মার্কিন রোগনিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রের (সিডিসি) তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রেও বর্তমানে করোনা সংক্রমণের ক্ষেত্রে খুব সম্ভব বিএ.৪ ও বিএ.৫ উপধরনের প্রভাবই বেশি। নতুন সংক্রমণের ঘটনার ৫২ শতাংশের পেছনে রয়েছে এ দুই উপধরন। সামনের সপ্তাহগুলোতে এই সংক্রমণ আরও বাড়তে পারে। দুটি উপধরনই প্রথম শনাক্ত হয় দক্ষিণ আফ্রিকায়। বিএ.৪ শনাক্ত হয় গত জানুয়ারিতে এবং বিএ.৫ গত ফেব্রুয়ারিতে। এ পর্যন্ত দেশটিতে করোনার প্রভাবশালী ধরন হিসেবে কাজ করছে এই দুই উপধরন।
দক্ষিণ আফ্রিকার বিজ্ঞানীরা সার্স কোভ-২ ভাইরাসের নমুনার জিনোম সিকোয়েন্স (জীবনরহস্য বা জিন নকশা উন্মোচন) নিয়ে অন্য দেশগুলোর তুলনায় বেশি কাজ করছে। এতে উপধরন দুটির উৎপত্তি দক্ষিণ আফ্রিকা ছাড়া অন্য কোনো দেশে হওয়াটাও সম্ভব। তবে দক্ষিণ আফ্রিকার বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মতো ওমিক্রনের উপধরন দুটি শনাক্ত করেন। এ দুই উপধরনেরও ব্যাপক মিউটেশন (রূপান্তর) ঘটবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সর্বশেষ তথ্য–উপাত্ত অনুযায়ী, জার্মানি, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, ইতালি, স্পেন, গ্রিস, ডেনমার্কসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ এবং যুক্তরাষ্ট্রে করোনার সংক্রমণ এখন ঊর্ধ্বমুখী। এ প্রবণতা সবচেয়ে বেশি পর্তুগালে। প্রতি গ্রীষ্মে অবকাশযাপনে অনেকের জনপ্রিয় গন্তব্যস্থলগুলোর একটি হয়ে ওঠে দেশটি। ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসের বিশ্লেষণ করা উপাত্তে দেখা যায়, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্যসহ কয়েকটি দেশে করোনায় আক্রান্ত রোগীর হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ঘটনা বাড়ছে।
সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের অফিস ফর ন্যাশনাল স্ট্যাটিসটিকস (ওএনএস) একটি পরিসংখ্যানের কথা প্রকাশ করে। পরিসংখ্যান বলছে, সপ্তাহে সপ্তাহে করোনার সংক্রমণ ৪৩ শতাংশের মতো বাড়ছে।
এ তথ্যের ওপর মন্তব্য করতে গিয়ে ইংল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব বাথের গণিত বিভাগের সিনিয়র লেকচারার কিট ইয়েটস ইনডিপেনডেন্ট এসএজিই (ব্রিটিশ সরকারকে পরামর্শদানকারী বিজ্ঞানীদের একটি দল)–এর বৈঠকে বলেছেন, ওএনএসের সর্বশেষ পরিসংখ্যানে এটি স্পষ্ট, যুক্তরাজ্য করোনার পরবর্তী ঢেউয়ে প্রবেশ করেছে। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, বয়স্ক লোকজন ও ৫০ থেকে ৫৯ বছর বয়সী জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংক্রমণ বাড়ছে, যাঁদের এখনো নতুন করে টিকার বুস্টার ডোজ দেওয়ার কথা বলা হয়নি।
বিএ৪ এবং বিএ৫-এর বৈশিষ্ট্য কী
করোনা মহামারি শুরুর পর থেকেই করোনাভাইরাসের বিভিন্ন ধরন ও উপধরন নিয়ে কাজ করছে ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর ডিজিস প্রিভেনশন অ্যান্ড কন্ট্রোল (ইসিডিসি)। করোনার বিএ.৪ ও বিএ.৫ উপধরনকে তারা ‘উদ্বেগজনক ধরন’ বলে আখ্যা দিয়েছে।
