দক্ষিণ আমেরিকার বিশাল এলাকাজুড়ে আমাজন বনাঞ্চল বিস্তৃত। এই বনভূমির বিশাল অংশ ব্রাজিলের মধ্যে পড়েছে এবং সেখানে বনের গাছ কেটে উজাড় করা হচ্ছে বলে দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ রয়েছে। এসব নিয়ে জলবায়ু সংকট পর্যালোচনায় বরাবরই সমালোচিত হয়ে আসছে ব্রাজিল। এবার নিজেদের তৈরী খাদেই যেন পড়ল ব্রাজিল। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে দেশটিতে ভয়াবহ বন্যা চলছে।
দক্ষিণ আমেরিকার সর্ববৃহৎ রাষ্ট্র ব্রাজিলে ভয়াবহ বন্যার থাবায় অন্তত ১৮ জনের প্রাণহানি ঘটেছে এবং এতে প্রায় ৩৫ হাজার মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছে। দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় এলাকায় বন্যার কারণে বিভিন্ন দুর্ঘটনায় ২৮০ জনের বেশি মানুষ আহত হয়েছেন। স্থানীয় কর্মকর্তারা এরই মধ্যে তথ্যটি নিশ্চিত করেছেন।
বাহিয়া রাজ্যের গভর্নর রুই কোস্টা জানিয়েছেন, বন্যায় প্রায় ৪০টি শহর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিনি জানিয়েছেন, সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ইলহেয়াস শহর।
তিনি বলেন, এটা একটি ভয়াবহ পরিস্থিতি। বাহিয়ার সাম্প্রতিক ইতিহাসে আমি এর আগে এমন ঘটনা দেখেছি বলে মনে পড়ে না। এটা সত্যিই খুব ভয়ঙ্কর। এখানে অনেক বাড়ি-ঘর এবং রাস্তাঘাট পানির নিচে ডুবে গেছে।
বন্যার কারণে ৩৫ হাজারের বেশি মানুষ নিজেদের বাড়ি-ঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন। বাহিয়া রাজ্যের বেসামরিক প্রতিরক্ষা এবং সুরক্ষা সংস্থা এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
শনিবার রাতে ইতাম্বে শহরের ভারি বৃষ্টির কারণে একটি বাধ ভেঙে যাওয়ায় আরও বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ব্রাজিলের আবহাওয়া এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ দুর্যোগ বিষয়ক পর্যবেক্ষণ সংস্থাগুলো সতর্ক করেছে যে, বাহিয়া রাজ্যে আরও বন্যা এবং ভূমিধসের আশঙ্কা রয়েছে।
স্থানীয় সময় শনিবার রাতে বাহিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর ভিত্তোরিয়া দ্য কুঙ্কিয়িস্তার কাছে বেহুগা নদীর ইগুয়া বাঁধ ভেঙে পড়ে। এতে কর্তৃপক্ষ ওই অঞ্চলের, বিশেষ করে ছোট শহর ইতাম্বের বাসিন্দাদের সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়।
রোববার সকালে এর ১০০ কিলোমিটার উত্তরে জুসিয়াপিতে বাড়তে থাকা পানির চাপে দ্বিতীয় আরেকটি বাঁধ ভেঙে পড়ে। এরপর ওই এলাকার বাসিন্দাদের নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার জন্য সতর্ক করা হয়।
এজেন্সিয়া ব্রাসিল জানিয়েছে, কমপক্ষে আগামী মঙ্গলবার পর্যন্ত বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকতে পারে। বাহিয়ার আশেপাশে ভারি বৃষ্টির সতর্কতা জারি করেছে ব্রাজিল ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব মেটেওরোলজি। তবে সোমবার এবং মঙ্গলবার অবস্থার কিছুটা উন্নতি হতে পারে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
করোনা মহামারিতে এমনিতেই বিপর্যস্ত ব্রাজিল তার মধ্যেই এমন বন্যা পরিস্থিতি সাধারণ মানুষকে আরও বিপাকে ফেলেছে। বিশ্বে করোনা সংক্রমণে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এই তালিকায় ব্রাজিলের অবস্থান তৃতীয়।
বৃষ্টির কারণে অন্তত চার লাখ লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অন্তত দুই মাস ধরে চলা ভারি বৃষ্টিপাত হচ্ছে। এতে দেখা দেওয়া বন্যার মধ্যে জরুরি পরিস্থিতির মুখে ৬৭টি শহরের কয়েক হাজার বাসিন্দাকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
বাহিয়ার গভর্নর রুই কোস্টা জানিয়েছেন, বৃষ্টির কারণে অন্তত চার লাখ লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অন্তত দুই মাস ধরে চলা ভারি বৃষ্টিপাত হচ্ছে। এতে দেখা দেওয়া বন্যার মধ্যে জরুরি পরিস্থিতির মুখে ৬৭টি শহরের কয়েক হাজার বাসিন্দাকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
