মানুষ জন্মের পর মায়ের মুখ থেকে যে ভাষা শোনে এবং শেখে, সেটাই মাতৃভাষা। সহজ করলে বললে—মায়ের ভাষা। আমরা আমাদের আত্মপরিচয়ের প্রথম সংগ্রাম বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের ৬৯ বছর হতে চললো। প্রতিবারই নতুন নতুন প্রেক্ষাপটে একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের জীবনে আসে। আমরা নগ্নপদে শহীদ মিনারে গিয়ে ভাষা আন্দোলনে আত্মাহুতি দেয়া আমাদের পূর্বসূরিদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করি। এ দিন নিজের ভাষাকে শুদ্ধভাবে বলার ও লেখার প্রতিজ্ঞা করি। কিন্তু জানেন কি? এ শতাব্দীতে প্রতি মাসে হারিয়ে যাবে একটি করে মাতৃভাষা।
ক্যানবেরার অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সাম্প্রতিক এক গবেষণায় উঠে এসেছে যে, সাক্ষরতা হার বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তন, স্থল যোগাযোগে উন্নতি ও এরকম নানা কারণে এ শতাব্দীর শেষে বিশ্বের সাত হাজার ভাষার ২০ শতাংশই কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যেতে পারে। অর্থাৎ, এ শতাব্দীতে প্রতি মাসে হারিয়ে যাবে একটি করে ভাষা।
লিন্ডেল ব্রোমহামের নেতৃত্বে এ গবেষণায় অংশগ্রহণ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানী, গণিতবিদ এবং ভাষাবিদদের সমন্বয়ে গঠিত একটি দল।
বিলীন হয়ে গেছে বা এখনও মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত আছে এমন ৬৫১১টি ভাষার উপর গবেষণাটি পরিচালনা করা হয়। এসব ভাষা বিপন্ন হওয়ার সম্ভাবনার মাত্রা নির্ণয় করেন তারা। নির্ণায়ক হিসেবে ভাষার আইনি স্বীকৃতি, জনসংখ্যা, শিক্ষা নীতি, পরিবেশগত বৈশিষ্ট্য এবং আর্থ-সামাজিক অবস্থার মতো মোট ৫১টি সূচক নির্ধারণ করা হয়।
গবেষণায় উঠে আসে, কাছাকাছি অন্যান্য ভাষা থাকলে সেটি একটি ‘ছোট’ ভাষার বিলীন হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি বাড়ায় না। বড় কোনো ভাষার সান্নিধ্যে থাকলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলো সাধারণত বহুভাষী হয়ে ওঠে।
তবে ভৌগলিক বিচ্ছিন্নতা যেকোনো ভাষার জন্য ঝুঁকির। বিচ্ছিন্ন দ্বীপ, বা উঁচু পাহাড়ের উপত্যকায় বসবাস করা মানুষদের জন্য তাদের নিজস্ব ভাষা ধরে রাখাটা কঠিন হয়ে পড়ে।
গবেষণা দলের প্রধান ব্রোমহ্যাম বলেন, স্থল যোগাযোগের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত হওয়ায় বিশ্বজুড়ে অনেক ভাষা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। কারণ, এসব রাস্তা গ্রামাঞ্চলের সঙ্গে বৃহত্তর শহরগুলোর যোগাযোগ বাড়াচ্ছে। যার ফলে বাণিজ্য বাড়ছে এবং কেন্দ্রীভূত সরকার ও তার সঙ্গে যুক্ত ভাষাগুলোর প্রভাব বাড়ছে।
শিক্ষার হার বৃদ্ধিও বিশ্বজুড়ে স্থানীয় ভাষাগুলোকে শঙ্কটাপন্ন করছে বলে জানান ব্রোমহ্যাম।
