দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। আমেরিকার নেতৃত্বে ন্যাটো ও সোভিয়েতের নেতৃত্বে ওয়ারশ জোট গঠিত হয়। এর বাইরে অবশ্য ন্যামও গঠিত হয়। ফলে বিশ্ব তিন ভাগে বিভক্ত হয়। ন্যাটো ও ওয়ারশ জোট পারস্পরিক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। তাতে ব্যাপক সংঘাত ও হানাহানি ঘটে বিশ্বব্যাপী। বহু দেশে ক্ষমতার পালাবদল হয়। বেশিরভাগ দেশ সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করে। এ অবস্থায় ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে খন্ড-বিখন্ড হয়ে পড়ে। ফলে আমেরিকা একক পরাশক্তিতে পরিণত হয় এবং ইচ্ছামাফিক পুঁজিবাদ, মুক্ত বাণিজ্য ও কর্তৃত্ব চাপিয়ে দেয় বিশ্বে।
ইদানিং চীনের আর্থিক ও সামরিকভাবে অকল্পনীয় উন্নতি হওয়ায় সে অনিবার্যভাবে আমেরিকার উপরে জেঁকে বসেছে। ফলে চীনকে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করছে আমেরিকা। ইতোমধ্যে চীনকে প্রধান শত্রু বলে ঘোষণা করে দমন করার উদ্যোগ নিয়েছে, যার প্রধান হাতিয়ার হচ্ছে নিষেধাজ্ঞা। চীনও আমেরিকাকে প্রতিটি পদক্ষেপেরই উপযুক্ত জবাব দিচ্ছে। তবুও আমেরিকা ক্ষান্ত হয়নি।
বর্তমান পরিস্থিতির আলোকে বলা যায় যুক্তরাষ্ট্র ও চীন একটি নতুন স্নায়ুযুদ্ধের সামনে শীঘ্রই দাঁড় করাবে আমাদের। দুই পারমাণবিক পরাশক্তির পরস্পরবিরোধী আদর্শ এবং দ্বিমুখী কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বিতাই রয়েছে এই স্নায়ুযুদ্ধের নেপথ্যে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই নতুন স্নায়ুযুদ্ধ অনেকটা মার্কিন-সোভিয়েত স্নায়ুযুদ্ধেরই পথ অনুসরণ করবে, যেখানে দুই পক্ষেরই লক্ষ্য থাকবে বৈশ্বিক নেতৃত্বের ঝাণ্ডা নিজেদের দখলে নিয়ে আসার, এবং বিশ্বের প্রতিটি দেশকে যেকোনো একটি বেছে নেওয়ার সুযোগ;গণতন্ত্র বা স্বৈরতন্ত্র।
কিন্তু তারপরও এ যুদ্ধ ‘ঠান্ডা’ই রয়ে যাবে, কেননা দুপক্ষের কেউই চায় না, অথবা অদূর ভবিষ্যতেও চাইবে না, সামরিক শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে সম্মুখসমরে লড়াইয়ে নামতে। বস্তুত, যুক্তরাষ্ট্র-চীন নতুন স্নায়ুযুদ্ধ প্রাথমিকভাবে আবর্তিত হবে অর্থনৈতিক, প্রাযুক্তিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতাকে কেন্দ্র করে।
তবে উপরিউক্ত ধারণার সঙ্গে ভিন্নমত পোষণকারী একটি দলও কিন্তু রয়েছে। সেই পর্যবেক্ষকরাও সমান আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ঘোষণা দিয়েছেন, কোনো নতুন স্নায়ুযুদ্ধ আসবে না, কেননা ওয়াশিংটন ও বেইজিং আদতে বৈশ্বিক আধিপত্য কায়েমের জন্য আদর্শিক যুদ্ধে লিপ্ত নয়। চীন গোটা বিশ্বের নেতৃত্ব কিংবা পুঁজিবাদের বিনাশ চায় না। আমেরিকান জীবনধারার প্রতিও তাদের কোনো সর্বব্যাপী বিধ্বংসী মনোভাব নেই।
এদিকে বাকি বিশ্বও নিজেদেরকে আমেরিকান ও চীনা শিবিরে বিভক্ত করবে না, যেমনটি ঘটেছিল প্রথম স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে।
ইতিহাসবিদ মেলভিন লেফলার বলেছেন, স্নায়ুযুদ্ধ ঘটেছিল ১৯৪৫-পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উদ্ভূত নির্দিষ্ট কিছু পরিস্থিতির কারণে। কিন্তু বর্তমানে যে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র পরিচালিত হয়, পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ক্ষমতার যে প্রচলন রয়েছে, এবং বিরোধী পক্ষের শাসনের ব্যাপারে যে আদর্শিক আবেদন রয়েছে, তার সবই একদম ভিন্ন।
এবার যদি আমরা যুক্তরাষ্ট্র-চীনের বিরোধের বর্তমান অবস্থা পর্যবেক্ষণ করি, তাতে কিন্তু অরওয়েলের বেঁধে দেওয়া মানদণ্ডের সঙ্গে তা খুব সহজেই খাপ খেয়ে যায়। যদিও বেইজিং বৈশ্বিক কর্তৃত্ব, গণতন্ত্রের ইতি কিংবা পুঁজিবাদের ধ্বংস চায় না, তবু তারা ঠিকই তাদের ‘চীনা বৈশিষ্ট্যের সমাজতান্ত্রিক’ সরকার ব্যবস্থাকে বৈশ্বিকভাবে জায়েজ করতে চাইছে।
তাছাড়া চীন তাদের সম্পদ, ক্ষমতা ও প্রভাব-প্রতিপত্তিকেও যথাসম্ভব বাড়াতে চাইছে; বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের মতো করে। এতদিন যুক্তরাষ্ট্রই ছিল বৈশ্বিক সম্পদ, ক্ষমতা ও প্রভাব-প্রতিপত্তির শেষ কথা। সেখানে ঠিক একই আকাঙ্ক্ষা যদি অন্য কোনো দেশও লালন করে, এবং সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণের পথে অদম্য গতিতে এগিয়ে যায়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সেই দেশটির ঠোকাঠুকি তো হবেই!