দমকল বাহিনীর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নভেম্বরের প্রথমদিক থেকে শুরু হওয়া বৃষ্টিজনিত কারণে বাহিয়াতে এ পর্যন্ত ১৮ জনের মৃত্যু হয়েছে।
প্রতিদিন একটু একটু করে হারিয়ে যাচ্ছে আমাজনের অরণ্য। ব্রাজিলের আমাজনে গত ১৫ বছরের মধ্যে এ বছর সর্বোচ্চ পরিমাণ বন উজাড়ের ঘটনা ঘটেছে।
ব্রাজিলের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (ইনপে)-র একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, আমাজন বনাঞ্চলে বন উজাড়ের ঘটনা গত বছরের তুলনায় ২২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২০-২১ সময়সীমায় আমাজনের বনাঞ্চলের প্রায় ১৩ হাজার ২৩৫ বর্গ কিলোমিটার (৫ হাজার ১১০ বর্গ মাইল) এলাকার বন উজাড় হয়েছে। ২০০৬ সালের পর থেকে যা সর্বোচ্চ।
এছাড়াও সরকারি তথ্যের বরাত দিয়ে বিবিসি বলছে, আমাজন বনাঞ্চলে প্রায় ৩০ লাখ প্রজাতির গাছ ও প্রাণী রয়েছে। সেখানে বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায়ের ১০ লাখ মানুষ বসবাস করেন। ব্রাজিলের আমাজন বনাঞ্চলে গত ১৫ বছরের মধ্যে চলতি বছর সর্বোচ্চ পরিমাণ গাছ উজাড়ের ঘটনা ঘটেছে।
এর আগে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোয় জাতিসংঘের জলবায়ু বিষয়ক কপ-২৬ সম্মেলনে প্রথম বৃহৎ কোনো চুক্তি হিসেবে বন উজাড় বন্ধের বিষয়ে একমত হন বিশ্বের শতাধিক দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানরা। সেখানে ২০৩০ সালের মধ্যে বন উজাড় শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার বিষয়ে একমত হন তারা। সম্মেলনে বন উজাড় বন্ধের প্রতিশ্রুতি দেওয়া দেশগুলোর মধ্যে ব্রাজিলও ছিল।
গ্লাসগো সম্মেলনকে ঘিরে ২০৩০ সালের মধ্যে বনভূমি নিধনের ইতি টানতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ দেশগুলোর মধ্যে ব্রাজিল অন্যতম। দক্ষিণ আমেরিকার দেশটির প্রেসিডেন্ট বলসোনারো ২০২৮ সালের মধ্যে অবৈধভাবে বন উজাড় ৬০ শতাংশ কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
কিন্তু পরিবেশবাদি সংগঠনগুলো বলছে, বলসোনারোর আমলেই খনন কাজ আর কৃষি জমি তৈরির জন্য বননিধন বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই এই প্রতিশ্রুতি কতটা বাস্তবায়ন সম্ভব তা নিয়ে সন্দিহান তারা।
গ্রিনপিস আমাজন ক্যাম্পেইনের মুখপাত্র রোমুলো বাতিস্তা বলেন, বননিধন এবং আগুন লাগার ঘটনা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে এবং আদিবাসী ও স্থানীয়দের মধ্যে সহিংসতা বেড়ে যাচ্ছে। এই প্রতিশ্রুতি আদৌ বাস্তবতার কোনো পরিবর্তন করবে না।
আইএনপিইর তথ্য-উপাত্ত বলছে, আমাজনে শুধু অক্টোবরেই ১১ হাজার পাঁচশর বেশি আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। গত বছর ছিল ১৭ হাজার তিনশ। কিন্তু ২০১৯ সালের পর এসব ঘটনা দ্রুত বেড়েছে এবং তখন ছিল সাত হাজার নয়শটি।
জীবের জীবনধারণের জন্য অক্সিজেন যতটা জরুরি, পৃথিবীর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে ততটাই গুরুত্বপূর্ণ পৃথিবীর সব রেইনফরেস্ট। রেইনফরেস্ট পৃথিবীর ফুসফুস। এরা কেবল জল, বায়ু, খাদ্য আর ওষুধ উৎপাদনের উৎস নয়; হাজারো প্রাণিপ্রজাতির আশ্রয়দাতা। বায়ুমণ্ডল থেকে গ্রিনহাউস গ্যাস শুষে নেওয়ার শক্তিশালী শোষক।
একুশ শতকের পরিবর্তিত জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব রুখে দিতে সে কারণেই কিংবদন্তি ভূমিকা রয়েছে রেইনফরেস্টগুলোর। এ জন্যই আমাজন অরণ্যের ধ্বংস নিয়ে সারা পৃথিবী উদ্বিগ্ন আজ।
জড়বিজ্ঞান সভ্যতায় বছরের পর বছর ধরে সীমাহীন নগরায়ণের কারণে, শিল্পসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তৈরির কাজে, আসবাবপত্র কিংবা জ্বালানির ব্যবহারে, কৃষিজমির অনুসন্ধানে এবং আরও হাজার রকমের নিষ্ঠুর অভিপ্রায় নিয়ে বিশাল বিস্তীর্ণ বনভূমিকে মানুষ নিঃশেষিত করেছে অপূরণীয় ক্ষতিতে।
বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব এখন স্পষ্ট। জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে নিয়মিতভাবে বন্যা, দাবদাহ, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়ছে। একইসঙ্গে বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাও।