প্রভাব বিস্তারকারী এ দুই উপধরন নিয়ে প্রায়ই একসঙ্গে আলোচনা করা হয়। কারণ, এদের স্পাইক প্রোটিনের জিনগত মিউটেশন সুনির্দিষ্ট। যদিও মিউটেশনের ধরন একেক জায়গায় একেক রকমের। স্পাইক প্রোটিন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান, এর মাধ্যমে ভাইরাস মানুষকে আক্রান্ত করে শরীরের কোষগুলোতে প্রবেশ করে। সেখানে ভাইরাসটি পরিবর্তিত হয়। এই প্রক্রিয়া সহজে ও দ্রুততার সঙ্গে ভাইরাসকে সংক্রমণযোগ্য করে তোলে। এখন পর্যন্ত করোনার যত টিকা আবিষ্কার হয়েছে, সব কটিতেই স্পাইক প্রোটিন টার্গেট করা হয়েছে।
বিএ.৪ ও বিএ.৫ উভয় উপধরন এল৪৫২আর মিউটেশন বহন করছে। করোনার ডেলটা ধরনেও একই ধরনের মিউটেশন পাওয়া গিয়েছিল। ধারণা করা হচ্ছে, এ দুই উপধরন ভাইরাসকে আরও বেশি সংক্রামক করে তুলবে। উপধরন দুটির এফ৪৮৬ভি মিউটেশন নামে জেনেটিক পরিবর্তন ঘটছে। এগুলো আমাদের দেহের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা আংশিক হলেও নষ্ট করে দিতে পারে। উপধরন দুটির জেনেটিক সিকোয়েন্সের মধ্যেও একটি পরিবর্তন দেখা দিচ্ছে, যা এস-জেন ড্রপআউট নামে পরিচিত। এর মানে হলো, কিছু পিসিআর টেস্টে ভাইরাসটি ধরা পড়বে না, যেসব পরীক্ষায় পজিটিভ রেজাল্ট আসত।
মহামারি বিশেষজ্ঞ ও ভাইরাসবিদেরা বলছেন, বিএ৪ এবং বিএ৫ দ্রুতগতিতে সংক্রমণ ঘটায়। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, এই দুই উপধরনের বিস্তার ঘটে দ্রুতগতিতে। বিশ্বের একাধিক দেশে এটি এখন ব্যাপক হারে সংক্রমণ ঘটাচ্ছে। মহামারি বিশেষজ্ঞ মুশতাক হোসেন বলেন, উত্তর কোরিয়া, চীনের সাংহাই, যুক্তরাষ্ট্রসহ নানা দেশে এর বিস্তারে ব্যাপক হারে করোনা ছড়িয়েছে। এখন যুক্তরাষ্ট্রেও এই দুই উপধরনের প্রভাবে সংক্রমণ বাড়ছে।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রথম জিনরহস্য উন্মোচনের কাজে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের (সিএইচআরএফ) অণুজীববিজ্ঞানী সেঁজুতি সাহা। তিনি এই দুই উপধরন নিয়ে বললেন, দুটি উপধরন মারাত্মক রকমের সংক্রামক। আর এরা শরীরে সৃষ্ট অ্যান্টিবডিকে ফাঁকি দিতে সক্ষম। এই ক্ষমতার জন্য ইতিমধ্যে অ্যান্টিবডি থাকা ব্যক্তিও আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন।
মুশতাক হোসেনের মন্তব্য হলো, এই দুই উপধরনের সংক্রমণের গতি দ্রুত হলেও, ওমিক্রনের মতোই বড় ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করে না।
বিএ৪ এবং বিএ৫ নিয়ে গবেষণা
বিএ৪ এবং বিএ৫ উপধরনটি করোনায় আক্রান্ত হয়ে এবং টিকা ও বুস্টার ডোজ নেওয়া ব্যক্তির শরীরে সৃষ্টি হওয়া অ্যান্টিবডিকে ফাঁকি দিতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের বেথ ইসরায়েল ডিকোনেস মেডিকেল সেন্টারের এক গবেষণায় এ তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিনে এটি প্রকাশিত হয়। তবে সেখানে বলা হয়, করোনার টিকা এরপরও মারাত্মক পরিস্থিতি হওয়া থেকে সুরক্ষা দিতে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
