মানুষ জন্মের পর মায়ের মুখ থেকে যে ভাষা শোনে এবং শেখে, সেটাই মাতৃভাষা। সহজ করলে বললে—মায়ের ভাষা। আমরা আমাদের আত্মপরিচয়ের প্রথম সংগ্রাম বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছর হতে চললো। প্রতিবারই নতুন নতুন প্রেক্ষাপটে একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের জীবনে আসে। আমরা নগ্নপদে শহীদ মিনারে গিয়ে ভাষা আন্দোলনে আত্মাহুতি দেয়া আমাদের পূর্বসূরিদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করি। এ দিন নিজের ভাষাকে শুদ্ধভাবে বলার ও লেখার প্রতিজ্ঞা করি।কিন্তু জানেন কি? এ শতাব্দীতে প্রতি মাসে হারিয়ে যাবে একটি করে মাতৃভাষা।
ক্রিস্টিনা ক্যালডেরনের বয়স হয়েছিল ৯৩ বছর। ১৭ ফেব্রুয়ারি মারা গেছেন তিনি। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে শুধু এক বর্ষীয়সী নারীরই মৃত্যু হয়নি, মৃত্যু হয়েছে একটি ভাষারও। ভাষাটির নাম ‘ইয়ামানা’।
দক্ষিণ আমেরিকার এই নারী কথা বলতেন প্রাচীন ইয়াগন সম্প্রদায়ের ভাষায়। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ক্রিস্টিনাই ছিলেন এই পৃথিবীর সর্বশেষ ব্যক্তি, যিনি ইয়ামানা ভাষায় কথা বলতে পারতেন। ইয়াগন সম্প্রদায়ের আরও অনেক মানুষ রয়েছেন বিশ্বে, কিন্তু কেউ এখন ইয়ামানা ভাষায় কথা বলেন না।
চিলির ভিলা উকিকা শহরে থাকতেন ক্রিস্টিনা। উলের মোজা বানিয়ে তা বিক্রি করে চলত তার সংসার।
বিশ্বে বিলুপ্তির পথে থাকা ইয়ামানি ভাষাটি টিকিয়ে রেখেছিলেন ক্রিস্টিনা ও তার বোন। ২০০৩ সালে বোন মারা যাওয়ার পর ক্রিস্টিনার নিজের সঙ্গে নিজের কথোপকথনই টিকিয়ে রেখেছিল ভাষাটিকে, এখন সেই ক্রিস্টিনাও আর নেই।
হর্ন অন্তরীপ এলাকায় বসবাসরত ইয়াগান জনগোষ্ঠীর সর্বসাকুল্যে ১২শ’র মতো এখন সদস্য টিকে আছে। তাদের মধ্যেই প্রচলন ছিল ইয়ামানা ভাষার। তবে শব্দের মূল উৎস বোঝাটা কঠিন বলে ক্রিস্টিনাদের পরের প্রজন্ম ইয়ামানি ভাষায় কথা বলা ছেড়ে দেয়।
ক্রিস্টিনার নাতনি লিদিয়া গঞ্জালেস বলেন, ‘তিনি শুধু নিজেই মারা যাননি, তার সঙ্গে আমাদের সংস্কৃতির একটি স্মৃতিও হারিয়ে গেল’।
ইয়ামানা ভাষায় কথা বলতে পারা ক্রিস্টিনা ভাষাটি রক্ষায় সচেষ্ট ছিলেন। একটি অভিধান তৈরিতে হাত দিয়েছিলেন তিনি, সেটি স্পেনিশ ভাষায় অনুবাদও করেছিলেন।
চিলির নতুন সংবিধান প্রণয়নে যুক্ত থাকা লিদিয়া আশা করছেন, এই অভিধানের মাধ্যমে ইয়ামানা ভাষাটি টিকে থাকার পথ তৈরি হলেও হতে পারে।
‘তিনি শুধু নিজেই মারা যাননি, তার সঙ্গে আমাদের সংস্কৃতির একটি স্মৃতিও হারিয়ে গেল’।
বৈচিত্র্যময় বিশ্বের বুক থেকে প্রতিনিয়ত হারিয়ে যাচ্ছে নানা ভাষা। জাতিসংঘ সংস্থা ইউনেস্কো বলছে, প্রতি দুই সপ্তাহে বিশ্বের বুক থেকে বিলীন হচ্ছে একটি করে ভাষা। তার সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের ইতিহাস ও সংস্কৃতির একটি অংশ।
জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো প্রতিবছর ভাষা নিয়ে একটি তালিকা প্রকাশ করে থাকে। ইউনেসকো বলছে, ইতিমধ্যে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে কত ভাষা, তার সঠিক হিসাব তাদের জানা নেই।
