ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের লাক্ষাদ্বীপপুঞ্জটি স্বভাবত শান্ত ও চুপচাপ। কিন্তু হঠাৎ করেই অঞ্চলটি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে।
ভারতে একের পর এক মুসলিম বিরোধী কার্যকলাপকে উস্কে দিয়ে বর্তমান বিজেপি সরকার। জানা যায়, ভারতের রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলোর মধ্যে কাশ্মির ছাড়া একমাত্র মুসলিমপ্রধান এলাকা লাক্ষাদ্বীপে স্কুলগুলোতে শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির বিধান বাতিল করা হয়েছে। এর মাধ্যমে দ্বীপটিতে প্রচলিত কয়েক দশকের বিধান বাতিল করা হলো।
লাক্ষাদ্বীপ শিক্ষা বিভাগ একটি নতুন ক্যালেন্ডার বানিয়েছে যেখানে দ্বীপের সমস্ত স্কুলে শুক্রবার ওয়ার্কিং ডে আর রোববার ছুটির দিনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। জুমার নামাজের কারণে মুসলিমদের কাছে শুক্রবার বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ হওয়ায় এতদিন মুসলিমঅধ্যুষিত এই দ্বীপপুঞ্জের স্কুলগুলোতে শুক্রবার ছিল সাপ্তাহিক ছুটি।
শুক্রবারের এই ছুটি বাতিল হওয়ার পর লাক্ষাদ্বীপের সাংসদ মোহম্মদ ফইজল বলেছেন, ছয় দশক আগে যখন সার্বিক শিক্ষাকে এগিয়ে নিতে এখানে স্কুল খোলা হয়েছিল, তখন থেকে সাপ্তাহিক ছুটি শুক্রবার আর শনিবার অর্ধদিবস খোলা থাকে। তবে নতুন এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে স্কুলসংশ্লিষ্ট কেউ, জেলা পঞ্চায়েত বা স্থানীয় সাংসদের সঙ্গে কোনো আলোচনাই করা হয়নি।
তিনি আরও বলেন, এমন সিদ্ধান্ত জনতার অধিকারের বিরুদ্ধে, এটা প্রশাসনের একতরফা সিদ্ধান্ত। যখন কোনো স্থানীয় ব্যবস্থায় এমন বদল আসে, তখন মানুষের সঙ্গে আলোচনা করে নেওয়া হয়, কিন্তু এক্ষেত্রে তা হয়নি।
এসব অভিযোগের বিপরীতে সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, প্রশাসন সম্পদের সঠিক ব্যবহার এবং শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ধরে রাখতে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন লাক্ষাদ্বীপ জেলা পঞ্চায়েতের সহ-সভাপতি ও কাউন্সিলর পি পি আব্বাস। লাক্ষাদ্বীপের প্রশাসক প্রফুল খোডা প্যাটেলের কাছে একটি চিঠি লিখে তিনি এ দাবি জানিয়েছেন।
চিঠিতে তিনি লিখেছেন, জাতিগতভাবে লাক্ষাদ্বীপের মানুষ মুসলিম আর তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী শুক্রবার হলো পবিত্র দিন এবং জুমার নামাজ অবশ্যই পড়তে হবে। বিষয়টি নিয়ে আলোচনার আহ্বান জানান তিনি।
এমন সিদ্ধান্ত জনতার অধিকারের বিরুদ্ধে, এটা প্রশাসনের একতরফা সিদ্ধান্ত। যখন কোনো স্থানীয় ব্যবস্থায় এমন বদল আসে, তখন মানুষের সঙ্গে আলোচনা করে নেওয়া হয়, কিন্তু এক্ষেত্রে তা হয়নি।
অপূর্ব নৈসর্গিক সৌন্দর্যে মোড়া লাক্ষাদ্বীপের জনসংখ্যার প্রায় ৯৮ শতাংশই মুসলিম। আরব সাগরের বুকে ৩৬টি কোরাল দ্বীপ নিয়ে গঠিত এই লাক্ষাদ্বীপ। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের নিযুক্ত একজন প্রশাসকই এখানে সরকারের দৈনন্দিন কাজকর্মের তদারকি করে থাকেন। বর্তমানে সেখানে প্রশাসকের দায়িত্বে রয়েছেন সাবেক বিজেপি নেতা প্রফুল খোডা প্যাটেল। এই প্রফুলকে নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহের ঘনিষ্ঠ বলেই ধারণা করা হয়।
