বিশ্বে ইসলাম ধর্মের রীতিনীতির ধারক আর কঠোর ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতীক হিসাবে পরিচিতি পাওয়া খোদ সৌদি আরবেই রাজপরিবার থেকে শুরু করে তরুণ প্রজন্ম মজে আছে মদ, মাদক আর নারীতে।
মদ পান করা কিংবা ব্যাভিচারের মতো ‘নৈতিক’ অপরাধের সাজা হিসাবে শিরশ্ছেদ কিংবা চাবুক মারার মতো কঠোর শাস্তি দেয় সৌদি আরব। কিন্তু এমন কড়া আইনের পরও সৌদি তরুণরা অহরহই মেতে থাকছে মদ, মাদক আর নারী নিয়ে উদ্দাম পার্টিতে।
২০১৬ সালে করা দেশটির জাতীয় যুব গবেষণা কেন্দ্রর এক সমীক্ষায় জানা যায়, সৌদি আরবের মাধ্যমিক স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়েদের মধ্যে মাদক আসক্তির প্রবণতা বাড়ছে। বর্তমানে দেশটির স্কুলপড়ুয়া ৩০ শতাংশ ছেলে ও ২৩ শতাংশ মেয়ে মাদকাসক্ত।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সৌদি আরবের মক্কা, যাজান, উত্তর সীমান্তসহ বেশ কিছু অঞ্চলে স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়েদের মধ্যে মাদকাসক্তির প্রবণতা বেড়ে চলেছে।
সৌদির আল-মদিনা সংবাদপত্রের জরিপের তথ্য মতে, দেশটির বিভিন্ন স্কুলের ছাত্র, শিক্ষক ও পরিচালকদের মধ্যে মাদক গ্রহণের হার বেড়েছে। এই ভয়াবহ পরিণতি থেকে যুবকদের রক্ষা করতে হলে সচেতনতা বাড়াতে হবে।
সৌদি আরবের বড় বড় শহরগুলোতে দেদারসে চলে অবৈধ মাদক ব্যবসা। ইয়েমেন এবং সিরিয়া থেকে আসে এমফিটামিন।
ইসলামিক স্টেট (আইএস) যোদ্ধারা সজাগ থাকতে যে শক্তিশালী এমফিটামিন ‘ক্যাপটাগন’ সেবন করে তা সৌদি আরবের ধনী তরুণদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয়। ক্যাপটাগনের বদৌলতে অনেক সময়ই স্পোটর্স কার নিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কসরতও করে সৌদি তরুণরা।
সিরিয়ার সরকার গত মাসেই ক্যাপটাগন নামে একটি মাদকের চালান আটকে দেয়। ৫০০ কিলোগ্রাম ক্যাপটাগনের ওই চালানটি একটি পাস্তার কনটেইনারে করে সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে যাচ্ছিল। ওই ঘটনার কয়েক দিন পরই সৌদি কর্র্তৃপক্ষ ক্যাপটাগনের ৩০ মিলিয়ন ট্যাবলেট জব্দ করে।
কিছুদিন আগেই লেবাননের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বাহিনী রিয়াদের উদ্দেশে যাওয়া চার মিলিয়ন ক্যাপটাগন ট্যাবলেটের একটি চালান আটকে দেয়। জর্ডান হয়ে কফি ব্যাগের মধ্যে লুকানো অবস্থায় ট্যাবলেটগুলো রিয়াদে যাচ্ছিল।
সৌদি আরবে ক্যাপটাগন জব্দ করা ইদানীং খুব সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। গবেষকরা বলছেন, আয়তনে ক্ষুদ্র এই ট্যাবলেট তৈরির প্রক্রিয়া অনেক সহজ। আর সৌদি আরবের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর জন্য সিরিয়া ও লেবাননে ক্যাপটাগন তৈরির অনেক ক্ষেত্র গড়ে উঠেছে। গোটা মধ্যপ্রাচ্যে যত মাদক ব্যবহার করা হয়, এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় সৌদি আরবে।
