মানবাধিকার সংস্থাগুলো আগে থেকেই বলে আসছিল তীব্র খাদ্য সংকট ও অর্থনৈতিক দুর্দশায় পড়তে যাচ্ছে উত্তর কোরিয়া। মহামারি করোনাভাইরাস ও ঘূর্ণিঝড়ের কারণে উত্তর কোরিয়ার কৃষিক্ষেত্রে এবার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এতে দেশটির খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। ফলে দেশটিতে খাদ্য সংকটসহ নানা সংকট চেপে বসেছে। এমন সংকটকালে পরমাণু অস্ত্র নয় দেশের খাদ্য নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক ও জীবনমান উন্নয়ন চান উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতা কিম জন উন।
শনিবার (১ জানুয়ারি) ক্ষমতা গ্রহণের ১০ বছরে উপলক্ষে দেওয়া ভাষণে এই বিষয়গুলোকে ২০২২ সালের মূল লক্ষ্য বলে মন্তব্য করেন তিনি।
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা এক প্রতিবেদনে কিম জং উনকে উদ্ধৃত করে জানিয়েছে, উত্তর কোরিয়ার মানুষ মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে। চলমান সমস্যা কাটাতে নতুন বছরে মানুষের জীবনযাত্রা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে মূল লক্ষ্য।
অথচ কিম জং উন বেশিরভাগ সময় কথা বলতে গিয়ে এর আগে পরমাণু উন্নয়নের কথা বারবার বলেছেন। কিন্তু এবার তার মুখেই শোনা গেল ভিন্ন সুর।
অবশ্য করোনাভাইরাস মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকেই অভ্যন্তরণীভাবে লকডাউনে চলে যায় কিম প্রশাসন। কিন্তু সারা বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় চরম খাদ্য সঙ্কট দেখা দিয়েছে উত্তর কোরিয়ায়।
সেই সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে নিজের পরিকল্পনার কথা জানালেন কিম জং উন। তিনি বলেছেন, জাতীয় উন্নয়ন এবং সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের দিকে নজর দেওয়া হবে।
বার্তা সংস্থা এএফপির খবরে বলা হয়েছে, উত্তর কোরিয়ার ওয়ার্কার্স পার্টির এই নেতা দলের বৈঠকের পর ওই ভাষণ দেন। গত কয়েক বছর এ ভাষণ পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। কয়েক বছর ধরেই খাদ্য ও উন্নয়নের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিচ্ছেন তার ভাষণে।
করোনা মহামারি শুরুর পর বাকি বিশ্ব থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করেছে উত্তর কোরিয়া। দেশটির অর্থনীতির ওপর এর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। এ ছাড়া খাদ্য মজুত করতেও দেশটিকে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
উত্তর কোরিয়ার বার্তা সংস্থা কেসিএনএর খবরে বলা হয়েছে, মানুষের দৈনন্দিন চাহিদা পূরণের বিষয়টিকে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে।
উত্তর কোরিয়ার খাদ্যসংকট নিয়ে এর আগেও সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে। জাতিসংঘের পক্ষ থেকে গত অক্টোবরে বলা হয়েছিল, দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে রয়েছে দেশটি।
এ প্রসঙ্গে কিম বলেন, করোনার ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হবে, সেগুলো সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে। জোরেশোরে পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়ন করা হবে।
করোনাভাইরাস মহামারি নিয়ন্ত্রণে সীমান্ত বন্ধ রেখেছে উত্তর কোরিয়া। ফলে চীনের সঙ্গে বাণিজ্য এ মুহূর্তে বন্ধ। এ ছাড়া পরমাণু কর্মসূচি পরিচালনার কারণে আগে থেকেই আন্তর্জাতিক বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা বলবৎ উত্তর কোরিয়ায়।
কোরিয়ার জনগণকে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করতে সংগ্রাম করতে হচ্ছে— বেশ কয়েক মাস ধরে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম এ নিয়ে খবর প্রকাশ করে।
চীনের সঙ্গে সীমানা বন্ধ থাকায় সীমান্তবর্তী এলাকায় চোরাচালান বন্ধ রয়েছে। এতে বিপাকে পড়েছে চোরাচালানের ওপর নির্ভরশীল উত্তর কোরিয়ার বড় একটি জনগোষ্ঠী। দেশটির প্রধান খাদ্য ভুট্টার মূল্য কেজিতে এতো বেড়েছে যে, তা অনেকের এক মাসের আয়েরও বেশি।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের গবেষক লিনা ইয়ুন বলেন, ‘দুই মাস ধরে চীন থেকে প্রায় কোনো খাবারই উত্তর কোরিয়ায় যায়নি। সীমান্তবর্তী এলাকায় কয়েকজন এরই মধ্যে অনাহারে মারা গেছে। ভিখারীর সংখ্যা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে ।’
তিনি বলেন, ‘অনেক মানুষ ভিক্ষা করছে, সীমান্ত এলাকায় অনেকেই মারা গেছে। আর কোনও খাবার নেই, সাবান নেই, টুথপেস্ট কিংবা ব্যাটারিও পাওয়া যাচ্ছে না।‘
সম্প্রতি উত্তর কোরিয়ার মানবাধিকারবিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ রিপোর্টার তোমাস ওজিয়া কুইন্তানা সতর্ক করে বলেন, ‘মারাত্মক খাদ্য সংকটের কারণে দেশটিতে ইতোমধ্যেই অপুষ্টি ও ক্ষুধা ভয়াবহ রুপ নিয়েছে। অনাহারে মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। পরিবার ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতে ব্যর্থ হওয়ায় শিশু ও বৃদ্ধদের অনেকে ভিক্ষা করতে বাধ্য হচ্ছে।’
১৯৯০ সালে উত্তর কোরিয়ায় মর্মান্তিক দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের ফলে সহায়তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দেশটি খাদ্য ঘাটতির মুখে পড়ে। খাদ্য আমদানি ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা, বন্যা ও খরা পরিস্থিতি আরও বিপর্যস্ত করে তোলে।
খাদ্যের অভাবে প্রাণ হারায় ৩০ লাখের মতো মানুষ। দুর্ভিক্ষের সময় কোরিয়াবাসীর ওই সময়ের সংগ্রামকে ‘আরডিউয়েস মার্চ’ বা ‘কষ্টসাধ্য যাত্রা’ হিসেবে অভিহিত করা হয়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮১৭
আপনার মতামত জানানঃ