সাধারণত খুব সিনিয়র আমলা বা আইপিএস অফিসাররাই এই দায়িত্ব পেয়ে থাকেন। সেখানে প্রফুল খোডার এ দায়িত্বে আসাটা দৃশ্যত ধারার ব্যতিক্রম।
সেখানে প্রফুল খোডা লাক্ষাদ্বীপের দায়িত্বে আসার পর এর আগেও কিছু বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে-
- লাক্ষাদ্বীপে গরুর মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব
- বিলাসবহুল হোটেল ও রিসোর্টগুলোতে অ্যালকোহল বৈধ করা
- যাদের দুটির বেশি সন্তান আছে, তাদের পঞ্চায়েত নির্বাচনে লড়ার অধিকার না দেওয়া
- স্কুলে মিড-ডে মিলে শুধু নিরামিষ খাবার দেওয়ার প্রস্তাব
- উন্নয়নের নামে লাক্ষাদ্বীপ প্রশাসন ব্যক্তি মালিকানার যেকোনো জমি অধিগ্রহণ করতে পারবে
ভারতের কেন্দ্রশাসিত লাক্ষাদ্বীপের প্রশাসককে নিয়ে তৈরি হয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। নতুন প্রশাসক প্রফুল কোডাভাই প্যাটেলের একাধিক সিদ্ধান্ত নিয়ে দেখা দিয়েছে বিতর্ক। গরুর গোশতে নিষেধাজ্ঞা, দুই সন্তানের অধিক সন্তান থাকলে অভিভাবকের পঞ্চায়েত ভোটে দাঁড়ানোর নিষেধাজ্ঞা, অপরাধ প্রবণতা কম থাকলেও গুণ্ডাদমন আইন প্রণয়ন, উন্নয়নের কাজে যেকোনো জমি অধিগ্রহণের ক্ষমতার মতো আইন নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে বিজেপি নেতা প্রফুল প্যাটেল ৯৮ শতাংশ মুসলিম জনসংখ্যাসম্পন্ন এই দ্বীপের জীবনযাপন ও চিরাচরিত ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি ধ্বংস করার চেষ্টা করছেন।
আরব সাগরের দ্বীপটি শুভ্র বালুরাশি ও স্বচ্ছ নীল জলের জন্য পরিচিত। দ্বীপটিকে ভারতীয় মালদ্বীপ বলেও ডাকা হয়। এটির কাছের স্থলভূমি কেরালা। উপকূল থেকে ৫০০ কিলোমিটার অদূরে। ৩৬টি দ্বীপ নিয়ে এটির গঠন। ৬৫ হাজার জনসংখ্যার অধিকাংশই মুসলমান। দ্বীপপুঞ্জটি কেরালা হাইকোর্টের এখতিয়ারাধীন।
পর্যটকদের অন্যতম এই আকর্ষণ দ্বীপপুঞ্জটি ভারতীয় প্রেসিডেন্টের মনোনীত প্রশাসক প্রফুল প্যাটেল। গত বছরের ডিসেম্বরে তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি নতুন একটি খসড়া আইন প্রস্তাব করেছেন, যাতে প্রশাসক হিসেবে শহর উন্নয়ন ও পরিকল্পনার জন্য যে কোনো বাসিন্দাকে তাদের সম্পত্তি থেকে অপসারণ কিংবা স্থানান্তর করতে পারবেন। এই সিদ্ধান্ত অমান্য করলে যে কাউকে তিনি বিনাবিচারে বছরখানেক আটক করে রাখতে পারবেন।
এছাড়া গো-হত্যা বন্ধ, মাদক বিক্রির অনুমোদনও দেওয়ার কথা আছে এই আইনে। ইসলাম ধর্মে যা স্পর্শকাতর হিসেবে দেখা হয়। বর্তমানে দ্বীপটিতে মাদক সেবন ও বিক্রি কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। প্রফুল প্যাটেলের ভারতীয় জনতা পার্টি দেশটির সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে একজাতীয় করে ফেলতে তৎপর। এখন সেই সাংস্কৃতিক সংঘাতের কবলে পড়ে গেছেন দ্বীপপুঞ্জটির বাসিন্দারা।
এদিকে নতুন বিধিনিষেধ উঠিয়ে নিতে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী। এক টুইটপোস্টে তিনি বলেন, লাক্ষাদ্বীপ ভারতের সামুদ্রিক রত্ন। ক্ষমতাসীন উগ্র ধর্মান্ধরা এটি ধ্বংস করে দিচ্ছে। আমি দ্বীপবাসীর পাশে আছি।
