করোনাভাইরাস অতিমারীতে দেশের প্রান্তিক পরিবারগুলোর ঋণের বোঝা বাড়ছে। খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত ব্যয় কমানোর পাশাপাশি সঞ্চয় ভেঙে চলার মতো পদক্ষেপের পরও করোনার মধ্যে ৭৮ শতাংশ পরিবার আর্থিক দুরবস্থার মধ্যে পড়েছে। এর মানে, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতি পাঁচ পরিবারের চারটিই এমন সংকটে পড়েছে।
এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম আয়োজিত দুই দিনব্যাপী এক সম্মেলনের প্রথম দিনে গতকাল রোববারের একটি অধিবেশনের মূল প্রবন্ধে এসব কথা বলা হয়েছে। এতে ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ইশতিয়াক বারি ‘বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অতিমারি মোকাবিলা ও খানা জরিপের ফলাফল’ তুলে ধরেন।
সারা দেশের চর, হাওর, উপকূলীয় অঞ্চল এবং দলিত, আদিবাসীসহ পিছিয়ে পড়া ১ হাজার ৬০০ পরিবারের ওপর এই জরিপ করা হয়। ঢাকায় মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টারে ‘মহামারি থেকে উত্তরণের পথে বাংলাদেশ: অভিজ্ঞতা অর্জন ও নীতি প্রণয়ন’ শীর্ষক দুই দিনের এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
জরিপের ফলাফলে বলা হয়, প্রায় ৪৮ শতাংশ পরিবার দেনার মধ্যে পড়েছে। এসব পরিবার গড়ে ৫২ হাজার ৫৩৩ টাকা ঋণ নিয়েছে। এখন সেই ঋণের জালে চার থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত আটকে থাকতে হবে তাদের।
তবে চর ও উপকূলীয় অঞ্চলে এই দুরবস্থা বেশি প্রকট। পরিবারগুলোর গড়ে ১৯ শতাংশ আয় কমেছে। করোনার প্রথম দিকে সরকারি ছুটি ঘোষণার কারণে ৭০ শতাংশ পরিবারের অন্তত একজন সদস্য কাজ হারিয়েছেন। অবশ্য পরে তাদের ৯৭ শতাংশ আবার কাজ ফিরে পেয়েছেন।
জরিপমতে, সংসারের খরচ চালাতে সঞ্চয় ভাঙতে হয়েছে প্রায় ২১ শতাংশ পরিবারকে। গড়ে তারা ৩৪ হাজার ৪৬২ টাকার সঞ্চয় ভেঙেছে, যা তাদের পাঁচ মাসের সঞ্চয়ের সমান। আর যাদের সঞ্চয় নেই, তারা ঋণ নিতে বাধ্য হয়েছে। এ ধরনের পরিবারের উপার্জনকারীরা প্রায় সবাই অনানুষ্ঠানিক খাতের কর্মী।
বিশেষ আলোচক সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, করোনার সময়ে সরকারি প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিস্থিতি অনুসারে পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত তৈরি করতে পারেনি। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সেই চেষ্টা করেছে। বিবিএস ভবিষ্যতে কোনো এক সময় খানা আয় ও ব্যয় জরিপ করবে, তখন কোভিডের চিত্র উঠে আসবে, তা আশা করা যায় না। শিগগিরই এই বিষয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে বিবিএসের বসা উচিত।
প্রায় ৪৮ শতাংশ পরিবার দেনার মধ্যে পড়েছে। এসব পরিবার গড়ে ৫২ হাজার ৫৩৩ টাকা ঋণ নিয়েছে। এখন সেই ঋণের জালে চার থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত আটকে থাকতে হবে তাদের।
দুপুরের পর অপর কর্ম অধিবেশনে বলা হয়, অতিমারির কারণে দারিদ্র্য বেড়েছে। আর তাতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন নারীরা। অব্যবস্থাপনার কারণে করোনাকালে দরিদ্র মানুষকে দেওয়া সরকারি প্রণোদনার অর্থ অনেকের হাতে পৌঁছায়নি। এ–সংক্রান্ত এক গবেষণার তথ্য তুলে ধরে অনুষ্ঠানে বলা হয়, মাঠপর্যায়ের এক জরিপে দেখা গেছে, তালিকাভুক্ত ৮৫ শতাংশ মানুষ জানতেনই না, প্রণোদনা না পেলে অভিযোগ করার সুযোগ আছে। ৬০ শতাংশ মানুষ প্রণোদনার কিছুই পাননি। আবার প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে গ্রামের তুলনায় শহরেই বেশি সহায়তা পৌঁছেছে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ফলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খানও একটি মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। এতে আরেকটি প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হয়। তিনি বলেন, ‘মনে হচ্ছে, সরকারের কাছে পর্যাপ্ত টাকা নেই। আগের মতো স্বস্তিদায়ক অবস্থা নেই। ব্যাংক খাতের পরিস্থিতি বদলায়নি। যারা প্রণোদনা ঋণ নিয়েছেন, তারা সেই টাকা আর ফেরত দিতে না-ও পারেন। এতে কুঋণ বাড়বে।’ তিনি আরও বলেন, দারিদ্র্য ও বৈষম্য কমাতে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ কর্মসূচি প্রয়োজন।