আরবের ধনীদের জন্য ক্যাপটাগন এক নতুন মাদক। এ মাদকের সেবনকারীদের দীর্ঘসময় ধরে চাঙ্গা রাখলেও, স্বাস্থ্যের ওপর রয়েছে এর ভয়াবহ নেতিবাচক প্রভাব। জাতিসংঘের ড্রাগ অ্যান্ড ক্রাইমের (ইউএনওডিসি) মতে, ২০১৫ ও ২০১৯ সালের মধ্যে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে যত ক্যাপটাগন ধরা পড়েছে তার অর্ধেকই সৌদিতে। সিরিয়া সংকটের সময় ওই অঞ্চলে প্রথমবারের মতো ক্যাপটাগন জনপ্রিয় হয়।
যুদ্ধক্ষেত্রে ক্যাপটাগন ব্যবহার হয় তখন দীর্ঘ লড়াইয়ের জন্য। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সরকার সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ ও তার সরকারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে দেশটির অর্থনীতি চাঙ্গা করার বিষয়টি অন্তরালে চলে যায়। বলা হয়, মধ্যপ্রাচ্যে মাদকের ব্যাপক প্রচলনের পেছনে সিরিয়া সরকারের হাত রয়েছে। ২০১৯ সালে সিরিয়া ও লেবানন থেকে ৫ বিলিয়ন ডলার মূল্যের মাদক পাচার হয় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে।
সৌদিতে ক্যাপটাগনের বাইরে যে মাদক সবচেয়ে বেশি চলে তা হলো গাঁজা। আফগানিস্তান, ইরান ও ইরাক হয়ে সৌদিতে গাঁজা প্রবেশ ছাড়াও লেবানন, সিরিয়া ও জর্ডান থেকেও যায়। সম্প্রতি ইয়েমেন থেকেও যাচ্ছে খাট।
সৌদি আরবের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর জন্য সিরিয়া ও লেবাননে ক্যাপটাগন তৈরির অনেক ক্ষেত্র গড়ে উঠেছে। গোটা মধ্যপ্রাচ্যে যত মাদক ব্যবহার করা হয়, এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় সৌদি আরবে।
সৌদি সরকার ভয় পাচ্ছে যে, প্রাণঘাতী এসব মাদক থেকে প্রাপ্ত অর্থ বিভিন্ন জঙ্গি গোষ্ঠী তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবহার করতে পারে। তারা এই মাদকের উৎপাদন ও বিস্তারের জন্য হিজবুল্লাহকে দায়ী করে আসছে। অথচ সৌদি কর্র্তৃপক্ষ তাদের নিজেদের জনগণের মাদক আসক্তি নিয়ে কিছু বলছে না। গবেষণা বলছে, সৌদিতে ১২ থেকে ২২ বছর বয়সীদের মধ্যে ক্যাপটাগন সেবনের মাত্রা সবচেয়ে বেশি। সৌদিতে যারা মাদকে আসক্ত তাদের ৪০ শতাংশই ক্যাপটাগন সেবন করে।
বিভিন্ন সংস্থা থেকে প্রাপ্ত তথ্য বলছে, সৌদিতে চলমান সংস্কারের আগে থেকেই ক্যাপটাগনের মতো মাদক সামাজিক স্তরে প্রভাব বিস্তার করে। সৌদি আরবের ২৮ বছর বয়সী বাসিন্দা রায়িদ ফরেন পলিসিকে বলেন, ‘আমরা অবশ্যই মাদক নিই। এই একটা মাত্র জিনিস যা আমরা নিতে পারি। আমাদের সামাজিক সংস্কার প্রশ্নে আমরা বিরক্ত। আমরা মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে পারি না। সিনেমা দেখতে পারি না। শুধু কফি দোকানে যাওয়ার অধিকার আছে আমাদের। আমার বন্ধুরা সবাই আফগান থেকে আসা গাঁজা নেই।’
