বিশ্বজুড়ে কোভিড-১৯ আক্রান্তদের মধ্যে সুস্থতার হার ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে গবেষকেরাও এসব রোগীর ‘ব্রেইন ফগ’ অবস্থা নিয়ে নতুন নতুন গবেষণার সুযোগ পাচ্ছেন। একে বাংলায় অনেকে ‘মস্তিষ্ক কুয়াশা’ হিসেবেও অভিহিত করে থাকে।
মস্তিষ্ক কুয়াশা বা ব্রেইন ফগ কোন নতুন রোগ বা রোগের লক্ষণ নয়; তবে কোভিডের পর এই অবস্থাটি নিয়ে নতুন উদ্দীপনার সঞ্চার হয়েছে। কয়েক মাস ধরেই চিকিৎসক এবং গবেষকেরা প্রত্যক্ষ করছেন যে, কোভিড-১৯ থেকে আরোগ্যের পরেও অনেকের মাঝে দীর্ঘকালীন বিভিন্ন লক্ষণ থেকে যাচ্ছে।
এমনই কিছু লক্ষণকে তারা সমন্বিতভাবে ‘ব্রেইন ফগ’ এর নাম দিয়েছেন। এসব লক্ষণের মধ্যে রয়েছে- দ্বিধায় ভোগা, চিন্তা ও মনোযোগের অসুবিধা, শর্ট টার্ম মেমরি লস, ক্লান্তি, অস্বস্তি, অনিদ্রা প্রভৃতি। এমনকি রোগ তীব্র আকার ধারণ করলে মস্তিষ্ক বিকৃতিও ঘটতে পারে। করোনা মহামারির কারণে এই রোগের প্রাদুর্ভাব যে হারে বাড়ছে, তাতে অদূর ভবিষ্যতে বিপদে পড়তে হতে পারে মানব সভ্যতাকে।
ব্রেইন ফগ কী?
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের নিউরোলজি বিভাগের অধ্যাপক বাহাদুর আলী মিয়া বিবিসিকে বলেন, করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হলে রোগীর শরীরে রক্ত জমাট বাঁধার একটা প্রবণতা থাকে।
তিনি বলেন, রক্তে যখন অক্সিজেনের মাত্রা কমে যায় তখন ব্রেইনেও অক্সিজেনের সরবরাহ কমে যায়। এতে করে ব্রেইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মেডিকেল সায়েন্সে এটাকে বলে ‘হাইপ্রোসিক ইনজুরি’।
অধ্যাপক বাহাদুর আলী মিয়া বলেন, ব্রেইন স্ট্রোক হলে বা টিউমার হলে ব্রেইনের একটা অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু যখন হাইপ্রোসিক ইনজুরি হয় তখন সমস্ত ব্রেইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই অবস্থাকে বলা হচ্ছে ‘ব্রেইন ফগ’।
ব্রেইন ফগ হলে স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়া, বিষণ্ণতা, আচরণের পরিবর্তন, হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে যাওয়া এসব লক্ষণগুলো দেখা যায় বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন।
এর কারণ কী?
এখনো এর পেছনের সঠিক কারণটি জানা না গেলেও বিজ্ঞানীরা কিছু তত্ত্ব অনুসরণ করছেন। তাদের বেশিরভাগেরই ধারণা, সংক্রমণের প্রতিক্রিয়ায় দেহের যেসব কোষ জড়িত তারা অন্য কোথাও (যেমন-মস্তিষ্ক) পথ বা আশ্রয় খুঁজে নেয়ার ফলেই এই অবস্থার সৃষ্টি হয়।
কোভিড আক্রান্ত কিছু মানুষের মস্তিষ্ক ময়নাতদন্তের মাধ্যমে তারা দেখেন যে, সেখানে এমন কিছু কোষ রয়েছে যা আদতে থাকার কথা নয়। বিজ্ঞানীরা এসব বৃহদাকার কোষের নাম দেন মেগাক্যারিওসাইটস। এসব মেগাক্যারিওসাইটস মস্তিষ্কে অতিরিক্ত জায়গা নিয়ে নেবার ফলে সেখানে রক্ত চলাচলের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ ও স্থান থাকছে না।
জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটি স্কুল অফ মেডিসিনের প্যাথলজির অধ্যাপক ডেভিড নওয়েন মতে, এই প্রবণতা কেবল কোভিড আক্রান্ত মানুষের কোষের ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে।
এবিসি নিউজকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “যেভাবে মেগাক্যারিওসাইটসগুলোকে মস্তিষ্কের ক্যাপিলারীগুলোতে দেখা যাচ্ছে, তা আমার গত গ্রীষ্মের কোন গবেষণায় পাওয়া যায়নি। কোভিডের পরেই তারা এমন আচরণ শুরু করেছে।”
