
লিঙ্গবৈষম্য দূর করতে ভারতের দক্ষিণের রাজ্য কেরালায় একটি সরকারি স্কুলে একাদশ শ্রেণির ছাত্র এবং ছাত্রীদের জন্য একইরকম পোশাকবিধি চালু করেছে। ফুল অর্থাৎ পা ঢাকা নীল প্যান্ট এবং ফুলহাতা নীল স্ট্রাইপ শার্ট পরতে হবে পড়ুয়াদের। তবে এই পোশাক বিধি বাধ্যতামূলক নয়। প্রয়োজনে স্কুল পোশাকের সঙ্গে স্কার্ফ জড়িয়ে আসতে পারবেন ছাত্রীরা। যদিও কোঝিকড়ের ওই স্কুলের এমন সিদ্ধান্তে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে দেশটির সংখ্যালঘু মুসলিম সমাজ।
জানা গিয়েছে, ছাত্র এবং ছাত্রী মিলিয়ে সেই স্কুলে একাদশ শ্রেণির পড়ুয়া ২৬০ জন। প্রত্যেকের জন্য এই পোশাকবিধি। এমন পরিবর্তনের আগপর্যন্ত ছাত্রীরা লম্বা কামিজের মতো কেরালার ঐতিহ্যবাহী এক পোশাকের সঙ্গে ঢিলেঢালা ট্রাউজার ও কোমর পর্যন্ত কোট পরত।
জিএইচএসএস বালুসেরি স্কুলের পরিচালন সমিতির সদস্য কে শিবু সংবাদমাধ্যমকে জানান, লিঙ্গবৈষম্য দূর করে ছাত্র এবং ছাত্রীদের জন্য সম পোশাকবিধি চালু করাই উদ্দেশ্য।
কেরালা স্কুল শিক্ষা দফতর বলছে, উচ্চমাধ্যমিক স্কুল হিসেবে জিএইচএসএস বালুসেরি স্কুল প্রথম এই নিদর্শন খাড়া করেছে। যদিও আগে একাধিক প্রাথমিক এবং উচ্চ প্রাথমিক স্কুলে এই পোশাকবিধি কার্যকর হয়েছে।
এই সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে রাজ্যের উচ্চশিক্ষা মন্ত্রী অধ্যাপক আর বিন্দু বলেন, ‘বৈষম্য দূর করে পড়ুয়াদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস তৈরি করতে এই সিদ্ধান্ত। এটা স্বাভাবিক সমাজে রক্ষণশীল কিছু গোষ্ঠী এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করবেন। কিন্তু লিঙ্গভেদ দূর করে মানবসমাজের প্রত্যেকের একই দিকে হাঁটা উচিত। এই বার্তা পৌঁছে দিতেই এমন সিদ্ধান্ত। পাশাপাশি দূর করবে নারী এবং পুরুষের ভেদাভেদ।‘
দিল্লির বিবিসির গীতা পাণ্ডে ও কেরালায় আশরাফ পাদান্না আজ বুধবার প্রকাশিত বিশেষ এক প্রতিবেদনে পোশাক নিয়ে শুরু হওয়া সাম্প্রতিক ওই বিতর্কের ব্যাখ্যা তুলে ধরেছেন।
অধ্যক্ষ ইন্দু আর বিবিসিকে বলেন, এখন যে শিক্ষার্থীরা দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ে, গত বছর তারা দাবি তোলে যে তাদের ছেলেদের মতো পোশাক পরার অনুমতি দেওয়া উচিত। প্রস্তাবটি ছিল যৌক্তিক। তাই অন্যদের মতো তারাও জিনস-টপস পরতে শুরু করে। আর কেরালার আর্দ্র আবহাওয়ার জন্য কোমর পর্যন্ত কোট উপযুক্ত পোশাক নয়।
অধ্যক্ষ আরও বলেন, ‘এরপর বিষয়টি নিয়ে আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনার পর অভিভাবক শিক্ষকদের সংগঠনের (পিটিএ) একটি বৈঠক ডাকি। ওই বৈঠকে অধিকাংশই একমত হওয়ার পর পোশাকরীতি পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিই। এক অথবা দুজন অভিভাবক ছেলেমেয়েদের একই পোশাক নিয়ে উদ্বেগের কথা জানান। আমরা তাদের জানাই, চাইলে মেয়েরা ফুলহাতা শার্ট, হিজাব ও লম্বা কোট পরতে পারবে। কিন্তু মাত্র অল্প কয়েকজন মেয়েকে এসব পোশাক পরতে দেখা যায়।’
বিবিসিকে ইন্দুর পাঠানো কিছু ছবিতে একদল শিক্ষার্থীকে স্কুলের নতুন পোশাক পরে সেলফি তুলতে, হাসতে, মুষ্টি তুলে বিজয় ও আনন্দ উদ্যাপন করতে দেখা যায়।