সম্প্রতি সৌদি কাস্টমস কর্তৃপক্ষ জেদ্দা বন্দরে এমফেটামিন ট্যাবলেট এর একটি বিশাল চোরাচালান আটক করেছেন। এই চালানে প্রায় আট লাখ ৮০ হাজার এমফেটামিন ট্যাবলেট পাচার করা হচ্ছিলো।
জেদ্দা ইসলামিক পোর্ট শুল্ক কর্মকর্তারা প্রায় ৮ লাখ ৮০ হাজার ক্যাপটাগন বড়ি পাচারের একটি প্রচেষ্টা ব্যর্থ করেছে, যা নির্মাণের জন্য ব্যবহৃত পেস্টের চালানে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল।
সৌদি প্রেস এজেন্সির এক প্রতিবেদনের বরাত আরব নিউজে বলা হয়েছে যে, জাকাত, কর এবং শুল্ক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে যে চালানটি বিভিন্ন নিরাপত্তা পদ্ধতি ব্যবহার করে চোরাচালান করা হচ্ছিল, তবে অতীতের ন্যায় চোরাচালানের প্রচেষ্টা সফলভাবে প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়েছে।
কর্তৃপক্ষ আরো বলেছে যে এটি সারা দেশে প্রবেশের পয়েন্টগুলিতে শুল্ক নিয়ন্ত্রণ কঠোর করা অব্যাহত রয়েছে।
সম্প্রতি, সৌদি আরবের সীমান্ত কর্মকর্তারা জিজান, নাজরান এবং আসির শহরে ৩৫২ কেজি হাশিশ এবং ৫৪,৩৬৮ কেজি কাট জব্দ করেছে।
বর্ডার গার্ডের মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট কর্নেল মিসফার আল-কুরাইনি বলেছেন, অফিসাররা ৩০জন সৌদি এবং ৩৩ জন বিদেশী নাগরিকসহ ৬৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছে, যাদের মধ্যে ২৩ জন ইয়েমেনি এবং ১০ জন ইথিওপিয়ান নাগরিক রয়েছে।
সৌদি সরকার মাদক চোরাচালানকারীদের গ্রেপ্তার ও দোষী সাব্যস্তদের গ্রেপ্তার করার জন্য সঠিক তথ্যের জন্য আর্থিক পুরস্কারের প্রস্তাব ঘোষণা দিয়েছে।
সব মিলিয়ে সৌদি কর্তৃপক্ষের জন্য মাদকের বিরুদ্ধে লড়াই ভীষণ কঠিন হয়ে পড়েছে। তার ওপরে প্রভাবশালী মাদকসেবীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে গেলেও তাদের হিমশিম খেতে হয়।
তাছাড়া মাদক পাচারকারীরাও অনেক চালাক হয়ে গেছে। যেমন লেবাবন থেকে সৌদিতে কৃষিপণ্য আমদানি নিষিদ্ধ করার পর ক্যাপটাগন উৎপাদকরা এই মাদক লুকানোর এক দারুণ কৌশল বের করেছে। আসবাব ও পানির পাম্পের ভেতর ক্যাপ্টাগন পিল লুকিয়ে সৌদিতে পাচার করছে তারা।
সৌদিকে হয়তো কখনোই সম্পূর্ণ মাদকমুক্ত করা যাবে না, তবে দেশটিতে সুস্থ বিনোদন বাড়ালে মাদক ব্যবহারের পরিমাণ অনেকটাই কমে আসবে বলে আশা করছেন গবেষকরা।
কিছু গবেষকের বিশ্বাস, একঘেয়েমি ও সামাজিক বিধিনিষেধের কারণে সৌদি সমাজে মাদক ব্যবহারের প্রধান কারণ। তারা বলছেন, সিনেমা হলের সংখ্যা বাড়লে, ছেলেমেয়েদের মেলামেশার সুযোগ করে দিলে মাদকের ওপর নির্ভরতা কমবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬৫২
আপনার মতামত জানানঃ