দেশে করোনা সংক্রমণ ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে যাওয়ার মূল কারণ হবে উদাসিনতা। সংক্রমণের চতুর্থ ঢেউ চলার পরিপ্রেক্ষিতে অফিস-আদালত, ধর্মীয় প্রার্থনার স্থান, গণপরিবহন দোকান, শপিংমল, বাজার, ক্রেতা-বিক্রেতা, হোটেল রেস্টুরেন্টে সবাইকে বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক পরাসহ ছয় দফা নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। তবে মাস্ক পরতে উদাসিনতা দেখা গেছে সাধারণ জনগণের মধ্যে। অধিকাংশই মাস্ক পরছে না, স্বাস্থ্যবিধি মানছে না।
কারো-কারো সঙ্গে মাস্ক থাকলেও না পরে সেটি পকেটে, হাতে বা গলায় ঝুলিয়ে রাখছেন। আবার অনেকের জ্বর, সর্দি-কাশিসহ করোনার উপসর্গ থাকলেও পরীক্ষা না করে সব জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এতে অন্যদের ব্যাপক হারে সংক্রমিত করা হচ্ছে। করোনার পরীক্ষা এখন অনেক সহজ করা হয়েছে, কিন্তু তারপরও মানুষের উদাসিনতা দেখা যাচ্ছে।
স্বাস্থ্যবিধি মানা ও পরীক্ষা করার ক্ষেত্রে জনগণের এমন উদাসীনতা চলতে থাকলে করোনা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কা করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, ইতিমধ্যে সারাদেশে ঘরে ঘরে জ্বর, সর্দি-কাশি দেখা দেখা দিয়েছে। সামনে ঈদুল আযহা। তাই করোনা থেকে নিরাপদ থাকতে চাইলে সবাইকে মাস্ক পরতে হবে। সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে হবে।
ইতিমধ্যে সরকার একটি নির্দেশনা দিয়েছে, তবে তার বাস্তবায়ন চোখে পড়েনি। নো মাস্ক, নো সার্ভিস নির্দেশনা বাস্তবায়নে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে। একই সঙ্গে জনগণকে সচেতন হতে হবে। নইলে তৃতীয় ঢেউয়ের চেয়ে চতুর্থ ঢেউয়ে মারাত্মক বিপর্যয় দেখা দেবে। চিকিৎসা পেতে আইসিইউয়ের জন্য আবারো হাহাকার শুরু হবে।
দেশে করোনা ভাইরাসের চতুর্থ ঢেউ ইতিমধ্যে আট বিভাগের ৪৯ জেলায় ছড়িয়েছে। সংক্রমণ ফের বাড়তে থাকার মধ্যে মৃত্যুও বেড়েছে। আর সামনেই মুসলামনদের বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদ-উল-আজহা৷ স্বাস্থ্য বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, স্বাস্থ্যবিধি না মানলে আসছে উৎসবে করোনা আরো বিস্তৃত হবে৷
তাদের মতে, সবচেয়ে সংকট তৈরি করছে বুস্টার ডোজ নেয়ায় মানুষের অনাগ্রহের বিষয়টি৷ আর করোনার নতুন উপধরন উদ্বেগ ছড়াচ্ছে৷ কারণ এখন এই উপধরনের দাপট চলছে বলে জানান তারা৷
সরকারের হিসেব অনুযায়ী, গত ২০ জুন শনাক্তের হার শতকরা ১০ ভাগ ছাড়িয়ে গেছে৷ ওই দিন সারাদেশে করোনায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিলো ৮৭৩ জন৷ মারা গেছেন একজন৷ আক্রান্তের হার ছিল শতকরা ১০ দশমিক ৮৭ ভাগ৷ আক্রান্তের এই হারকে করোনার উচ্চমাত্রা বলা হয়৷
এরপর ১২ দিনের মাথায় গত ২ জুলাই মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক হাজার ১০৫ জন৷ মারা গেছেন ছয় জন৷ আক্রান্তের হার ১৩ দশমিক ২২ ভাগ৷ তার একদিন আগে ১ জুলাই আক্রান্ত হয়েছেন এক হাজার ৮৯৭ জন৷ মারা গেছেন পাঁচ জন৷ আক্রান্তের হার ১৫ দমমিক ৩১ ভাগ৷
গত ১২ দিনে দেশে আক্রান্ত হয়েছেন মোট ১৯ হাজার ৫৮৭ জন৷ আর মারা গেছেন ২৮ জন৷ এ পর্যন্ত সারাদেশে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ১৯ লাখ ৭৬ হাজার ৭৮৭ জন৷ মারা গেছেন ১৯ হাজার ১৬০ জন৷
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কামরুল ইসলাম বলেন, করোনা আবার বিশ্বের ১১০টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে৷ বাংলাদেশে প্রথমে ঢাকা শহরে চতুর্থ ঢেউ শুরু হলেও এখন দেশের সব বিভাগ ও জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে৷ এখন আমাদের স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে৷
তা না হলে সামনে কোরবানির সময়ে এটা আরো বেশি আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারে৷ সরকার মাস্ক আবার বাধ্যতামূলক করার কথা বলেছে৷ কিন্তু এটা মনিটরিং করা হচ্ছে না৷ গরুর হাট বসে গেছে কিন্তু সেখানে কেউ স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না৷ আর ঈদযাত্রায় যদি স্বাস্থ্যবিধির প্রতি এই উদাসীনতা থাকে তাহলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে বাধ্য৷
