সারা পৃথিবী জুড়েই আদিবাসীদের অস্তিত্ব আজ বিপন্ন৷ দেশে দেশে আদিবাসী ও সংখ্যালঘুদের ওপর গণহত্যা, জবর দখল এবং সংঘাতই এর মূল কারণ। এর ফলে হারিয়ে যাচ্ছে তাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যও৷ হারিয়ে যাচ্ছে ভাষা৷
বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে যে কয়টি কারণে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে তার মধ্যে অন্যতম ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার স্বীকৃতি। কিন্তু সেই বাংলাদেশেই বিপন্ন হয়ে যাচ্ছে অনেকগুলো মাতৃভাষা। নিজেদের ভাষায় শিক্ষাব্যবস্থা না থাকায় হারিয়ে যেতে বসেছে শেরপুরের গারো পাহাড়ের গারো, হাজং, কোচ, বানাই ও ডালুসহ ৬ জাতিগোষ্ঠীর মানুষের ভাষা।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ভাষায় লেখা বই দেয়া হলেও শিক্ষকের অভাবে সেগুলো পড়ানো সম্ভব হচ্ছে না তাদের ছেলেমেয়েদের।
জানা যায়, শেরপুর জেলার শ্রীবরদী, ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ী উপজেলার বিশাল এলাকাজুড়ে গারো পাহাড় অবস্থিত। এ পাহাড়ি এলাকাসহ সারা জেলায় গারো, হাজং, কোচ, বানাই ও ডালুসহ ৬ জাতিগোষ্ঠীর অন্তত ৬০ হাজার মানুষের বসবাস।
এসব গোষ্ঠীর মানুষের আছে আলাদা আলাদা ভাষা, আছে নিজস্ব সংস্কৃতিও। নিজ ভাষায় কথা বলাসহ সামনে এগোতে চান তারা। কিন্তু চর্চা আর সংরক্ষণের অভাবে বিলুপ্তির পথে তাদের মাতৃভাষা।
পরিবারের সুখ-দুঃখের গল্প মাতৃভাষা করলেও এসব জাতিগোষ্ঠীর মানুষের ভবিষ্যৎ স্বপ্নের পথে এগিয়ে যেতে হয় বাংলা ভাষার হাত ধরেই। তাই দিন দিন তাদের মাতৃভাষা হারিয়ে যাওয়ায় আক্ষেপ তাদের।
বয়োজ্যেষ্ঠদের অভিযোগ, তাদের ভাষার চর্চা না থাকায় এখন বাংলা ভাষার মাঝে হারিয়ে যাচ্ছে তাদের মাতৃভাষা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভারতের সীমান্তঘেঁষা বানাইপাড়ায় বেশ কয়েকটি বানাই পরিবার বাস করলেও প্রায় হারিয়েই গেছে ডালু জাতিগোষ্ঠী। ভাষার সঙ্গে হুমকির মধ্যে তাদের সংস্কৃতিও। ভাষার প্রাতিষ্ঠানিক কোনো রূপ না থাকায় হারাতে বসেছে এ দুটি জাতিগোষ্ঠীসহ ৬টির ভাষা ও সংস্কৃতি।
এ ছাড়া সরকার কয়েকটি জাতিগোষ্ঠীর শিশুদের জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে তাদের ভাষায় বই দিলেও তা পড়ানোর মতো কোনো শিক্ষক নেই। তাই নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চার জন্য বিদ্যালয়ে নিজ ধর্মের শিক্ষক চায় ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীরা।
এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে আশা দেখানো হলেও বাস্তবায়ন হয়নি। তাই দ্রুত তাদের মাতৃভাষা টিকিয়ে রাখতে উদ্যোগ নেবে সরকার, এমনটাই প্রত্যাশা ওইসব জাতিগোষ্ঠীর।
বানাইপাড়ার প্রবাধিনী কোচ বলেন, ‘আমরা আমাদের ভাষায় কথা বলতে চাই। কিন্তু বাংলা ভাষায় কথা বলতে বলতে আমাদের ছেলেমেয়েরা আমাগো ভাষা ভুলেই যাচ্ছে। স্কুলে আমাগো ভাষার বই দিছে। কিন্তু সেটা তো পড়ায় না। বাংলাই পড়ায়।’
