শুধু পরিবহন বা কলকারখানায় ব্যবহৃত তেল-গ্যাস জাতীয় জ্বালানি মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর নয়, একই সঙ্গে গ্রামাঞ্চলে মাটির চুলায় রান্নার কাজে বহুল ব্যবহৃত কাঠ-কয়লা, ঘুঁটে, ধানের তুষ, কাঠের গুঁড়া কিংবা বনপাতার জ্বালানির ধোঁয়াও মানুষের শ্বাসতন্ত্র ও হৃদযন্ত্রের জন্য বিপজ্জনক। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউটের (এইচইআই) জানিয়েছে, রান্নার চুলায় (স্টোভ) পোড়ানো কয়লা, কাঠ, গোবর ও শস্যের ফেলে দেওয়া অংশ থেকে সৃষ্টি হওয়া ধোঁয়া ২০১৭ সালে প্রায় ১৮ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটিয়েছে।
বৃহস্পতিবার (১৬ ডিসেম্বর) সংস্থাটি এই সংক্রান্ত একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘গ্লোবাল বার্ডেন অব ডিজিজ-মেজর এয়ার পলুশন সোর্সেস’।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, চুলার আগুনের দহন হৃদযন্ত্রের রোগ, স্ট্রোক, ফুসফুসের ক্যানসার ও শ্বাসযন্ত্রে সংক্রমণের কারণ হতে পারে।
গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, ২০১৭ সালে অ্যামবিয়েন্ট (আউটডোর) পিএম ২ দশমিক ৫ এর কারণে বাংলাদেশে মোট ৬৩ হাজার ৭১৮ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। বাংলাদেশে বায়ু দূষণের অন্যতম মূল উপকরণ পিএম ২.৫ এর সবচেয়ে বড় উৎস হচ্ছে ঘরে ব্যবহৃত জ্বালানি।
গবেষণা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, পরিবেষ্টিত বায়ু দূষণের ২৮ দশমিক ২ শতাংশ আসে গৃহস্থালী জ্বালানি থেকে এবং বিদ্যুৎ থেকে আসে ১২ দশমিক ৪ শতাংশ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের বায়ুদূষণে গৃহস্থালির কাজে ব্যবহৃত জ্বালানির ভূমিকা ২৮.২%। অপরদিকে, গৃহস্থালির কাজের বাইরে অন্যান্য ক্ষেত্রে জ্বালানি ব্যবহারের অবদান ১৪.৪%।
এতে আরও বলা হয়, দেশে রান্নার কাজ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নারীরা করে থাকেন বলে রান্নার ধোঁয়ায় ক্ষতির সম্ভাবনাও তাদের ক্ষেত্রেই বেশি। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের নারীদের স্বাস্থ্যের জন্য রান্নার ধোঁয়াকে হুমকি হিসেবেও উল্লেখ করা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে।
বিশ্বজুড়ে চালানো এ গবেষণায় রান্নাবান্না ও কক্ষ গরম রাখতে কাঠের মতো জ্বালানি ব্যবহারকে বায়ু দূষণের অন্যতম প্রধান কারণ বলা হয়েছে। ফলে প্রায় ৭ লাখ ৪০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। দক্ষিণ এশিয়া ও সাব-সাহারান আফ্রিকা অঞ্চলে প্রাণহানির সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। কয়লার মতো জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানো গেলে ৭ লাখ ৭০ হাজার মৃত্যু কমানো সম্ভব হবে বলেও জানানো হয় প্রতিবেদনে।
জীবাষ্ম জ্বালানির দহন বায়ু দূষণের অন্যতম প্রধান উৎস। প্রতিবেদন অনুযায়ী, এটি ২০১৭ সালে সারা বিশ্বে ১০ লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটিয়েছে, যেটি আউটডোর পিএম ২ দশমিক ৫ এর কারণে হওয়া মৃত্যুর চেয়েও ২৭ শতাংশ বেশি।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, উল্লেখিত মৃত্যুর অর্ধেকের বেশির জন্য দায়ী শুধুমাত্র কয়লার দহন এবং বাকি অর্ধেকের জন্য দায়ী প্রাকৃতিক গ্যাস ও তেলের দহন।
গবেষণা দলটির নেতৃত্ব দেন যুক্তরাষ্ট্রের সেইন্ট লুইসে অবস্থিত ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের এরিন ম্যাকডাফি ও র্যান্ডাল মার্টিন এবং কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইকেল ব্রাউয়ার। তারা প্রথমবারের মতো বিশ্বের সব দেশকে বিবেচনা করে বায়ু দূষণের মূল কারণগুলোকে চিহ্নিত করার জন্য এ রকম স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি বিশ্লেষণী প্রতিবেদন প্রকাশ করছেন।
নতুন এই প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, পিএম ২ দশমিক ৫ এর মূল উৎসগুলো দেশ ও অঞ্চল ভেদে পরিবর্তিত হতে পারে এবং বিশ্বের বিভিন্ন অংশে বায়ু দূষণের প্রভাব ভিন্ন রকম হয়।
জীবাষ্ম জ্বালানির দহন বিভিন্ন শিল্পোন্নত দেশের পিএম ২ দশমিক ৫ এর মূল উৎস হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। অপরদিকে, বাতাসে বয়ে আনা ধূলাকে আফ্রিকার পিএম ২ দশনিক ৫ এর মূল উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।
