উত্তর কোরিয়া সবশেষ পরমাণু বোমার পরীক্ষা চালিয়েছে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরের ৩ তারিখে। পুঙ্গেরি নামের একটি জায়গায় এই পরীক্ষাটি চালানো হয় এবং তাতে ১০০ থেকে ৩৭০ কিলোটন শক্তি তৈরি হয়েছিল। প্রসঙ্গত, একটি ১০০ কিলোটনের বোমা ১৯৪৫ সালে জাপানের হিরোশিমায় যুক্তরাষ্ট্রের ফেলা পরমাণু বোমার চেয়ে ছয়গুণ বেশি শক্তিশালী। উত্তর কোরিয়া দাবি করে এটি তাদের প্রথম থার্মোনিউক্লিয়ার অস্ত্র যা সব ধরনের পরমাণু অস্ত্রের চেয়ে শক্তিশালী।
উল্লেখ্য, ওই সময় চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার নেতাদের সাথে একটি সম্মেলনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। যে বৈঠকটিকে শি জিনপিংয়ের জন্য আন্তর্জাতিক নেতা হয়ে ওঠার দরজা বলে মনে করা হচ্ছিল।
ওই সময়ে পুঙ্গেরির ভূ-গর্ভস্থে চালানো এমন ছয়টি পারমাণবিক পরীক্ষার কারণে উত্তর কোরিয়া ও চীন সীমান্তবর্তী এলাকায় রিক্টার স্কেলে ৬.৩ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। পাশাপাশি ওই এলাকায় পারমাণবিক দূষণের আশঙ্কা দেখা দেয়। চীনের বিশ্লেষকরা এবং যুক্তরাষ্ট্র এই পারমাণবিক পরীক্ষাকে বেইজিংয়ের জন্য অপমানকর বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। অথচ দীর্ঘদিন ধরেই চীন ছিল উত্তর কোরিয়ার প্রধান মিত্র এবং ব্যবসায়িক অংশীদার।
এর প্রতিউত্তরে চীন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের নিষেধাজ্ঞায় যোগ দেয়, যা মূলত উত্তর কোরিয়ায় জ্বালানি সরবরাহের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল এবং প্রায় ১ লাখ উত্তর কোরিয়ান প্রবাসী শ্রমিকদের দেশে ফিরতে বাধ্য করেছিল।
বেইজিংয়ের বিশ্লেষক এইনার তানজেনের মতেও, কিম জং উন যদি কমিউনিস্ট পার্টির এই সম্মেলনকালীন আবারও পারমাণবিক পরীক্ষা চালায়, তাহলে সেটা চীনের গালে চড় মারার শামিল হবে।
সূত্র মতে, এই শ্রমিকদের অর্থ মূলত সরকারের সমরাস্ত্র কর্মসূচিতে ব্যয় করা হতো। তবে গত পাঁচ বছরে উত্তর কোরিয়ার সামরিক উচ্চাকাঙ্খা ক্রমাগত বৃদ্ধিই পেয়েছে।
পারমাণবিক পরীক্ষার আশঙ্কা
এদিকে, চীন যখন চলতি মাসে আবারও তার পাঁচ বছর অন্তর হওয়া সম্মেলন আয়োজন করতে চলেছে, তখন উত্তর কোরিয়ার পর্যবেক্ষকদের মধ্যে সপ্তম পারমাণবিক পরীক্ষার জোর গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। এদিকে, উত্তর কোরিয়া শিগগির পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা চালাতে পারে বলে মনে করছে দক্ষিণ কোরিয়া।
দক্ষিণ কোরিয়ার গোয়েন্দা সংস্থার ভাষ্যমতে, উত্তর কোরিয়া সম্ভবত ১৬ অক্টোবর থেকে ৭ নভেম্বরের মধ্যে পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা চালাতে পারে।
বেইজিংয়ের বিশ্লেষক এইনার তানজেনের মতেও, কিম জং উন যদি কমিউনিস্ট পার্টির এই সম্মেলনকালীন আবারও পারমাণবিক পরীক্ষা চালায়, তাহলে সেটা চীনের গালে চড় মারার শামিল হবে।
এই সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে উত্তর কোরিয়া প্রতিনিয়ত অস্ত্রের পরীক্ষা চালাচ্ছে। আমেরিকা ও দক্ষিণ কোরিয়ার আপত্তি সত্ত্বেও ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে উত্তর কোরিয়া। গত দুই সপ্তাহে এই দেশ ছয়টি ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালিয়েছে।
বৃহস্পতিবার উত্তর কোরিয়া আবারও পূর্ব সাগরে ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালিয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ার সেনাবাহিনীকে উদ্ধৃত করে নিউ এজেন্সি এ খবর দিয়েছে। দুই দিন আগে উত্তর কোরিয়া জাপানে মধ্যবর্তী পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। পাঁচ বছরের মধ্যে এই প্রথম উত্তর কোরিয়া এ কাজ করল।
বুধবার ভোরে কোরীয় উপদ্বীপের কাছে যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়া চারটি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। এর মাধ্যমে জাপানে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রের জবাব দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। তবে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আবারও নিজেদের শক্তি দেখানোর চেষ্টা করল উত্তর কোরিয়া।
