করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে দেশে করোনায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ালো ২৯ হাজার ১৫৪ জন। একই সময়ে নতুন করে করোনা শনাক্ত হয়েছে ১ হাজার ৮৯৭ জনের। এ নিয়ে শনাক্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯ লাখ ৭৫ হাজার ৬৮২ জনে। শুক্রবার (১ জুলাই) স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে পাঠানো করোনাবিষয়ক নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
করোনার আবার এই ক্রমবর্ধমান সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের (সিএইচআরএফ) অণুজীববিজ্ঞানী সেঁজুতি সাহা। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্সিং (জিন নকশা উন্মোচন) হয়।
জুন মাসে দেশে করোনা শনাক্ত ব্যক্তিদের নিয়ে জেনোম সিকোয়েন্সিং করেছে সিএইচআরএফ। সংক্রমিত মানুষের মধ্যে অমিক্রনের উপধরন বিএ৫–এর প্রাধান্য পাওয়া গেছে। এ প্রসঙ্গে সেঁজুতি সাহা বলেন, সিএইচআরএফ সেই ২০২০ সাল থেকে কোভিডের এই ভেরিয়েন্টগুলোর (ধরন) ওপর নজরদারি রাখছে। প্রতি মাসে আমরা যখন কোনো সার্স-কোভ ২ কেস পাই, তখনই চেষ্টা করি কী কী ধরন আছে, তা বাংলাদেশে ছড়াচ্ছে।
আমরা দেখলাম, গত জুন মাসে নতুন ঢেউ শুরু হলো। আর আমরা সিকোয়েন্সিং করে দেখলাম, যে কেসগুলো সিকোয়েন্স করেছি, এর সবই অমিক্রন এবং ৮০ শতাংশই বিএ ৫।
তাই বলা যায়, বিএ৫–ই এখন বাংলাদেশে সবচেয়ে প্রাধান্যশীল উপধরন। তবে আমাদের এই নজরদারি চালিয়ে যেতে হবে এবং দেখতে হবে, এ উপধরনের মধ্যে আরও মিউটেশন আসছে কি না বা নতুন কোনো উপধরন ছড়াচ্ছে কি না।
এই উপধরণ কতটা বিপজ্জনক?
আমাদের টিকাকরণ বেশ সন্তোষজনক। করোনার সর্বশেষ ঢেউ থেকে বর্তমান ঢেউয়ের ব্যবধান মাত্র তিন মাস। তারপরও দুটি ঢেউয়ের মধ্যে ব্যবধান এত কম হলো কেন এ প্রসঙ্গে সেঁজুতি সাহা বলেন, আমরা তিন মাস ব্যবধান দেখেছি। এর আগের ঢেউগুলোর মধ্যে ব্যবধান কিন্তু আরও কম ছিল। সর্বশেষ তিন মাস যে আমরা কাটালাম, সে সময় রোগীর সংখ্যা অনেক কম ছিল। গত দুই বছরের কথা চিন্তা করলে এটা বলতে হয়। আমার মনে হয় না, এর মধ্যে ব্যতিক্রমধর্মী কিছু আছে। বরং আমরা দেখছি, ঢেউগুলোর মধ্যে ব্যবধান দিন দিন বাড়ছে।
হ্যাঁ, টিকাকরণ অবশ্যই সন্তোষজনক। বাংলাদেশে বেশির ভাগ মানুষ দুটি ডোজ পেয়ে গেছেন। অনেকে আবার তৃতীয় ডোজও পেয়েছেন। আমরা জানতে পারছি, এখন যে টিকার কার্যকারিতা, তা কিন্তু আস্তে আস্তে কমে যায়। এটা হতে পারে যে আমরা যারা অনেক আগে দুটি ডোজ নিয়ে ফেলেছি, কিন্তু বুস্টার নিইনি, তাদের মধ্যে ইমিউনিটি কিছুটা কমেছে। আর সে জন্যই হয়তো এই ঢেউ এ সময়ে দেখতে পাচ্ছি।
তবে এটা নিশ্চিতভাবে বলা যাবে না, কেন এখন এই ঢেউ এসেছে। আমরা সারা বিশ্বে দেখতে পাচ্ছি, সার্স কোভ-২–তে মিউটেশন হচ্ছে এবং তা হবেই। মিউটেশন হয়ে হয়ে নতুন নতুন ধরন ও উপধরন দেখছি। আর এসব ধরন বা উপধরন ছড়াচ্ছে। যখন একটি ধরন বা উপধরন বেশি ছড়ায়, তখন আমরা একটি করে ঢেউ দেখতে পাচ্ছি। আমার মনে হয়, আমরা এমন ঢেউ কিছুদিন পরপর দেখতে থাকব আরও কিছুদিন।