বাংলাদেশে এবারের সংক্রমণ কত দিন চলতে পারে
দেশে ২০২০ সালের ৮ মার্চ প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হয়। করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ১৮ মার্চ। ডা. মুশতাক হোসেন মনে করেন, চলতি মাসে করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধির যে প্রবণতা দেখা দিয়েছে, এটি পঞ্চম ঢেউ। তাঁর হিসাবে, প্রথম ঢেউ ছিল ২০২০ সালের মার্চ থেকে আগস্টের মাঝামাঝি পর্যন্ত। দ্বিতীয় ঢেউটি শুরু হয় ২০২১-এর ফেব্রুয়ারিতে। এটি করোনার আলফা ধরন দিয়ে শুরু হয়ে বিটা দিয়ে শেষ হয়।
করোনার ডেলটা ধরন দিয়ে তৃতীয় ঢেউয়ের শুরু হয়েছিল ২০২১ সালের এপ্রিল মাস থেকে, এটি চলে জুলাই। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে চতুর্থ ঢেউ ওমিক্রন ধরন দিয়ে শুরু হয়। এটি চলে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। আর চলতি জুন মাসে শুরু হয়েছে পঞ্চম ঢেউ।
এ পর্যন্ত দেশে করোনায় সর্বোচ্চ সংক্রমণ হয় গত বছরের জুলাই মাসে। সে সময় এক দিনে আক্রান্তের সংখ্যা ১৬ হাজার অতিক্রম করেছিল।
মুশতাক হোসেন মনে করেন, এই পঞ্চম ঢেউয়ে সংক্রমণ গত বছরের জুলাই মাসের কাছাকাছি চলে যেতে পারে। তবে আগামী দেড় সপ্তাহের মধ্যে সংক্রমণ কমতে পারে।
চতুর্থ ঢেউ থেকে মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার কারণ প্রসঙ্গে মুশতাক হোসেনর বক্তব্য, ‘আমাদের টিকা নেওয়া জনগোষ্ঠীর সংখ্যা যথেষ্ট থাকলেও, স্বাস্থ্যবিধির বিষয়টি উপেক্ষিত ছিল। এর কারণেই আমরা টিকা নিয়েও বেশি সময় ধরে সংক্রমণের ধীরগতি বজায় রাখতে পারিনি।’
করণীয় কী
নতুন উপধরনের প্রভাব, সুরক্ষা হ্রাস পাওয়া ও সুরক্ষার পদক্ষেপ কমে যাওয়ায় করোনা সংক্রমণ বাড়ছে—এ বিষয়ে একমত অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ। নতুন দুই উপধরনের সংক্রমণের ফলে গুরুতর উপসর্গযুক্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়া ঠেকাতে এখনই আগাম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ।
বয়স্ক ও ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিদের সুরক্ষায় এবং করোনার তীব্র উপসর্গ থেকে বাঁচাতে অনেক দেশেই দ্বিতীয় দফা বুস্টার ডোজ কিংবা চতুর্থ ডোজ টিকা দিতে যাচ্ছে। অপর দিকে ওষুধ কোম্পানিগুলো ওমিক্রনের জন্য বিশেষ টিকা তৈরি নিয়ে কাজ করছে।
এ ছাড়া এটাও মনে রাখতে হবে যে করোনার এই উপধরন বাতাসে ছড়াতে সক্ষম। এ জন্য ঘরে পর্যাপ্ত আলো ও বাতাসের প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে। বায়ু চলাচল স্বাভাবিক রাখা করোনায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কমানোর ভালো একটি সুযোগ।
এসডব্লিউ/এসএস/১২১৪
আপনার মতামত জানানঃ