এখন কেরালার দিকে তাকিয়ে আছেন সেখানকার বাসিন্দারা। রাজ্যটির বিধানসভায় একটি সর্বসম্মত আইন পাস হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ান এই আইনে সমর্থন দিয়েছেন। এতে লাক্ষাদ্বীপের প্রশাসক হিসেবে প্রফুল প্যাটেলের অপসারণ দাবি করা হয়েছে।
দ্বীপবাসীর জন্য কেরালা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাদের মৌলিক সরবরাহ আসে রাজ্য থেকে— শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও চিকিৎসা সবই।
করোনা নিয়ন্ত্রণে মহামারির বিধিনিষেধ শিথিল করে দিয়েও সমালোচিত প্রফুল প্যাটেল। এতে সেখানে সংক্রমণ বেড়ে গেছে। তিনি বলেন, পর্যটকদের সংখ্যা বাড়াতেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এ পদক্ষেপ থেকে সরে যাওয়ার কোনো পরিকল্পনা নেই।
সিয়াসাত ডটকমের মতে লাক্ষাদ্বীপের জনসংখ্যার ৯৮ শতাংশ মুসলমান এবং প্রধানমন্ত্রী মোদীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী প্রশাসক কর্তৃক অনুমোদিত নীতিমালায় হিন্দুত্ববাদ প্রকল্পের সম্প্রসারণের স্পষ্ট প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, প্যাটেলের বিরুদ্ধে কোভিড-১৯ সম্পর্কিত নিয়মগুলো পুরোপুরি পরিবর্তন করা ও সামাজিক বিধিনিষেধ ভাঙার অভিযোগ আনা হয়েছিল। অনেকেই অভিযোগ করছেন প্রশাসনের উদাসীনতার কারণেই এই দ্বীপের ছোট্ট অঞ্চলটিতে কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ বেড়েছে।
উল্লেখ্য, নরেন্দ্র মোদী যখন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তখন গুজরাটের বাসিন্দা প্রফুল কোডাভাই প্যাটেল ছিলেন রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। মোদির ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে খ্যাত, প্রাক্তন প্রশাসক ও আইপিএস অফিসার দীনশ্বর শর্মা মারা যাওয়ার পরে প্যাটেলকে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে লাক্ষাদ্বীপের প্রশাসক করা হয়েছিল। এর আগে প্যাটেলকে ২০১৬ সালে দমন ও দিউ এবং দাদরা ও নগর হাভেলির প্রশাসক নিযুক্ত করা হয়েছিল। দাদরা ও নগর হাভেলি থেকে স্বতন্ত্র এমপি সদস্য মোহন দেলকারের আত্মহত্যায় তার নাম জড়ায়, যিনি তার ১৫ পৃষ্ঠার সুইসাইড নোটে প্যাটেলের নামও লিখেছিলেন।
তবে ইতোমধ্যেই এই স্বৈরাচারী নীতির বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন বহু বিশিষ্টজন। অভিনেতা ও চলচ্চিত্র নির্মাতা পৃথ্বীরাজ সুকুমারান দ্বীপপুঞ্জের সাথে প্রকাশ্যে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। অভিনেত্রী ও পরিচালক গীতু মোহনদাসও প্রশাসকের কিছু সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেছেন। ফুটবলার সিকে ভিনিথ টুইট করে প্যাটেলের কাজগুলো নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। পপুলার ফ্রন্ট অব ইন্ডিয়া লাক্ষাদ্বীপের অধিবাসীদের হিন্দুত্ববাদী দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে এগিয়ে আসার এবং দেশের সব অগণতান্ত্রিক শক্তিকে প্রতিহত করার আহ্বান জানিয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৩৩
আপনার মতামত জানানঃ