ভাষাবিদেরা বিভিন্ন অঞ্চলের হারিয়ে যাওয়া ভাষা গণনা করেছেন। তাদের মতে, ইউরোপ ও এশিয়া অঞ্চল থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে অন্তত ৭৫টি ভাষা। যুক্তরাষ্ট্র অঞ্চল থেকে গত ৫০০ বছরে কমপক্ষে ১১৫টি ভাষা হারিয়ে গেছে। অথচ কলম্বাসের সময়ে ওই অঞ্চলে ভাষা ছিল ১৮০টি।
নিউইয়র্কভিত্তিক সংবাদমাধ্যম কোয়ার্টাজের এক প্রতিবেদন বলছে, ১৯৫০ সালের পর আফ্রিকা অঞ্চল থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে ৩৭টি ভাষা। আর এই সময়ের মধ্যে সারা পৃথিবী থেকেই হারিয়ে গেছে ২৩০টি ভাষা।
সম্প্রতি বিলুপ্ত হয়েছে এমন কিছু ভাষার তালিকা দিয়েছে ইউনেসকো। সেই তালিকায় রয়েছে ‘আক্কালা সামি’, ‘আসেক্স’, ‘উবাই’ ও ’ইয়াক’।
বিলুপ্তির হাত থেকে ভাষাগুলোকে রক্ষাও বিশ্বব্যাপী একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন হয়, যে দিনটি বাংলা ভাষার অধিকার আদায়ের রক্তাক্ত ইতিহাস বহন করছে।
শুধু বিদেশি ভাষাই বিলুপ্তির ঝুঁকিতে আছে এমন নয়। বিলুপ্তির ঝুঁকিতে আছে বাংলাদেশের কিছু ভাষাও। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট ২০১৮ সালে ভাষা নিয়ে একটি গবেষণা করেছিল। সেই গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রচলিত ১৪টি ভাষা বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে। ভাষাগুলো হচ্ছে কুন্দ, খারিয়া, কোদা, সৌরা, মুন্দারি, কোল, মাল্টো, খুমি, পাংখুয়া, রেঙ্গমিচা, চাক, খায়াং, লুসি ও লালেং। এসব ভাষাভাষী মানুষেরা প্রধানত দেশের উত্তরাঞ্চলে, সিলেট অঞ্চলে এবং চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলে বাস করে। তারা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশে ৪১টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী রয়েছে, যারা নিজস্ব ভাষায় কথা বলে। তারা জনসংখ্যার দিক থেকে খুব বেশি নয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সংখ্যা হাজারের ঘর পার হবে না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, হারিয়ে যাওয়া এবং হারাতে বসা এসব ভাষার পরিণতিই বলে দিচ্ছে, ভাষারও যত্ন নিতে হয়। না হলে বাঁচে না। ফি বছর ভাষা দিবস আসে আর যায়, কিন্তু ভাষার আর্তনাদ কারও কানে পৌঁছায় কি? একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আন্তুর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। বিশ্বের অনেক দেশেই এ দিবস ঘটা করে পালিত হয়। কিন্তু ভাষার ভেসে যাওয়া ঠেকাতে কার্যকর কোনো উদ্যোগ আজ অব্দি কোনো দেশ নিতে পেরেছে কি? বিষয়টি নিয়ে ভাবার সময় এসেছে বোধ হয়।
একটি ভাষার মৃত্যু মানে তার সঙ্গে সঙ্গে আরও অনেক কিছুর মৃত্যু। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা সংস্কৃতি, প্রথা, আচরণ ইত্যাদিও মরে যায় তখন, ভেসে যায় কালের স্রোতে।
ভাষাবিদেরা বলেন, কোনো ভাষা এক দিনে মরে না। একটু একটু করে মৃত্যু হয় ভাষার। যেসব ভাষা মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে, তাদের বলা হয় বিলুপ্তপ্রায় ভাষা। পৃথিবীতে এখন বিলুপ্তপ্রায় ভাষার সংখ্যা অনেক।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬৪১
আপনার মতামত জানানঃ