তিনি বলেন, উদ্বেগের বিষয় হলো মৃত্যুহার বাড়ছে৷ যারা বয়স্ক, যাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম তাদের জন্য বিপদ বেশি৷ এবার দেখছি কেউ টেস্ট করাতে চাচ্ছেন না৷ করোনার সব উপসর্গ থাকার পরও টেস্ট করাচ্ছেন না৷ এর ফলে করোনা তাদের মাধ্যমে আরো দ্রুত ছড়াচ্ছে৷
সবাইকে টিকা ও বুস্টার ডোজ নেয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, টিকা ও বুস্টার ডোজ যারা নিয়েছেন তারাও আক্রান্ত হচ্ছেন৷ এর কারণ হলো টিকার কার্যকারিতা থাকে ছয় মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত৷ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ চতুর্থ ডোজ শুরু করেছে৷ আরো কিছুটা দেখে আমাদের চতুর্থ ডোজের ব্যাপারে চিন্তা করা উচিত৷
বাংলাদেশে গত বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে করোনার টিকা দেয়া শুরু হয়৷ সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত দেশে ১২ কোটি ৯০ লাখের বেশি মানুষ টিকার প্রথম ডোজ পেয়েছেন৷ দুই ডোজ পেয়েছেন ১১ কোটি ৮০ লাখের কিছু বেশি মানুষ৷ আর বুস্টার ডোজ নিয়েছেন দুই কোটি ৯৩ লাখ ১৫ হাজার মানুষ যা মোট জনগোষ্ঠীর ২৪ দশমিক ২৪ শতাংশ৷
১২ থেকে ১৭ বছর বয়সি এক কোটি ৭৩ লাখ শিশু-কিশোর প্রথম ডোজ পেয়েছে৷ দুই ডোজ পেয়েছে এক কোটি ৪১ লাখ৷ সরকার চলতি জুলাই মাস থেকে পাঁচ থেকে ১২ বছর বয়সি শিশুদের টিকা দেয়া শুরু করবে৷
রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মোশতাক হোসেন জানান, ‘‘আমরা আগেই দেখেছি টিকাকে চ্যালেঞ্জ করে করোনা মানুষকে সংক্রমিত করছে৷ এখন যারা আক্রান্ত হচ্ছেন ও মারা যাচ্ছেন তারা বিএ ফাইভ উপধরনে আক্রান্ত হচ্ছেন৷ এর ক্ষতি করার ক্ষমতা বেশি৷ আক্রান্তরা গত তিন সপ্তাহ আগে আক্রান্ত হয়েছেন৷ এখন তা প্রকাশ পাচ্ছে৷ আজ (শনিবার) সংক্রমণ কিছুটা কমলেও আমার ধারণা মৃত্যু হার আরো বেড়ে যাবে৷’’
তিনি বলেন, ‘‘তিন মাস আগে করোনায় মৃত্যু যখন শূণ্যের কোঠায় নেমে আসে তখন আমরা উদাসীন হয়ে পড়ি৷ টিকার প্রতি আগ্রহ সরকার, সাধারণ মানুষ সবারই কমে যায়৷ এটা ঠিক হয়নি৷ আমরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরব, তবে সতর্ক থাকব৷ কিন্তু সেটা হয়নি৷ দায়িত্বশীল ব্যক্তিরাও মাস্ক ছাড়া প্রকাশ্যে চলাফেরা শুরু করেন৷ যা এখন নতুন করে বিপদ ডেকে আনছে৷’’
তার কথা, ‘‘সামনে কোরবানি৷ গরুর হাট বসে গেছে৷ এখানে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে৷ পদ্মা সেতু হওয়ার কারণে ফেরির গাদাগাদি হয়তো কমবে৷ তারপরও ঈদযাত্রায় স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে৷ টিকা কার্যক্রম আবার জোরদার করতে হবে৷ আমাদের পর্যাপ্ত টিকা আছে৷’’
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন টেস্ট অনেক কম হচ্ছে৷ টেস্ট অনেক বাড়িয়ে দেয়া উচিত এবং বিনামূল্যে করা উচিত৷ তাহলে বাস্তব চিত্র যেমন বোঝা যাবে তেমনি পজিটিভ লোককে নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে৷ তবে সেজন্য সরকারকে গরিব মানুষের প্রতি আর্থিক সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে৷ তা না হলে তারা টেস্ট করাবেন না৷ তারা দিন আনেন দিন খান৷ তাদের আক্রান্ত হয়ে ঘরে থাকতে হলে আয় বন্ধ হয়ে যাবে৷
এদিকে, গত ১৬ জুন থেকে প্রতি দিনই পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার টানা ১৪ দিন ৫ শতাংশের বেশি হওয়ায় এরই মধ্যে বাংলাদেশের করোনার চতুর্থ ঢেউ ছড়িয়ে পড়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে।
যেদিন চতুর্থ ঢেউয়ের বিষয়টি নিশ্চিত হয়, তার আগের দিন মঙ্গলবার সরকারের পক্ষ থেকে যে নির্দেশনা দেওয়া হয়, তাতে ধর্মীয় প্রার্থনার স্হান, শপিংমল, বাজার, হোটেল-রেস্টুরেন্টে সবাইকে বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক পরতে হবে। মাস্ক না পরলে আইনানুগ ব্যবস্হা গ্রহণ করা হবে। কিন্তু এতে ভ্রূক্ষেপ নেই সাধারণের। মাস্ক পরছে না অধিকাংশ মানুষ।
জনস্বাস্হ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু নির্দেশনা দিলেই এই পরিস্হিতির পরিবর্তন আসবে না। এই নীতি বাস্তবায়নে প্রশাসনকে মাঠে থাকতে হবে
এসডব্লিউ/এসএস/১৫৫৮
আপনার মতামত জানানঃ