বেইজিংও তাই মনে করছে, ওয়াশিংটন নিয়ন্ত্রণের একটি ডি ফ্যাক্টো পলিসি গ্রহণ করেছে, যেন চীনের বৈশ্বিক প্রভাব বৃদ্ধির গতিতে রাশ টেনে ধরা যায়। ফলে চীনা নেতারা এখন চাইছেন, যে করেই হোক চীনের অগ্রযাত্রার পথে যুক্তরাষ্ট্রের সৃষ্ট প্রতিবন্ধকতাকে গুঁড়িয়ে দিতে। তারা যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশগুলোর দুর্বলতারও ফায়দা লুটতে চাইছেন।
এতে করে দুটো ব্যাপার ঘটছে। দুই বৈশ্বিক পরাশক্তির মধ্যে আন্তর্জাতিক প্রভাব বিস্তারের লড়াইয়ে একটি পদ্ধতিগত আদর্শিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা যেমন দেখা যাচ্ছে, তেমনই আবার গঠনতান্ত্রিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাও উঁকি মারছে। এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার জিরো-সাম হওয়ার প্রয়োজন না পড়লেও, দুই পক্ষই মরিয়াভাবে সে পথে হাঁটছে, এবং সেজন্য পরস্পরকে দায়ীও করছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও চীন উভয়ই একে অন্যের সামরিক সক্ষমতাকে ছাপিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে, আর সেটির নেপথ্যে থাকছে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, স্বার্থ ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার অভিসন্ধি। কোনো তৃতীয় পক্ষকে কেন্দ্র করে দুই দেশের সামরিক বচসাও মাথাচাড়া দিচ্ছে। সামরিক শক্তিকে অদৃশ্যমান অথচ কেন্দ্রীয় বিষয় হিসেবে অধিষ্ঠিত করে তারা রাজনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে একে অন্যকে টেক্কা দেওয়ার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
বাদ যাচ্ছে না যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ব্যবস্থার ব্যাপারেও পরস্পরের সজাগ দৃষ্টিপাত। যুক্তরাষ্ট্র মনে করছে চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টি (সিসিপি) গণতন্ত্রের জন্য হুমকিস্বরূপ। এদিকে বেইজিংয়ের বিশ্বাস, ওয়াশিংটন সিসিপিকে বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক ষড়যন্ত্র আঁটছে।
এই সকল উদাহরণ থেকে একটি বিষয়ই প্রমাণ হয়, তা হলো দুই পক্ষের মধ্যে পরস্পরের প্রতি কৌশলগত সহানুভূতির অভাব। বেইজিং ও ওয়াশিংটন কেউই বিপরীত পক্ষের দৃষ্টিভঙ্গিকে বুঝতে পারে না বা বুঝতে চায় না। এই ব্যাপারটিরই প্রতিফলন ঘটেছে দুই দেশের মধ্যকার সাম্প্রতিক কূটনৈতিক বিনিময়ে।
সেখানে দুই পক্ষই অপর প্রান্তের মানুষটির কথায় কর্ণপাত না করে নিজেদের মতো করে আলাপ চালিয়ে গেছে, এবং পরস্পরের ভাষা নিয়ে কটাক্ষ করেছে। এরকম পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও বিশ্বাসের অভাবই দুই দেশের কৌশলগত উদ্দেশ্যকে আরো প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩০০
আপনার মতামত জানানঃ