এসব কারণে উত্তর কোরিয়া আবারও পারমাণবিক পরীক্ষা চালাতে পারে বলে আশঙ্কা জানিয়েছে বিশেষজ্ঞরা। এক্ষেত্রে তাদের মত, উত্তর কোরিয়া মূলত চীনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সম্মেলনের তোয়াক্কা করবে না।
তবে গত পারমাণবিক পরীক্ষায় চীনের শক্ত প্রতিউত্তর সত্ত্বেও আবার পরীক্ষা চালালে চীন কী পদক্ষেপ নেবে তা নিয়ে নিশ্চিতভাবে কিছু জানা যায়নি।
উত্তর কোরিয়া বারবার জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি ও পরীক্ষা চালিয়েছে। কিন্তু চীন কী করেছে? রাশিয়া কী করেছে? তারা চোখে কাপড় বেঁধে আছে। আর তাই উত্তর কোরিয়া জানে, তারা কোনপ্রকার জবাবদিহিতা ছাড়াই এসব করতে পারবে।
জায়চুন কিম, সিওলের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, বলেন, রাশিয়ার যুদ্ধে চীন খুশি না। তারা উত্তরপূর্ব এশিয়ায় নতুন কোন বিপত্তি চায় না। বিশেষ করে যখন তাইওয়ান নিয়ে ইতিমধ্যেই সমস্যার মধ্যে আছে দেশটি।
পাশাপাশি সাং-ইউন লি, টাফটস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, বলেন, আমার ধারণা কিম অং বেশ কিছুটা আগেই পারমাণবিক পরীক্ষা চালাতে পারে। এটা হতে পারে ১০ অক্টোবরের দিকে; উত্তর কোরিয়ার ওয়ার্কার্স পার্টির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে। যদি এটা ঘটে তাহলে চীন বিরক্ত হবে। তবে সম্ভবত কোন পদক্ষেপ নেবে না। এড়িয়ে যাবে। কারণ তাদের সামনে আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে। পাশাপাশি তিনি মনে করিয়ে দেন ইতিমধ্যেই উত্তর কোরিয়া বহুবার পারমানবিক পরীক্ষা বা মিসাইল ছুড়লেও কোন পদক্ষেপ নেয়নি চীন। এক্ষেত্রে চীন হয়তো একটি দায়সারা বক্তব্য দিতে পারে।
তবে উত্তর কোরিয়া বারবার জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি ও পরীক্ষা চালিয়েছে। কিন্তু চীন কী করেছে? রাশিয়া কী করেছে? তারা চোখে কাপড় বেঁধে আছে। আর তাই উত্তর কোরিয়া জানে, তারা কোনপ্রকার জবাবদিহিতা ছাড়াই এসব করতে পারবে।
প্রস্তুত পারমাণবিক কেন্দ্রগুলো
উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-আন ২০১৮ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে অঙ্গীকার করেছিলেন যে উত্তর কোরিয়াতে পারমাণবিক সামগ্রী সমৃদ্ধ করার যতো স্থাপনা আছে সেগুলো তারা ধ্বংস করে ফেলবেন।
তবে জাতিসংঘের পরমাণু শক্তি সংস্থা বলছে স্যাটেলাইট থেকে তোলা ছবিতে দেখা যাচ্ছে যে উত্তর কোরিয়া তাদের চুল্লিগুলো পুনরায় চালু করেছে। এসব চুল্লিতে পরমাণু অস্ত্র তৈরির উপাদান তৈরি করা হয়।
আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা আইএইএ আরো বলছে যে উত্তর কোরিয়ার পরমাণু কর্মসূচি পুরোদমে চলছে। এসব কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে প্লুটোনিয়াম আলাদা করা, ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করা ইত্যাদি।
চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে উত্তর কোরিয়া আরও বেশি করে পারমাণবিক পরীক্ষা চালানোর প্রস্তুতি নিয়েছে। পারমাণবিক কেন্দ্রগুলোকে প্রস্তুত রেখেছে তারা। জাতিসংঘের গোপন এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। খবর রয়টার্সের।
উত্তর কোরিয়ার নিষেধাজ্ঞাসংক্রান্ত জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের কমিটিতে সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন নিষেধাজ্ঞাবিষয়ক পর্যবেক্ষকেরা। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, পুঙ্গেরি পারমাণবিক পরীক্ষাকেন্দ্রে কাজ করার মধ্য দিয়ে অতিরিক্ত পারমাণবিক পরীক্ষা চালানোর পথ তৈরি হয়েছে। পারমাণবিক অস্ত্রের উন্নয়নে এসব পরীক্ষা চালানো হয়।
পারমাণবিক পরীক্ষা চালানো এবং ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া নিয়ে উত্তর কোরিয়ার ওপর জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তবে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, উত্তর কোরিয়া তাদের পারমাণবিক পরীক্ষা কেন্দ্রগুলোকে প্রস্তুত রেখেছে, যদিও তারা কোনো পারমাণবিক যন্ত্রের পরীক্ষা চালায়নি। ২০২২ সালের প্রথম অর্ধেকে দেশটি ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি ক্রমাগত বাড়িয়েছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫৫৮
আপনার মতামত জানানঃ