তিনি বলেন, ‘এটা খুবই উদ্বেগজনক। কিন্তু তার মানে এই না যে শিক্ষা খারাপ বা বাচ্চাদের স্কুলে যাওয়া উচিত নয়। আমরা বলতে চাই, এ সমস্যা এড়াতে স্কুলে একাধিক ভাষার চর্চা নিশ্চিত করতে হবে। যাতে করে শিশুরা তাদের নিজস্ব আদিবাসী ভাষাকে বিসর্জন না দিয়েই শিক্ষার সুযোগ পায়’।
আদিবাদী ভাষাকে শঙ্কটাপন্ন করার জন্য অনেক আগে থেকেই প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থাকে দায়ী করে আসা হচ্ছে। ভাষাবিদ এবং নৃবিজ্ঞানী মেরিবেথ নেভিনস বলেন, স্কুল ব্যবস্থা যে ভাষাকে শঙ্কটাপন্ন করে, গবেষণায় উঠে আসা এই দাবিটি ‘উদ্বেগজনক’ হলেও ‘বোধগম্য’।
তিনি বলেন, শুধু এক ভাষার ব্যবহার রয়েছে এমন ‘ঐতিহাসিকভাবে সীমাবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে ধাবিত করার জন্য’ স্কুলে শিক্ষার্থীদের সাধারণত একমুখী শিক্ষা দেওয়া হয়ে থাকে।
আঞ্চলিক স্তরের ঝুঁকির কারণগুলোও উঠে এসেছে এই গবেষণায়। যেমন, আফ্রিকার কিছু অংশে ভাষার সংখ্যা হ্রাসের জন্য বড় বড় চারণভূমিকে কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে। আবার ইউরোপে ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা বৃদ্ধি ভাষাকে বিপদগ্রস্থ করছে। স্ক্যান্ডিনেভিয়ার কিছু অংশে এই তাপমাত্রা বৃদ্ধিকেই ‘ভাষা ক্ষয়’-এর কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে।
কেন চরণভূমি ও তাপমাত্রার মতো বিষয়গুলো ভাষাকে বিপদগ্রস্থ করছে তা নিয়ে আরও ভবিষ্যৎ গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে বলে জানান ব্রোমহাম।
ভাষাকে বিপদগ্রস্থ করার জন্য পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থাও একটি বড়সড় কারণ বলে দাবি করেন নেভিনস। তিনি বলেন, এই বিশ্বব্যবস্থা আদীবাদীদের উপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার কারণেই নিজেদের ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে ধরে রাখতে বেগ পেতে হচ্ছে তাদের। বিশ্বায়নের কারণে হারিয়ে যাচ্ছে স্থানীয় সংস্কৃতি ও ভাষাগুলো।
কাছাকাছি অন্যান্য ভাষা থাকলে সেটি একটি ‘ছোট’ ভাষার বিলীন হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি বাড়ায় না। বড় কোনো ভাষার সান্নিধ্যে থাকলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলো সাধারণত বহুভাষী হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশেও বিপন্ন হয়ে যাচ্ছে অনেকগুলো মাতৃভাষা
বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে যে কয়টি কারণে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে তার মধ্যে অন্যতম ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার স্বীকৃতি। কিন্তু সেই বাংলাদেশেই বিপন্ন হয়ে যাচ্ছে অনেকগুলো মাতৃভাষা।
ধারণা করা হচ্ছে ত্রিশ থেকে চল্লিশ বছর পর এসব ভাষার কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না। তেমনি একটি ভাষা হচ্ছে রাঙামাটি সাজেক আঞ্চলের শৌরা ভাষা। এই ভাষায় কথা বলে মাত্র পাঁচ জন মানুষ। পার্বত্য এলাকার রেংমির্চা ভাষা অবস্থাও একই রমক। এ ভাষায় কথা বলে মাত্র জনাচল্লিশেক মানুষ। এদের সবার বয়স পঞ্চাশের ঊর্ধ্বে। ভাষা গবেষকরা মনে করছেন, জীবিত এই মানুষগুলোর মৃত্যুর পরই এই ভাষাগুলোতে কথা বলার মত আর কেউ থাকবে না। ফলে ভাষাগুলো হারিয়ে যাবে চিরতরে।
