ওমিক্রনে এমন কিছু পাওয়া গেছে যা একেবারেই ভিন্ন, বলেন ড. রিচার্ড লেসেলস, কাওয়াজুলু-নাটাল বিশ্ববিদ্যালয়ে সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ। নভেম্বরের শেষের দিকে বিজ্ঞানীদের যে দলটি এই ভ্যারিয়েন্টকে প্রথমবারের মতো শনাক্ত করেছে তিনি তাদের একজন।
দক্ষিণ আফ্রিকার বিজ্ঞানীরা যখন প্রথমবারের মতো করোনাভাইরাসের সদ্য আবিষ্কৃত ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন সন্ধান পেলেন তখন সবার আগে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে জিনিসটি জানা গেল তা হচ্ছে এই ভ্যারিয়েন্টের প্রচুর রূপান্তর ঘটেছে যা এর আগে কখনো কোনো বিশেষজ্ঞের চোখে পড়েনি।
ড. লেসেলস এবং তার সহকর্মীরা বুঝতে পারেন অস্বাভাবিক কিছু একটা ঘটে গেছে। তারা মনে করেন এই ভ্যারিয়েন্টটি সাহারা মরুভূমির আশেপাশের কোন একটি দেশে এক ব্যক্তির শরীরে রূপান্তরিত হয়েছে, যার রোগ প্রতিরোধী ক্ষমতা দুর্বল ছিল।
তারা মনে করেন সম্ভবত ওই লোকটি এইচআইভিতে আক্রান্ত যার কোন চিকিৎসা হয়নি। এবং তার পরেই ভাইরাসটি ৪০টিরও বেশি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে।
এই ভ্যারিয়েন্টের উৎপত্তি সম্পর্কে অন্তত দুটো বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যা রয়েছে। তবে বেশিরভাগ বিজ্ঞানী এই এক ব্যক্তি থেকে ছড়িয়ে পরার তত্ত্বটিকেই সমর্থন করছেন। কিন্তু এই ভ্যারিয়েন্ট কোত্থেকে এসেছে সেটি কেন গুরুত্বপূর্ণ এবং কীভাবে এর জন্ম হয়েছে?
ওমিক্রনের উৎপত্তি
দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে এই ভ্যারিয়েন্ট সম্পর্কে প্রথম জানানো হয় ২৪শে নভেম্বর। তবে ভাইরাসটি কোথায় এবং কখন পাওয়া গেছে সেটি জানা বিজ্ঞানী ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
বিজ্ঞানীরা বলছেন ওমিক্রন উৎপত্তি সম্পর্কে তাদের কাছে বেশ কিছু ক্লু রয়েছে যা থেকে তারা একটি ধারণা করতে পারেন। ড. লেসেলস বলেন, বর্তমানে যেসব ভ্যারিয়েন্ট রয়েছে সেগুলোর সঙ্গে ওমিক্রন বড় ধরনের পার্থক্য রয়েছে। জেনেটিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে এটি একেবারেই ভিন্ন একটি শাখা থেকে এসেছে।
আরো গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের মধ্যে এর সর্ব-সাম্প্রতিক রূপান্তর বা মিউটেশন সম্পর্কে কোন ট্র্যাক রেকর্ড থাকে না। বিজ্ঞানী লেসেলস বলেন, এই ভ্যারিয়েন্টের সবচেয়ে কাছাকাছি ধরনটি পাওয়া গিয়েছিল ২০২০ সালের মাঝামাঝি কোনো সময়ে।
ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট বিশ্লেষণ করে জানা গেছে নতুন প্রজাতির এই ভাইরাসটিতে ৫০ বার পরিবর্তন ঘটেছে এবং তার মধ্যে ৩০টিরও বেশি ঘটেছে এর স্পাইক প্রোটিনে। স্পাইক প্রোটিন হচ্ছে ভাইরাসটির এমন একটি অংশ যার মাধ্যমে ভাইরাসটি সিদ্ধান্ত নেয় যে এটি কিভাবে মানবদেহের রোগ প্রতিরোধী ব্যবস্থার সঙ্গে লড়াই করবে।
ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের স্পাইক প্রোটিনে পরিবর্তন ঘটেছিল মাত্র সাতবার। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের নজর এড়িয়ে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট কিভাবে তার পূর্বসূরি ভাইরাসগুলো থেকে এতোটা বদলে গেল?