এছাড়া বনের গাছ কেটে ফেললে সেটিও জলবায়ু পরিবর্তনে বিরূপ প্রভাব ফেলে। কারণ গাছ কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে এবং বিপুল পরিমাণে বন উজাড় হলে বায়ুতে ক্ষতিকর এই গ্যাসের পরিমাণ বেড়ে যায়। আর তাই আমাজনে বন উজাড়ের এই ঘটনা পুরো বিশ্বের জন্যই চ্যালেঞ্জ।
এ বছরের আগস্টে জলবায়ু বিজ্ঞানীরা জানিয়েছিলেন, শিল্পায়নের আগে পৃথিবীর যে তাপমাত্রা ছিল সেই তুলনায় এখন গ্রহটি প্রায় ১.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি উষ্ণ। বাড়তে থাকা এই তাপমাত্রা সর্বসাকল্যে ১.৫ ডিগ্রির নিচে থাকা উচিত বলে উল্লেখ করেন তারা। জলবায়ু সংকটের সবচেয়ে মারাত্মক প্রভাব এড়ানোর গুরুত্বপূর্ণ সীমা এটি।
কিন্তু, বর্তমানে বিশ্বব্যাপী গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমতে শুরু করলেও কয়েক দশকে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যাবে। যদি তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকে, তাহলেও চরমভাবাপন্ন পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকেই যাবে।
জলবায়ু পরিবর্তনে মানুষের ক্ষয়ক্ষতি সংক্রান্ত এক গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতি বছর বিশ্বে তাপদাহে যে পরিমাণ মানুষ মারা যায়, তার এক তৃতীয়াংশেরও বেশি মৃত্যুর প্রধান কারণ বৈশ্বিক উষ্ণায়ন।
গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, তাপদাহে মোট মৃত্যুর ৩৭ শতাংশের জন্য দায়ী জলবায়ুর পরিবর্তন।
‘নেচার ক্লাইমেট চেঞ্জ’ নামের একটি জার্নালে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৯১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বিশ্বের ৭৩২টি শহরে চালানো গবেষণায় দেখা গেছে— মানুষের দ্বারা প্রতিনিয়ত যে বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ছে সেটাই এর মূল কারণ।
তবে বিজ্ঞানীরা বলেছেন যে, এটা সামগ্রিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের একটি খণ্ডচিত্র। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে ঝড়, বন্যা, খরায় আরও বেশি মানুষ মারা যায় এবং বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বাড়লে তাপদাহে মৃত্যুর হার বেড়ে যাবে।
ন্যাচার ক্লাইমেট চেঞ্জে প্রকাশিত ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, শুধু উষ্ণতাজনিত কারণে প্রতিবছর বিশ্বে মৃত্যুবরণ করা প্রতি তিনজনের একজনের প্রাণহানির জন্য দায়ী ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক উষ্ণতা। তবে পরিবেশ বিপর্যয়ে ক্ষতির এই হিসাবই সবটুকু নয়। প্রতি বছর বিশ্বে ঘূর্ণিঝড়, বন্যা বা খরায় যতো মানুষ প্রাণ হারান, তাদের বেশিরভাগের মৃত্যুর জন্যও পরিবেশকেই দুষছেন বিজ্ঞানীরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ কথা অনস্বীকার্য যে, আমরা যদি টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জন করতে চাই কিংবা বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রন করতে চাই, আচরণ এবং অভ্যাসগত পরিবর্তন আনার কোনো বিকল্প নেই। তবে অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে, আচরণ ও অভ্যাসগত পরিবর্তন প্রযুক্তি নির্ভর জ্বালানি ও জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত নীতিমালার পরিপূরক হিসেবে কাজ করবে। কিন্তু কখনোই তা প্রযুক্তি নির্ভর নীতিমালার বিকল্প নয়।
তারা বলেন, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও তাপমাত্রা স্বভাবিক রাখতে বৃক্ষ রোপণ বৃদ্ধিতে মানুষের মাঝে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। বনদস্যুদের হাত থেকে বনাঞ্চল রক্ষায় কঠোর আইন প্রণয়ন করতে হবে। অপরিকল্পিত বনাঞ্চল নিধনে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। উদ্যোগ নিতে হবে পরিবেশ ও উষ্ণতা স্বভাবিক রেখে পৃথিবীকে মানুষের বসবাসের উপযোগী করে তুলতে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০৩০
আপনার মতামত জানানঃ