গজনী এলাকার চাকনী কোচ বলেন, ‘স্কুল-কলেজে আর আমাগো ভাষা শিখায় না। তাই আমাগো পোলাপানরা আমাগো ভাষায় কথা বলতে চায় না। বাংলা ভাষায় কথা কয়।’
স্কুলছাত্র স্বপ্ন হাজং বলেন, ‘আমাগো স্কুলে বাংলা ও ইংরেজি ভাষা পড়ায়। আমাগো ভাষার বই দিছে, কিন্তু স্যার নাই।’
শেরপুর সহকারী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নূরে আলম মির্ধা বলেন, ‘পাহাড়ি উপজেলাগুলোতে জাতিগোষ্ঠী শিক্ষার্থীদের জন্য ভাষা পারদর্শী শিক্ষক নিয়োগের ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। আশা করছি, এ ব্যাপারে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’
নিজেদের ভাষায় শিক্ষাব্যবস্থা না থাকায় হারিয়ে যেতে বসেছে শেরপুরের গারো পাহাড়ের গারো, হাজং, কোচ, বানাই ও ডালুসহ ৬ জাতিগোষ্ঠীর মানুষের ভাষা।
সারা পৃথিবীতে প্রায় ৫৫ কোটি আদিবাসী আছে। আদিবাসী ভাষা আছে ৭ হাজার। আছে প্রায় ৫ হাজার ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি। প্রচলিত ভাষার মধ্যে বর্তমানে ২ হাজার ৬৮০ টি আদিবাসী ভাষা ‘ডেঞ্জার জোনে’ আছে অর্থাৎ বিলুপ্তির পথে।
প্রসঙ্গত, যে ভাষায় ১ হাজারের কম লোক কথা বলে, ওই ভাষা বিলুপ্তির পথে আছে বলে চিহ্নিত করা হয়। গত শতাব্দীতে প্রায় ৬০০টি ভাষা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এই শতাব্দিতেও যদি অবস্থার পরিবর্তন না হয়, তবে প্রায় ৯৫ শতাংশ ভাষা বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে।
মাইনরিটি রাইটস গ্রুপ বা এমআরসি সম্প্রতি তাদের এক প্রতিবেদনে এমনটি জানিয়ে বলেছে, বিশ্বের এই সংঘাত পরিস্থিতি চলতে থাকলে ২১১৫ সালের মধ্যে অন্ততল ৭,০০০ আদিবাসী ভাষা পৃথিবী থেকে চিরতরে হারিয়ে যাবে৷
সংস্থাটির নীতি ও যোগাযোগ পরিচালক কার্ল সোডারবার্গ বলেছেন, যদিও আদিবাসী বা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর এ ধরনের নির্যাতনের ঘটনা নতুন নয়, তবে বর্তমানে তাদের উপর হামলা ও নির্যাতনের ঘটনার মাত্রা ভয়াবহভাবে বাড়ছে৷
তাই নিজেদের পূর্বপুরুষের বসতি থেকে আদিবাসী সম্প্রদায় নির্মূলের সমূহ আশঙ্কা রয়েছে৷ আশঙ্কা রয়েছে তাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি হারিয়ে যাওয়ার, কেননা স্থানভেদে এ সব সংস্কৃতি লালিত হয়৷
ইউনেস্কোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিপন্ন ভাষার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি এমন দেশের তালিকায় আছে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়াসহ আরও কয়েকটি দেশ। তবে অস্তিত্বের সঙ্কটে থাকা সবচেয়ে বেশিসংখ্যক ভাষা আছে ভারতে। দেশটিতে ঝুঁকিতে থাকা ১৯৭টি কথ্য ভাষার মধ্যে ৪২টি ভাষাই হারিয়ে যাওয়ার পথে। দেড়শ কোটি মানুষের দেশ ভারতে ১০ হাজারেরও কম মানুষ কথা বলেন এসব বিপন্ন ভাষায়।