বিশেষজ্ঞদের মতে, যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম তাদের দেহে করোনাভাইরাস দীর্ঘ সময় ধরে থাকতে পারে। যদিও বেশিরভাগ মানুষের শরীর থেকে খুব অল্প সময়ের মধ্যে সার্স কোভ-২ ভাইরাস দূর হয়ে যায়, সারা বিশ্বে চালানো গবেষণায় দেখা গেছে যেসব রোগীর দেহে রোগ প্রতিরোধী ব্যবস্থা দুর্বল তাদের দেহে এই ভাইরাসটি অনেক বেশি দীর্ঘ সময় ধরে থেকে যেতে পারে।
এধরনের লোকের মধ্যে রয়েছে এইচআইভি অথবা ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগী অথবা যাদের শরীরে কোনো অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। তাদের দেহে স্বল্প প্রতিরোধের মুখে পড়ার কারণে ভাইরাসটির মধ্যে অনেক পরিবর্তনের সুযোগ তৈরি হয়। সাধারণত এধরনের মিউটেশনের জন্য কোনো একটি ভাইরাসকে অনেক লোকজনের মধ্যে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে হয়।
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা যুক্তরাজ্যে কোভিডে মারা গেছেন এমন একজন ক্যান্সার রোগীর কাছ থেকে নমুনা সংগ্রহের পর ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। ওই রোগী মারা যায় আগস্ট মাসে। গবেষকরা দেখতে পান ওই রোগীর দেহে যে ভাইরাস আক্রমণ করেছিল তাতে এমন একটি পরিবর্তন ঘটেছে যা আলফা ভ্যারিয়েন্টেও দেখা গিয়েছিল।
এই ভ্যারিয়েন্টটিকেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রথমবারের মতো “উদ্বেগজনক ভ্যারিয়েন্ট” বলে উল্লেখ করেছিল যা যুক্তরাজ্যেই গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে পাওয়া গিয়েছিল। প্রাথমিকভাবে শনাক্ত হওয়ার ১০১ দিন পরেই ওই রোগীর মৃত্যু হয়।
সাধারণত কোনো ব্যক্তির শরীরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মাত্র সাতদিন স্থায়ী হয়। ভাইরাসটির মধ্যে পরিবর্তনের জন্য এই সময় যথেষ্ট নয়, কারণ ওই ব্যক্তির রোগ প্রতিরোধী ব্যবস্থা ভাইরাসটির সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত থাকে। যাদের দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল তাদের দেহে সংক্রমণ ঘটলে ভাইরাসটির মধ্যে পরিবর্তনের সুযোগ তৈরি হয়।
ভাইরাসটির বিকাশের জন্য এমন একটি রোগ প্রতিরোধী ব্যবস্থা প্রয়োজন যা কার্যকরী নয় কিম্বা আংশিকভাবে কার্যকরী নয়। এদিকে, আফ্রিকায় সাহারা মরুভূমির আশেপাশের দেশগুলোতে প্রায় ৮০ লাখ মানুষ এইচআইভির চিকিৎসা পাচ্ছে না।
ড. লেসেলস এবং তার সহকর্মীরা দক্ষিণ আফ্রিকায় এইচআইভিতে আক্রান্ত এক নারীর করোনাভাইরাসের নমুনার ওপর গবেষণা পরিচালনা করেন। ওই নারীর এইচআইভির কোনো চিকিৎসা হয়নি। গত জুন মাসে এই গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হয়।
তারা বেশ কয়েকবার ওই নমুনার জেনেটিক বিশ্লেষণ করে দেখেছেন যে তার মধ্যে “বড় ধরনের কিছু পরিবর্তন” ঘটেছে। গবেষকরা সতর্ক করে দেন যে এর ফলে জনস্বাস্থ্যে সঙ্কটের সূচনা ঘটতে পারে।
ড. লেসেলস এবং তার সহকর্মীরা বিজ্ঞান সাময়িকী নেইচারে ১লা ডিসেম্বরে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলেন, আফ্রিকাতে সাহারা মরুভূমির আশেপাশের দেশগুলোতে ৮০ লাখের মতো মানুষ এইচআইভিতে আক্রান্ত যাদের বর্তমানে কার্যকরী অ্যান্টিরেট্রোভাইরাল থেরাপি দেওয়া হচ্ছে না। এদের মধ্যে আরো অনেকে রয়েছেন যাদেরকে এই রোগের ব্যাপারে কখনো পরীক্ষাই করা হয়নি। আর এখানেই নতুন এই ভ্যারিয়েন্টের জন্ম ও ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
আপনার মতামত জানানঃ