আমাদের দেশে এমন একটা সময় ছিল, যখন মানুষ ঘরের ভেতরে শৌচাগার রাখার কথা কল্পনাও করতে পারত না। চলতি বাংলায় ‘পায়খানা’ শব্দটি উচ্চারণমাত্রই নাক কুঁচকে যেত ঘৃণায়।
অথচ ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, খ্রিষ্টের জন্মের তিন হাজার বছর আগে শৌচাগার ও পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থার প্রচলন শুরু হয়। ২৮০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে মহেঞ্জোদারোতে বাড়ির আঙিনায় দেয়ালের সামনে কিছুটা উন্নত মানের শৌচাগার ছিল।
পৃথিবীর প্রায় ৭৬৩ কোটি মানুষের মধ্যে আনুমানিক ৪২০ কোটি মানুষ শৌচাগার এবং পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থার সুবিধা থেকে বঞ্চিত। অর্থাৎ, প্রতি ১০ জনে ৬ জন বা বিশ্বের ৬০ শতাংশ মানুষের জন্যই প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়াটা বেশ কষ্টকর। কারণ, তাদের ঘরে কোনো শৌচাগার বা পায়খানা নেই।
জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, আজও প্রায় ১০০ কোটির বেশি মানুষ খোলা আকাশের নিচে নদী, খালের পাশে, পুকুরের কোনায় বা রাস্তার পাশে শৌচকর্ম (মলত্যাগ) করে। প্রায় ২০০ কোটি মানুষ পানযোগ্য পানি থেকে বঞ্চিত।
ভয়াবহ ব্যাপার হচ্ছে, মানুষের দৈনন্দিন কাজে, শৌচাগারে ও বিভিন্ন শিল্পকারখানায় ব্যবহৃত পানির ৮০ শতাংশই প্রকৃতিতে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে কোনো পরিশোধন ছাড়া।
পৃথিবীতে প্রতি পাঁচটি স্কুলের মধ্যে একটিতে কোনো শৌচাগার নেই। এর সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়ে বিশেষত নারীশিক্ষায়। কন্যাসন্তানকে স্কুলে না পাঠানোর অন্যতম অজুহাত হিসেবে এই কারণকে দাঁড় করায় অনেক পরিবার।
তার চেয়েও বড় কথা, বিশ্বজুড়ে ৯০ কোটি স্কুলপড়ুয়ার হাত ধোয়ার কোনো সুবিধা নেই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে। এটি মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে। এক উদরাময় রোগের কারণে প্রতিবছর প্রায় সাড়ে চার লাখ মানুষ অকালে প্রাণ হারায়।
আর যেখানে-সেখানে মানববর্জ্যের উপস্থিতির কারণে যে দূষণ, তার সবচেয়ে বড় শিকার নারী ও শিশুরাই। এমনকি পিছিয়ে নেই রাজধানী ঢাকাও। সাম্প্রতিক সময়ে ডেটাফুলের দেয়া তথ্য অনুযায়ী ঢাকার ৯ শতাংশ স্কুলে মেয়েদের পৃথক শৌচাগার নেই।
ঢাকা সিটি কর্পোরেশনে ৩৭৭টি বিদ্যালয়ে সহপাঠের ব্যবস্থা আছে। এর মধ্যে ৩৩টি (৮.৭৫%) বিদ্যালয়ে মেয়েদের জন্য এখনো পৃথক শৌচাগারের ব্যবস্থা নেই।
বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস)’র ২০২০ সালের স্কুল সম্পর্কিত ডেটা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ৮৮.৫% বিদ্যালয়ে মেয়েদের জন্য পৃথক শৌচাগারের ব্যবস্থা আছে। ৩% বিদ্যালয়ের ডেটা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
নূন্যতম ১০টি বিদ্যালয় আছে এমন এলাকার মধ্যে গুলশান, রমনা ও খিলক্ষেতের সব বিদ্যালয়েই মেয়েদের জন্য পৃথক শৌচাগার আছে।
দক্ষিণখানে ২০টি সহপাঠ বিদ্যালয়ের মধ্যে সর্বোচ্চ ৪টি বিদ্যালয়ে নেই পৃথক শৌচাগার। ধানমন্ডি ও পল্লবীতেও ২০টির বেশি বিদ্যালয়, উভয় এলাকায় ৩টি করে বিদ্যালয়ে ছেলে-মেয়েদের জন্য এখনো পৃথক শৌচাগারের ব্যবস্থা নেই।
