলেন, নারী নির্যাতনের বিচারের জন্য কঠোর আইন রয়েছে। ধর্ষণের অপরাধে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান হয়েছে। কিন্তু আইন তো সঠিকভাবে প্রয়োগ হয় না। তাই আইন এক্ষেত্রে অকার্যকর হয়ে আছে। অতএব কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করে নারী নির্যাতনের বিচার নিশ্চিত করলেই এ ধরনের অপরাধ বন্ধ করা সম্ভব।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯০৭
আপনার মতামত জানানঃ