অনুষ্ঠানে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) আবাসিক প্রতিনিধি সুদীপ্ত মুখার্জি বলেন, স্বাস্থ্য খাতে মাথাপিছু খরচ সারা বিশ্বে বাংলাদেশে সবচেয়ে কম। এটি বাড়াতে হবে। কারণ, স্বাস্থ্যসেবা নিতে সাধারণ মানুষের পকেট থেকে টাকা খরচ বেশি হচ্ছে।
কদিন আগে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সমূহের জীবন-মান উন্নয়নে বাংলাদেশ সরকার কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও বিভিন্ন সরকারি সেবায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তিতে বাধা, বৈষম্য ও জবাবদিহিতার ঘাটতি রয়েছে বলে মন্তব্য করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
টিআইবির গবেষণায় উঠে এসেছে, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রয়োজনে সাড়া প্রদানে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনের কার্যক্রম ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে। অন্যদিকে সরকারি সেবার ক্ষেত্রে উল্টো চিত্র দেখা যায়। যেমন— প্রান্তিক পরিচয়ের কারণে অভিযোগ দাখিল করতে না পারা, শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অভিযোগ করে সমাধান না পাওয়া, বিদ্যালয়ে ‘মূলধারার’ সহপাঠী ও শিক্ষকদের বর্ণবাদমূলক আচরণের অভিযোগে সমাধান না পাওয়া, অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকজন শিক্ষার্থী ও অভিভাবককে শিক্ষকদের বিরূপ মন্তব্যের শিকার হওয়া, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অভিযোগ দিয়েও প্রতিকার না পাওয়া, ভূমি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অভিযোগ জানিয়েও সহযোগিতা না পাওয়া, অভিযোগ দাখিলের বিরূপ প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি। দেখা গেছে, মধুপুরে ‘সংরক্ষিত বনাঞ্চল’ ঘোষণা অনিয়মতান্ত্রিকভাবে করা হয়েছে উল্লেখ করে পরিবেশবাদী সংগঠনের মামলায় উচ্চ আদালতের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা অবজ্ঞা করে ‘সংরক্ষিত বনাঞ্চল’ দখলমুক্ত করা ও সামাজিক বনায়নের নামে আদিবাসীদের বসতভিটা ও আবাদি জমিতে বন বিভাগের উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনার প্রমাণ রয়েছে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সেবা প্রদানের জন্য এবং অভিযোগ দায়েরের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক এবং সামাজিক ব্যবস্থাপনা রয়েছে যেটি অন্তর্ভুক্তিমূলক না হওয়ায় সেবা প্রাপ্তি থেকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী অনেক ক্ষেত্রেই বঞ্চিত হন। বঞ্চিত হওয়ার পর যদি অভিযোগ দায়ের করেন, তখন তারা বাধাগ্রস্ত হন কিংবা প্রতিকার পান না। বরং অনেক সময় অভিযোগ উত্থাপন করলে হুমকির সম্মুখীন হন। এক্ষেত্রে আমরা দুঃখজনকভাবে লক্ষ্য করেছি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের একাংশ মূলত প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে থাকে এবং তাদের মানসিকতাও অনেক সময় প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সম্পর্কে নেতিবাচক।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংবিধানে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার কথা থাকলেও তার যথাযথ বাস্তবায়ন না থাকা দুর্ভাগ্যজনক। ২০৩০ সালের মধ্যে সরকার যে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা বা এসডিজি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন না করতে পারলে তা কখনোই সফল হবে না। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, টিআইবির সুপারিশ অনুযায়ী অবিলম্বে সরকার বৈষম্য বিলোপ আইন পাস করবে। তবে কেবল আইন করলেই হবে না, সেই আইন বাস্তবায়ন করা যাঁদের দায়িত্ব, তাদের মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯০০
আপনার মতামত জানানঃ