ছেলেদের মতো মেয়েদের স্কুল পোশাক পরিবর্তনের এমন সিদ্ধান্তে কেরালা রাজ্য সরকারেরও সমর্থন রয়েছে বলে ওই প্রতিবেদনে জানিয়েছে বিবিসি।
বৈষম্য দূর করে পড়ুয়াদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস তৈরি করতে এই সিদ্ধান্ত। এটা স্বাভাবিক সমাজে রক্ষণশীল কিছু গোষ্ঠী এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করবেন। কিন্তু লিঙ্গভেদ দূর করে মানবসমাজের প্রত্যেকের একই দিকে হাঁটা উচিত। এই বার্তা পৌঁছে দিতেই এমন সিদ্ধান্ত। পাশাপাশি দূর করবে নারী এবং পুরুষের ভেদাভেদ।‘
রাজ্য সরকারের শিক্ষামন্ত্রী ভি শিভানকুট্টি বিবিসিকে বলেন, ‘সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পোশাকবিধি ও স্কুলের সম্পূর্ণ পাঠদান ব্যবস্থার পরিবর্তন হওয়া উচিত। আমরা আশা করছি, অন্যান্য স্কুলও এমন উদ্যোগ নেবে।’ তার মতে, এমন উদ্যোগের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে অল্প বয়সেই লিঙ্গবৈষম্য নিয়ে সচেতনতা তৈরি হবে।
যদিও এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে স্কুলের সামনে প্রতিবাদ মিছিল করেছে মুসলিম সংগঠন। অভিভাবকদের সঙ্গে কথা না বলেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্কুল এমনটাই অভিযোগ। জানা গেছে, সুন্নি স্টুডেন্টস ফেডারেশনের ব্যানারে এই প্রতিবাদ সংগঠিত হয়েছে।
সর্বজনীন পোশাকের বিরোধীদের একজন মুসলিম কো-অর্ডিনেশন কমিটির সদস্য মুজাহিদ বালুসেরি। তিনি বিবিসিকে বলেন, অভিভাবক শিক্ষকদের সংগঠনের বৈঠক না ডেকেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে এবং এখন মেয়েদের ট্রাউজার ও ছেলেদের মতো শার্ট পরতে বাধ্য করা হচ্ছে। দরিদ্র পরিবারগুলোর জন্য এটা বড় বোঝা।
বালুসেরির জন্য বড় উদ্বেগ হলো, তিনি এটাকে কেরালার কমিউনিস্ট সরকারের নাস্তিক মতাদর্শ শিশুদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার অংশ বলে অভিযোগ তুলেছেন। এর মাধ্যমে শিশুরা বিপথগামী হবে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘আমরা তো আমাদের (ধর্মীয়) বিশ্বাসের সঙ্গে কোনো ধরনের সমঝোতা করতে পারি না।’
মুজাহিদ বালুসেরি বলেন, ‘মেয়ে ও ছেলেদের আলাদা করার মতো অবশ্যই ভিন্ন পরিচয় থাকতে হবে। মেয়েদের ছেলেদের মতো পোশাক পরার অনুমতি দেওয়ার অর্থ হলো তাদের অবাধ যৌন সম্পর্ক করতে উৎসাহী করে তোলা। এটা লিঙ্গবৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে অবাধ যৌন সম্পর্কের দিকে তাদের ধাবিত করবে।’
কেরালাকে ভারতের সবচেয়ে উদারপন্থী ও প্রগতিশীল রাজ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কেরালা ভারতের একমাত্র নিরক্ষরমুক্ত রাজ্য। রাজ্যটির স্কুলগুলোর মোট শিক্ষার্থীর ৪৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ মেয়ে। এ মেয়েশিক্ষার্থীদের মধ্যে বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পড়াশোনা করে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
সমালোচকেরা অবশ্য বলছেন, সমাজের গভীরে প্রোথিত নারীবিদ্বেষের কারণে ভারতের বাকি অংশের মতো কেরালায় এখনো পুরুষতান্ত্রিকতার বিষয়টি প্রকট।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪১৬
আপনার মতামত জানানঃ