দেশে রান্নার কাজ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নারীরা করে থাকেন বলে রান্নার ধোঁয়ায় ক্ষতির সম্ভাবনাও তাদের ক্ষেত্রেই বেশি। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের নারীদের স্বাস্থ্যের জন্য রান্নার ধোঁয়াকে হুমকি হিসেবেও উল্লেখ করা হয়েছে।
এইচইআই এর জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ড. পল্লবী পান্থ বলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়ায় বায়ুর গুণগত মান বাড়ানোর জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদন, গৃহস্থালী রান্না ও ঘর গরম রাখা, শিল্প কারখানা, পরিবহন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসহ যেসব খাত পিএম ২ দশমিক ৫ এর মূল উৎস হিসেবে কাজ করছে, সেগুলোকে আমলে নিয়ে সুনির্দিষ্ট উদ্যোগের মাধ্যমে উৎস থেকে নিঃসরণ কমাতে হবে।’
এইচইআই একটি নিরপেক্ষ, অলাভজনক গবেষণা প্রতিষ্ঠান, যার অর্থায়নে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশগত সুরক্ষা সংস্থা (ইপিএ), বিভিন্ন শিল্প, ফাউন্ডেশন ও উন্নয়ন ব্যাংক। প্রতিষ্ঠানটি মূল লক্ষ্য হলো বায়ু দূষণ ও বায়ুর গুণগতমানের সঙ্গে মানুষের স্বাস্থ্যের সম্পর্ক নিয়ে বিশ্বাসযোগ্য ও উচ্চ মানসম্পন্ন বৈজ্ঞানিক তথ্য প্রকাশ করা।
বাংলাদেশে শতকরা ৮৯ শতাংশ বাড়িতে গৃহস্থালিতে রান্নার কাজে কাঠ, গবাদিপশুর গোবর শুকিয়ে রান্নার কাজে ব্যবহার করা হয়। ঘর গরম করার জন্যও এগুলো ব্যবহার হয়। কয়লা, জ্বালানি কাঠ দিয়ে রান্নার কারণে সৃষ্ট ধোঁয়া ও তাপে ঘরে বায়ুদূষণ তৈরি হয়। গ্রামাঞ্চলের স্বল্প আয়ের পরিবারের শিশুরাই এর বড় শিকার।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই বাধা অতিক্রম করতে চাইলে, বাংলাদেশে উন্নত ও পরিষ্কার চুলা ব্যবহারসংক্রান্ত কর্মপরিকল্পনা কৌশল সরকারকে গ্রহণ করতে হবে। আর তা গ্রহণ করলেই ২০৩০ সালের মধ্যে শতকরা ১০০ ভাগ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রান্না ঘরের লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব। এই সময়ের মধ্যে সারা বাংলাদেশে তিন কোটিরও বেশি পরিবারকে উন্নত রান্নার সরঞ্জাম সরবরাহের লক্ষ্য থাকতে হবে। যদি এ লক্ষ্য অর্জন করা যায়, তবে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শিশুকে বায়ুদূষণমুক্ত পরিবেশে রাখা সম্ভব হবে।
এটি নারীদের স্বাস্থ্যর দিকে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বাংলাদেশে একজন নারী রান্নার জন্য গড়ে দিনে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা সময় ব্যয় করেন। আর রান্নাঘরে গড়ে থাকেন দিনে ছয় থেকে আট ঘণ্টা। নারীর সঙ্গে থাকেন সন্তান।
তারা বলেন, ঘরের ভেতরে বায়ুদূষণ রোধ করার সবচেয়ে সস্তা উপায় হলো উন্নত রান্নার চুলা তৈরিতে ব্যাপক বিনিয়োগ করা। এই চুলায় সাধারণত একটি চিমনি থাকে, যা ঘরের ভেতরে ধোঁয়া উদ্গিরণ না করে বাইরে করে এবং তাপের অপচয় রোধ করে রান্নার হাঁড়িতে তাপ ছড়িয়ে দেয়। গতানুগতিক চুলা বা খোলা আগুনে রান্নার চেয়ে এই চুলায় রান্না করা বেশি আরামদায়ক এবং পরিবেশের জন্য কম ক্ষতিকর। এ ধরনের একটি চিমনিসহ দ্বিমুখী চুলা তিন বছর স্থায়ী হয়।
বাংলাদেশের মতো আয় রয়েছে এমন অনেক দেশ রান্নার কাজে বেশি অর্থ খরচ করে এলপিজির মতো আধুনিক জ্বালানি ব্যবহার করছে।
কিন্তু উন্নত মানের চুলা চালু করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বেশ কয়েকবার উদ্যোগ নিয়ে দেখা গেছে, অনেক পরিবারকে নতুন উন্নত মানের চুলায় অভ্যস্ত করানোটা কঠিন। প্রতিটি পরিবার উন্নত চুলাতে অভ্যস্ত না হতে পারলে স্থানীয় বায়ুদূষণ বৃদ্ধির কারণে খুব কমই সুফল পাওয়া যাবে।
তাই বায়ুদূষণ কম হয় এমন রান্নার চুলা ব্যবহারের সুবিধা জানিয়ে প্রচারণা চালাতে হবে। তবেই এর সুবিধা সম্পর্কে সবাই জানতে পারবে। এ-সংক্রান্ত প্রকল্পগুলোর উচিত হবে ক্রেতার পছন্দ অনুযায়ী চুলাগুলো তৈরি করা। এবং চুলা কেনার জন্য পরিবারগুলোকে একাধিক কিস্তিতে মূল্য পরিশোধের ব্যবস্থা করে দেওয়া উচিত, যা তাদের জন্য আরও সাশ্রয়ী হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮১৭
আপনার মতামত জানানঃ