যদি এই বিশাল কোষগুলো মস্তিষ্কের রক্ত প্রবাহকে সত্যিই আটকে দেয়, তাহলে মস্তিষ্ক পরিপূর্ণ অক্সিজেন এবং পুষ্টি থেকে বঞ্চিত হবে।
“মস্তিষ্কের কর্টেক্স বা বহিঃস্তরের কোষ অসংখ্য কৈশিক জালিকায় আবদ্ধ। এসব জালিকার কোনটিকে যদি এসব কোষ কিছু সময়ের জন্যও অবরুদ্ধ বা বন্ধ করে রাখে তাহলে সাথে সাথে রক্ত প্রবাহে তার প্রভাব পড়বে। যথাযথ সময়ে মস্তিষ্কে রক্ত এবং অক্সিজেন প্রবাহ ব্যর্থ হলে ব্রেইন ফগের মত মস্তিষ্ক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হওয়া খুবই স্বাভাবিক।”
মেমোরিয়াল স্লোয়ান কেটরিং ক্যান্সার সেন্টারের নিউরো-অনকোলজিস্ট ও নিউরোলজিস্ট, অ্যাড্রিয়েন এ বোয়ারের মতে, মস্তিষ্কের কুয়াশায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের মস্তিস্কে প্রদাহের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
মস্তিষ্ক এবং স্পাইনাল কর্ডের চারপাশ আবৃত করে থাকা ‘সাইটোকাইনস’ নামক একটি প্রোটিন এ জন্য দায়ী।
এই প্রোটিনগুলো সাধারণত দেহের ইমিউন সিস্টেমের সাথে সংযুক্ত থাকে, যা প্রদাহ বাড়িয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোর ক্ষতি সাধন করতে পারে।
বোয়েরের পাশাপাশি আরও কিছু গবেষক বলছেন যে, তারা এই প্রোটিনগুলোর সন্ধান সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুইডেও (সিএসএফ) পেয়েছেন।
বোয়ের বলেন, “আমরা সিএসএফ-তে বিপুল পরিমাণে সাইটোকাইনস খুঁজে পেয়েছি। সাইটোকাইনস হলো সেসব ছোট ছোট প্রোটিন যা কোষগুলো একে অপরের সাথে যোগাযোগের জন্য ব্যবহার করে”।
তিনি আরও জানান, যেসব মানুষ কোভিড থেকে আরোগ্যের পর দীর্ঘমেয়াদে আর কোন শারীরিক সমস্যার সম্মুখীন হননি, তারা আমাদের সাহায্য করতে পারেন এ গবেষণায়। তাদের মস্তিষ্ক পর্যবেক্ষণে বোঝা যাবে, কেন তারা প্রভাবিত হননি এবং বিপরীতে কেন নির্দিষ্ট কিছু মানুষের ক্ষেত্রে ব্রেইন ফগের মত দশা সৃষ্টি হয়ে মস্তিষ্ক অকেজো হয়ে পড়েছে।
এর চিকিৎসা কী?
জান্নাতুল ফেরদৌস একটা বেসরকারি ব্যাংকে কাজ করেন। তিনি বলেন, ছয় মাস আগে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি। এখন অনেকটা সুস্থ কিন্তু তার ভাষায় ‘ভুলে যাওয়ার সমস্যায় জর্জরিত’ তিনি।
জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, ‘আমি ব্যাংকে কাজ করি। হিসেব-নিকেশ মেলাতে বড় ধরনের সমস্যা হয়ে যাচ্ছিল। আমি অনেক কিছুই মনে রাখতে পারছি না। আমি এখন চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ খাচ্ছি।’
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়া বা ব্রেইন ফগ নিয়ে এখনো বিস্তর গবেষণা চলছে। তাই কোনো গাইডলাইন এখনো তৈরি হয়নি এই রোগের চিকিৎসার জন্য।
অধ্যাপক বাহাদুর আলী মিয়া বলেন, এই ক্ষেত্রে অবশ্যই নিউরোলজি বা স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে। এক্ষেত্রে চিকিৎসক তাকে কিছু ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ দেবেন। সঙ্গে সঙ্গে পুষ্টিকর খাবার খাওয়া, ব্যায়াম করা, মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করা বাড়িয়ে দিতে হবে। এছাড়া কাউন্সেলিং এবং চিকিৎসকের পর্যবেক্ষণে থাকা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ব্রেইন ফ্রগ বিষয়টা নির্ভর করে কার মস্তিষ্ক কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার উপর। সেরে ওঠাটাও তার উপরই নির্ভর করে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৭৪০
আপনার মতামত জানানঃ