ভাষার জন্য সংগ্রাম করা খোদ বাংলাদেশেই ঝুঁকিতে আছে বম এবং বিষ্ণুপ্রিয়সহ মোট ৫টি ভাষা। পার্বত্য চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহসহ কয়েকটি অঞ্চলে বাস করেন অন্তত ৩০ লাখ ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউটের সমীক্ষার অনুযায়ী বাংলাদেশের ৪১টি ভাষা রয়েছে তার মধ্যে ৩৪টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষা। এরমধ্যে হাতে গোনা কয়েকটির লিখিত রূপ আছে।
খাসি, বম, সাঁওতালসহ কোন কোন ভাষা ইংরেজির মতো রোমান হরফে, হাজং, মালতোসহ কয়েকটি ভাষা বাংলা হরফে আবার চাকমা, মারমা, চাক, মনিপুরী, ম্রো, খেয়াং এমন আরও কয়েকটি ভাষার রয়েছে নিজস্ব বর্ণমালা। কিন্তু সেই বর্ণমালায় শিক্ষার সুযোগ তেমন না থাকায় তার ওপর বাংলা ভাষার চাপের কারণে তাদের নিজস্ব ভাষাগুলো মৌখিকভাবে চর্চা হলেও এর লিখিতরূপ হারাতে বসেছে।
ভাষাবিজ্ঞানীদের ভাষ্য অনুযায়ী দেশে বর্তমানে এরকম বিপন্ন ভাষার পরিমাণ চৌদ্দটি। যার সব কয়টিই আদি ভাষা। এসকল ভাষায় যারা কথা বলেন তাদের উত্তরসূরীরা কেন এ ভাষায় কথা বলছেন না—এমন প্রশ্নের জবাবে ভাষাবিজ্ঞানীরা বলেন, এসব ভাষা শিখে তাদের কোনো লাভ হচ্ছে না। এসব ভাষার কোনো ব্যবহারিক দিক না থাকায় তারা এসব ভাষা শিখতে আগ্রহী হচ্ছে না।
এদিকে পার্বত্য অঞ্চলে সব ভাষাভাষীদের প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ সুনিশ্চিত করা, দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে স্ব স্ব মাতৃভাষায় শিক্ষাব্যবস্থা চালুর দাবিতে রাঙ্গামাটিতে মানববন্ধন করেছে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি)।
শনিবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজের সামনে ঘণ্টাব্যাপী এ মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় দেড়শ’ শিক্ষার্থী অংশ নেন।
মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, ভাষা মানুষের মৌলিক অধিকার। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনে জীবন উৎসর্গ করে যারা নিজেদের মাতৃভাষাকে রক্ষা করেছেন তারাই আজ স্বাধীন দেশের পাহাড়িদের মাতৃভাষাকে উপেক্ষা করে চলছেন। তাদের ভাষা সংরক্ষণ ও প্রাথমিক পর্যায় পর্যন্ত মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভ করতে পারছে না। ২০১০ সালে প্রণীত জাতীয় শিক্ষানীতিতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসমূহের মাতৃভাষা প্রাথমিক ও প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষা লাভের কথা বলা থাকলেও বাস্তবে তার কোনটি প্রতিফলিত হচ্ছে না।
বক্তারা বলেন, সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে ১২টি জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে শুধুমাত্র চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীদের মাতৃভাষার বই ছাপিয়েছে। কিন্তু এগুলো পড়ানোর জন্য দক্ষ শিক্ষক নিয়োগের কোনো ব্যবস্থা করেনি। যার কারণে সরকারের এ উদ্যোগ চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা শিশুদের কাজে আসছে না। অন্যদিকে বাকি ৯টি ক্ষুদ্র ভাষাভাষী শিশুদের জন্য মাতৃভাষার শিক্ষাব্যবস্থার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭০২
আপনার মতামত জানানঃ