দিনাজপুরের সীমান্তবর্তী এলাকায় মাত্র ঊনিশটি পরিবারের শখানেক মানুষ কথা বলে ‘কড়া’ ভাষায়। শুধু শৌরা বা রেংমির্চা নয়- এরকম বিপন্ন ভাষার তালিকায় রয়েছে কোদা, মেগাম, পাঙ্গুখুয়া, বম, চাক, আসোচিন, মরু, কুরুক্স, প্নার, সৌরিয়া, খেয়াং, কড়া, খোজী, কন্দু, মুণ্ডা ইত্যাদি ভাষা।
ভাষাবিজ্ঞানীদের ভাষ্য অনুযায়ী দেশে বর্তমানে এরকম বিপন্ন ভাষার পরিমাণ চৌদ্দটি। যার সব কয়টিই আদি ভাষা। এসকল ভাষায় যারা কথা বলেন তাদের উত্তরসূরীরা কেন এ ভাষায় কথা বলছেন না—এমন প্রশ্নের জবাবে ভাষাবিজ্ঞানীরা বলেন, এসব ভাষা শিখে তাদের কোনো লাভ হচ্ছে না। এসব ভাষার কোনো ব্যবহারিক দিক না থাকায় তারা এসব ভাষা শিখতে আগ্রহী হচ্ছে না।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে বাংলাসহ মোট ভাষার পরিমাণ ৪১টি। এর মধ্যে আদিবাসী ভাষা ৩৩ টি। যার ১৫ টিকেই বিপন্ন ভাষা হিসেবে দেখছেন গবেষকরা। এ ছাড়াও ইতোমধ্যে দেশে ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর ভাষার মধ্যে পুরোপুরি হারিয়ে গেছে এমন ভাষাগুলো হলো রাজবংশী, রাই, বাগদি, কোচ, হদি ও ভালু ইত্যাদি।
ওঁরাও, মুণ্ডা, মালো, রাউতিয়া, মুশহর ও শবর ভাষাভাষী লোকেরাও নিজেদের ভাষার অস্তিত্ব রক্ষা করতে পারেনি। গবেষকরা বলছেন, সিং, কর্মকার, গণ্ড, বেদিয়া, বর্মন ও লোহার ভাষাও আগামী কোন এক সময় ঝুঁকির মধ্যে পড়ার সম্ভাবনা আছে।
জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা-ইউনেস্কো মতে, পৃথিবীতে কোনো ভাষায় যদি কথা বলা লোকের পরিমাণ পাঁচ হাজারের কম হয় তবে তা বিপন্ন ভাষা হিসেবে স্বীকৃত হবে। এই হিসেবে বাংলাদেশে বিপন্ন ভাষার পরিমাণ চৌদ্দটি। ভাষা বিজ্ঞানীরা বলেন, বিশ হাজার লোক কথা বলে এমন ভাষাও আমাদের দেশে আছে। তবে আমরা সেগুলোকেও বিপন্ন ভাষার তালিকায় রেখেছি। কারণ এর পরে এই ভাষাগুলোতে কথা বলা বা চর্চা করার মতো কেউ থাকবে না।
পৃথিবীতে ভাষা আছে কতগুলো?
বিচিত্র সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যে ভরপুর এই পৃথিবীতে ভাষা আছে সাত হাজারেরও বেশি। তবে এগুলোর মধ্যে অল্প কিছু ভাষায় নিজের ভাবের আদান প্রদান করেন পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষ। প্রায় সাতশ আশি কোটির মধ্যে ১৫০ কোটির বেশি মানুষ কথা বলেন মাত্র তিনটি ভাষায়—ম্যান্ডারিন, স্প্যানিশ ও ইংরেজি।
পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ভাষাবৈচিত্র্য দেখা যায় আফ্রিকা ও এশিয়ায়, যেখানে ২০০০ এরও বেশি ভাষায় কথা বলে মানুষ। মানচিত্রের আরেক পাশ ইউরোপে ২৫০টি ভাষা ও উপভাষায় কথা বলে মানুষ।