বিএ৫–এর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সেঁজুতি সাহা বলেন, আমরা জানি এটি অমিক্রনের উপধরন। তাই অমিক্রনে প্রথম যাঁরা আক্রান্ত হয়েছিলেন, তার সঙ্গে এর মিল আছে। অমিক্রনের সব মিউটেশন বিএ৫–এ থাকবে। অমিক্রনের দুটি উপধরন বিএ৪ ও বিএ৫। দুটিই বেশ কাছাকাছি।
আমরা বাংলাদেশে দেখতে পাচ্ছি, অন্তত আমাদের পর্যবেক্ষণে যে বিএ৫টিই এখানে প্রাধান্যশীল। বিএ৪ ও বিএ৫—এ দুটি মিউটেশন আছে চোখে পড়ার মতো। এর মধ্যে একটি হলো এল৪৫২ আর। এই মিউটেশন কিন্তু আমরা ডেলটা ধরনেও দেখেছিলাম।
আমরা ধারণা করেছিলাম, এ মিউটেশনের কারণেই এই উপধরন দ্রুতগতিতে ছড়াতে পারে। আরও বেশি ছোঁয়াচে হয়ে যেতে পারে। কারণ, এই মিউটেশন ভাইরাসটাকে মানবকোষের সঙ্গে যুক্ত হতে বেশি সহায়তা করে। বিএ৪ ও ৫–এ আরেকটি মিউটেশন আছে। সেটি হলো এফ ৪৮৬। এই মিউটেশন হচ্ছে যেখানে স্পাইক প্রোটিন মানবকোষের সঙ্গে যুক্ত হয়, ওটার কাছাকাছি।
ধারণা করা হচ্ছে, এই মিউটেশন ভাইরাসটাকে সহায়তা করে আমাদের ইমিউনিটিকে ধোঁকা দিতে বা ফাঁকি দিতে। আমরা এটা জানি, বিএ৪ বা ৫ অন্য ধরনগুলোর চেয়ে বেশি হারে ছড়ায়। কিন্তু আমরা এটা জানি না, এটা অন্য ধরনগুলোর চেয়ে বেশি গুরুতর নয়, কম রোগ সৃষ্টি করে। বিএ৪ ও ৫—দুটিই কিন্তু শনাক্ত হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকায়। এসব এসেছিল জানুয়ারিতে। আমরা দেখেছি, ঢেউ এসেছে, আবার চলেও গেছে সেখানে। তবে দক্ষিণ আফ্রিকায় অত বেশি ক্ষতি করতে পারেনি, যতটা প্রথমবার অমিক্রন ধরন করেছিল।
এর পেছনে নানা কারণ থাকতে পারে। এর একটি কারণ হতে পারে অবশ্যই টিকা। আবার ওই দেশে অমিক্রন ধরন দিয়ে যেহেতু বড় ঢেউ হয়েছিল, তাই ওটার কারণেও মানুষের মধ্যে একটি প্রতিরোধক্ষমতা ছিল। বিএ৫ কিন্তু শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের নানা দেশে দ্রুতগতিতে ছড়াচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে গত কয়েক সপ্তাহে বিএ৪ ও ৫ দ্রুত ছড়াচ্ছে।
টিকা কতটা কার্যকর হবে?
টিকার ভূমিকা কিন্তু এখনো অনেক অনেক বড়। টিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের মধ্যে এই উপধরনের মাধ্যমে সংক্রমণ বেড়ে গেলেও মৃত্যুর হার কিন্তু সে হারে বাড়তে পারেনি। আমাদের হাসপাতাল যাওয়ার সংখ্যা কম। দক্ষিণ আফ্রিকায় আমরা দেখেছি মৃত্যু ও হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সংখ্যা অনেক কম। তাই নিশ্চয়ই টিকার কোনো একটা ভূমিকা আছে। আমাদের যদি টিকা থাকে, তবে আক্রান্ত হলেও এর তীব্রতা কম হবে।
আমরা ভালোভাবে লড়াই করতে পারব রোগটাকে। তাই কথা হলো, আমাদের দুটি ডোজ নিতে হবে। আর পারলে বুস্টার ডোজও নিতে হবে। কিছু কোম্পানি কিন্তু এখন শুধু অমিক্রনের জন্য একটি টিকা আনার চেষ্টা করছে। তবে সেই টিকা আসতে আসতে অমিক্রন থাকবে, না অন্য কোনো ধরন চলে আসবে, তা বলা কঠিন। তাই এখন আমাদের হাতে যে টিকা আছে, তা নিয়ে নিতে হবে। ডোজ শেষ করতে হবে এবং বুস্টার নিতে হবে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪২৫
আপনার মতামত জানানঃ