বাংলাদেশে রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারে হত্যা বাড়ছে। বাড়ছে হানাহানি। আর এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলো মূলত ঘটছে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের মধ্যে আধিপত্য নিয়ে। নিজেদের মধ্যেও দ্বন্দ্বের কারণেও ঘটছে হত্যাকাণ্ড। ঘটছে গুপ্ত হত্যা।
সারাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতায় চলতি বছরে অন্তত ১৩০ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৮ হাজার ৫৯৪ জন। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) করা এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
গতকাল রোববার আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) ওয়েবসাইটে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত কয়েকটি জাতীয় দৈনিক ও অনলাইন পত্রিকার প্রকাশিত প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে এ প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, নিহতদের মধ্যে ৫৭ জন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা ও সমর্থক, চারজন বিএনপির নেতাকর্মী ও একজন সাংবাদিক। নিহতদের মধ্যে ৫০ জনের কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই।
নভেম্বর পযন্ত ৬৮৮টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনার খবর প্রকাশ হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে দেখা যায়, আওয়ামী লীগ কর্মীদের ১২ জন নিজেদের দলের মধ্যে লাগা সংঘর্ষে মারা যান। তাদের আটজন আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের, একজন আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের এবং তিনজন যুবলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছেন।
এছাড়া চলতি বছরের জুনে শুরু হওয়া ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে ৪০ জন নিহত হয়েছেন।
অতীতের পরিসংখ্যান
অবশ্য এর আগের বছর ২০২০ সালে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড অনেক কম ছিলো। ওই বছর পুরো ১২ মাসে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ৩১টি। তার মধ্যে নির্বাচনী সংঘাতে মারা গেছে পাঁচ জন।
গত বছর অল্প কিছু নির্বাচন ও উপনির্বাচন ছিলে। এরমধ্যে উপজেলা নির্বাচনে একজন এবং পৌর ও সিটি নির্বাচনে চার জন নিহত হন।
২০১৯ সালে রাজনৈতি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ৩৯টি। তার মধ্যে বিভিন্ন নির্বাচনে নিহত হয়েছেন ২৫ জন। ২০১৮ সাল ছিলো একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বছর। ওই বছর রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ৬৯টি। ২০১৭ সালে রাজনৈতিক হত্যাকান্ড হয়েছে ৫২টি।
আসকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায় ২০১৭ সাল থেকে এপর্যন্ত রাজনৈতিক হত্যা চলতি বছরেই বেশি ঘটেছে। নির্বাচনি খুনও বেশি। আর ১০ মাসেই তা আগের বছরের দুই গুণেরও বেশি। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে হত্যাকাণ্ডও এই ১০ মাসেই বেশি।
সংশ্লিষ্টদের মতামত
চলতি বছরে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড বেড়ে যাওয়ার পেছনে দলীয় প্রতীকে ইউপি নির্বাচনকে দায়ী করছেন বিশ্লেষকেরা। আর এই হত্যাকাণ্ডের সবচেয়ে বেশি শিকার হয়েছেন স্থানীয় পর্যায়ের আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। আওয়ামী লীগের হাতেই আওয়ামী লীগের লোকজন বেশি খুন হয়েছে। বিএনপি দলীয়ভাবে নির্বাচনে নাই।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের বড় একটি অংশ ঘটে বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। তবে আগে যেটা হতো, যে জনপ্রিয় সেই পাস করত। কিন্তু এবার জনপ্রিয়তার সাথে প্রতীক যুক্ত হয়েছ।
বিএনপি যেহেতু নির্বাচনে নেই দলীয়ভাবে তাই আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। প্রার্থীরা মনে করছেন নৌকা প্রতীক পেলে জয়ের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। যারা পাচ্ছেন না তারা বিদ্রোহী হচ্ছেন। ফলে সংঘাত ও হত্যাকাণ্ড বেড়ে যাচ্ছে। এটা কমাতে প্রতীকের বিষয়টি ফের বিবেচনা করা উচিত।
আসকের সাধারণ সম্পাদক ও মানবাধিকার কর্মী নূর খান অলেন, “কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থাও এর জন্য দায়ী। রাজনীতিতে আদর্শহীনতাও এর কারণ।”
তিনি জানান, “এইসব রাজনৈতিক হত্যায় মামলা হলেও শেষ পর্যন্ত বিচার খুব কমই হয়। কারণ যারা হত্যাকাণ্ডে জড়িত তারাও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী । ফলে অনেক মামলাই শেষ পর্যন্ত প্রত্যাহার বা সমঝোতার মাধ্যমে শেষ হয়।”
নূর মোহাম্মদ বলেন,” কিছু বড় বড় রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের বিচার বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে অতীতে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারও আইন করে বন্ধ রাখা হয়েছিলো। এখন যে হত্যাগুলো হচ্ছে তার মামলা ও তদন্ত হয়। তবে পুলিশকে আরো সক্রিয়ভাবে কাজ করতে হবে যেন কেউ যেন রেহাই পেয়ে না যায়।”
তবে বিচারে দীর্ঘ সময় লাগে বলে জানান তিনি। নূর মনে করেন, এটাই বড় একটি সমস্যা। এই কারণে শেষ পর্যন্ত সাক্ষী পাওয়া যায় না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে ‘গণতান্ত্রিক আন্দোলন’ সর্বদাই কৌশলগত এবং রাজপথ নির্ভর থকেছে৷ অথচ তাতে প্রায় কখনোই পুলিশ সংস্কার, বিচারক নিয়োগ ও বিচারবিভাগের স্বাধীনতা এবং ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার কার্যকরতা নিশ্চিত করার অভিপ্রায় বিশ্বাসযোগ্যতা পায়নি৷ অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনগুলো শুধুই ক্ষমতার হাতবদল ঘটিয়েছে৷
থেমে থেমে বাংলাদেশের দীর্ঘ ‘গণতান্ত্রিক আন্দোলন’ কয়েক শত মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে৷ বহু মানুষকে পঙ্গুত্ব দিয়েছে৷ এসব অন্দোলন ব্যাপক ভিত্তিতে সরকারি ও বেসরকারি সম্পদের ধ্বংস দেখেছে৷ সহিংসতার শিকার হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের তারা কখনও ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিষয়ে মনোযোগ দেয়নি৷
আর রাজপথের বা রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডগুলোর সাধারণ প্রবণতাই হচ্ছে বিচার না হওয়া৷ দল বা গোষ্ঠী, যার যখন যেমনই হোক, কেউ নিহত হওয়ার পরে বিচারের আশা ছেড়ে দেওয়াটাই একটা স্বাভাবিক সামাজিক প্রবণতায় রূপ নিচ্ছে৷ যার ফলে ক্রমাগত বৃদ্ধিও পাচ্ছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩১০
আপনার মতামত জানানঃ