একটি গবেষণায় জানা গেছে, পৃথিবীর দুই তৃতীয়াংশ মানুষ মাত্র ১২টি ভাষায় কথা বলে। কিন্তু সেই অল্প কিছু মানুষ যে ভাষায় কথা বলে সে ভাষাগুলোই তাদের সংস্কৃতিকে ভিন্নভাবে পৃথিবীর বুকে তুলে ধরছে। ৯৬ শতাংশ ভাষায় কথা বলেন মাত্র ৩ থেকে ৪ শতাংশ মানুষ। সাত হাজার ভাষার মধ্যে দুই হাজার ভাষায় কথা বলেন মাত্র ১০০০ মানুষ।
পৃথিবীর এই ভাষাবৈচিত্র্য নিয়ে কাজ করছে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। এরমধ্যে অন্যতম একটি প্রকল্প অ্যাথনোলগ ডাটাবেজ। এই ডাটাবেজে এখনো পর্যন্ত ৭০৯৯ টি ভাষা তালিকাভুক্ত করেছে।
আবার জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অব হিউম্যান হিস্ট্রি এর গ্লোটোলগে ভাষার আরও বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়। গ্লোটোলগে ৮৫০০টি ভাষা তালিকাভুক্ত হয়েছে। ভাষার বিস্তারিত তথ্যের পাশাপাশি এই ডাটাবেজে ভাষার উৎস, শ্রেণী এবং তাদের উপভাষা নিয়ে প্রাথমিক ভৌগলিক তথ্য পাওয়া যায়।
বিশ্বের বিলুপ্তপ্রায় এবং ভাষাগত বৈচিত্র্য পর্যবেক্ষণে কাজ করে ইউনেস্কোর অ্যাটলাস অব ওয়ার্ল্ড’স ল্যাঙ্গুয়েজ ইন ডেঞ্জার। এটি শুধুমাত্র যুক্তরাজ্যেই ১১টি বিপন্ন ভাষা তালিকাভুক্ত করেছে। ইউরোপের ১৪টি ভাষার মধ্যে দুটি ভাষা অতিবিপন্ন অবস্থায় আছে। এগুলো হলো কর্নিশ ও ম্যানএক্স। একমাত্র পুনরুদ্ধারের উদ্যোগই এই দুটি ভাষাকে বিলুপ্ত হওয়া থেকে রক্ষা করতে পারে।
হ্যান্ডবুক অব এনডেঞ্জারড ল্যাঙ্গুয়েজ এর লেখকরা মনে করেন, পৃথিবীর ৫০ থেকে ৯০ শতাংশ ভাষা এই শতাব্দীতেই বিলুপ্ত হতে পারে। প্রথম ধাপে ৫০০ ভাষা বিলুপ্ত হতে পারে যা এখন অনেক জায়গায় বিলুপ্তপ্রায়। কিছু কিছু ভাষা খুব কম মানুষ এমনকি একজনকেও একটি ভাষায় কথা বলতে দেখা যায়।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ভাষাগুলো সংরক্ষণ করতে হলে প্রথমে ভাষাগুলোর প্রশিক্ষক দরকার। প্রশিক্ষকরা বিলুপ্ত প্রায় ভাষার ওই অঞ্চলগুলোতে গিয়ে প্রথমে ভাষাগুলো লিপিবদ্ধ করতে হবে। পরে তা সংরক্ষণ করতে হবে। আর এটি খুবই ব্যায়বহুল। রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতা ছাড়া এ ভাষাগুলো সংরক্ষণ সম্ভব নয়।
আরও বলেন, সেসব ভাষা লিপিবদ্ধ হলেও সংরক্ষণ সহজ হবে না। কেননা, আগামীতে এসব ভাষা চর্চা করার মতো কেউ নেই। ফলে এখন যারা এসব বিপন্ন ভাষায় কথা বলে তাদের মৃত্যুর সাথে সাথেই শেষ হয়ে যাবে এই বিপন্ন ভাষাগুলোর আয়ুষ্কাল। উদাহরণ দিতে গিয়ে সংস্কৃত ভাষা ও ল্যাটিন ভাষার উদাহরণ টানেন যা কাগজে থাকলেও বাস্তবে কারো চর্চায় নেই।
গবেষকরা বলছেন, পার্শ্ববর্তী শক্তিশালী ভাষার চাপে ক্ষুদ্র ও অবহেলিত ভাষা হারিয়ে যাওয়ার উদাহরণ নতুন নয়। তবে জাতিগত সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষায় এ ভাষাগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ একদিকে যেমন অন্যের মাতৃভাষার প্রতি সম্মান দেখানো হয় তেমনি পুনরুদ্ধার সম্ভব হয় অনেক পুরনো সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৩০
আপনার মতামত জানানঃ