অন্তত ৫টি বিদ্যালয় আছে এমন এলাকা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তুরাগে সহপাঠ ৬টি বিদ্যালয়ের অর্ধেকেই নেই মেয়েদের আলাদা শৌচাগার। মতিঝিলের ৮টির মধ্যে নেই ১টি বিদ্যালয়ে।
ডিসিসি’তে সহপাঠের ব্যবস্থা আছে এমন বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ২৮৫টিতে বাংলা মাধ্যমে পাঠদান করানো হয়। ৯২টি বিদ্যালয় পরিচালিত হয় ইংরেজি মাধ্যমে।
সারাদেশে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। ২০১৬ সালের তথ্য নিয়ে ‘অ্যানুয়াল সেক্টর পারফরম্যান্স রিপোর্ট-২০১৭’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে জানা যায়, দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ৬৭ শতাংশ স্কুলেই ছাত্রীদের জন্য পৃথক টয়লেট ব্যবস্থা নেই। মাত্র ৩২ দশমিক ৬ শতাংশ স্কুলে ছাত্রীদের জন্য পৃথক টয়লেট ব্যবস্থা রয়েছে। সে হিসাবে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর প্রায় ৬৭ শতাংশই ছাত্রীদের জন্য পৃথক পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থার বাইরে রয়ে গেছে।
প্রতিবেদনের ‘প্রাইমারি স্কুল কোয়ালিটি লেভেল’-এ আরও বলা হয়, সরকারি ১৮ শতাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি শৌচাগারও নেই। আর ২০১৬ সালে ৮১ দশমিক ৭ শতাংশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কমপক্ষে একটি টয়লেট ছিল। একটি টয়লেট বিদ্যমান থাকা স্কুলগুলোতে ছেলে-মেয়েরা যৌথভাবে তা ব্যবহার করে থাকে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জেন্ডারবান্ধব স্যানিটেশন নিশ্চিত করতে হবে। কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যদি একটি টয়লেট থাকে তবে তা ব্যবহারের ক্ষেত্রে মেয়েদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। কমন টয়লেটের পাশে ছাত্রীদের আলাদা টয়লেটের ব্যবস্থা রাখতে হবে। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মেয়েদের জন্য কমপক্ষে একটি টয়লেটের ব্যবস্থা করতে হবে।
কিন্তু বাস্তবতায় অনেক বিদ্যালয় এ সুযোগ-সুবিধার বাইরে রয়ে গেছে। সচেতন অভিভাবক মহল বলছেন, স্কুল স্যানিটেশন-ব্যবস্থা উন্নত না হওয়ায় শিশুদের স্বাস্থ্য উন্নয়ন প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে। শিশুরা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এটা পারিবারিক ও জাতীয় উন্নয়নে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। সামগ্রিক স্কুল স্যানিটেশন ব্যবস্থা উন্নয়নের বিষয়টিকে সামনে আনতে হবে।
এ নিয়ে মূলত ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। যথাযথ প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, শারীরিক প্রতিবন্ধী শিশুরা সহজেই ব্যবহার করতে পারে এমন হবে স্কুলের শৌচাগারগুলো।
কিন্তু কত শতাংশ স্কুলে এমন ব্যবস্থা রয়েছে তার কোনো তথ্যই উল্লেখ করা হয়নি। আরও বলা হয়, প্রতিটি স্কুলেই একটি স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার থাকা উচিত। স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগারের অভাবে অনেক স্কুলে ছাত্রীদের উপস্থিতির তারতম্য ঘটে। অনেকক্ষেত্রে ছাত্রী ঝরে যাওয়ার কারণও এটি।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৪১৮
আপনার মতামত জানানঃ