করোনা মহামারিতে বিশ্বে বিপর্যস্ত দেশগুলোর মধ্যে ভারত একটি। করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর পাশাপাশি লকডাউনের কারণে নাজেহাল অবস্থায় রয়েছে দেশটি। এরইমধ্যে বায়ুদূষণের ফলে দৃষ্টিসীমা কমে আসা, দূষণে শ্বাসকষ্টসহ নানা ধরনের সমস্যা চরম আকার ধারণ করেছে ভারতের রাজধানী দিল্লিতে।
কয়েকদিন ধরেই ভারতের রাজধানী দিল্লির বায়ুদূষণ নিয়ে আলোচনা চলছে। এবার গবেষকরা সেখানকার বায়ুদূষণ পরিস্থিতি নিয়ে শোনালেন ভয়াবহ তথ্য। জানালেন দিল্লিতে ঘরের ভেতরে বায়ুদূষণের পরিমাণ উদ্বেগজনক হারে বেড়ে গেছে। এমনকি দিল্লির ঘরের ভেতরের দূষণের পরিমান বাইরের চেয়ে অনেক গুণ বেশি।
ভারতের রাজধানী দিল্লিতে ঘরের ভেতরের বায়ু উদ্বেগজনকভাবে উচ্চমাত্রায় দূষিত বলে নতুন গবেষণায় জানা গেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, বাতাসে থাকা ফুসফুসের জন্য ক্ষতিকর ক্ষুদ্র বস্তুকণা পিএম২.৫–এর পরিমাণ ঘরের বাইরের চেয়ে ঘরের অভ্যন্তরে ‘যথেষ্ট মাত্রায়’ বেশি।
এসবের পরও দিল্লির বেশিরভাগ বাড়ির বাসিন্দারাই এ ব্যাপারে কোনো সুরক্ষাসংক্রান্ত পদক্ষেপ নিতে নারাজ বলে জানা গেছে।
দিল্লি কয়েকবছর ধরে নিয়মিতভাবেই ‘বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায়’ প্রথমদিকে রয়েছে।
২০১৮–২০ সালের মধ্যে গবেষণাটি করে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউট (ইপিআইসি)। আর্থসামাজিক অবস্থান বিবেচনায় নিয়ে দিল্লির কয়েক হাজার পরিবারের ওপর জরিপ চালানো হয়। তাতে দেখা যায়, ধনী–গরিবনির্বিশেষে সব পরিবারের মধ্যেই বায়ুদূষণের এমন মাত্রা দেখা গেছে।
তবে উচ্চবিত্ত পরিবারগুলোতে এয়ার পিউরিফায়ার ব্যবহার করার পরিমান নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোর চেয়ে ১৩ গুণ বেশি। কিন্তু এয়ার পিউরিফায়ার ব্যবহার করার পরও দূষণের মাত্রা নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোর তুলনায় মাত্র ১০ শতাংশ কম বলে গবেষণায় দেখা গেছে।
গবেষণা নিবন্ধটির প্রধান লেখক কেনেথ লি। তিনি বলেন, ‘ধনী-গরিবনির্বিশেষে কেউই বিশুদ্ধ বাতাস গ্রহণ করতে পারছে না।’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দেওয়া আনুমানিক হিসাব অনুযায়ী, বায়ুদূষণের কারণে সৃষ্ট রোগে প্রতিবছর বিশ্বজুড়ে প্রায় ৭০ লাখ মানুষের অকালমৃত্যু হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমরা বেশির ভাগ সময় বাড়ির ভেতরে বায়ুদূষণের শিকার হই। আর এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউটের হিসাব অনুযায়ী, বাইরের চেয়ে বাড়ির ভেতরে বায়ুদূষণের মাত্রা দুই থেকে পাঁচ গুণ বেশি।
ভারতের জন্য তা আরও বড় উদ্বেগের বিষয়। কেননা বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত ৩০টি শহরের ২২টি ভারতের। বায়ুদূষণে ভারতে বছরে ১০ লাখের বেশি মৃত্যু হয়।
উচ্চবিত্ত পরিবারগুলোতে এয়ার পিউরিফায়ার ব্যবহার করার পরিমান নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোর চেয়ে ১৩ গুণ বেশি। কিন্তু এয়ার পিউরিফায়ার ব্যবহার করার পরও দূষণের মাত্রা নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোর তুলনায় মাত্র ১০ শতাংশ কম বলে গবেষণায় দেখা গেছে।
বায়ুদূষণের কারণে দিল্লির বাসিন্দাদের বাড়ছে বায়ু বাহিত রোগ। এর মধ্যে প্রকট হয়ে দাঁড়িয়েছে ফুসফুসের সমস্যা। ভারতের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহর হিসেবে উঠে আসছে দিল্লির নাম।
ভারতের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, দিল্লির বাতাসে ২.৫ মাইক্রন ঘনত্বের সূক্ষ্ম ধূলিকণার (পিএম ২.৫) বাড়ার কারণে ফুসফুসের সমস্যা বাড়ছে। বাতাসে ভাসমান সাধারণ ১০ মাইক্রন ঘনত্বের ধূলিকণা (পিএম ১০) নাকের ভিতরে রোমে আটকে গেলেও পিএম ২.৫ বা সূক্ষ্ম ধূলিকণা সরাসরি পৌঁছে যেতে পারে ফুসফুস পর্যন্ত।
প্রাথমিকভাবে বায়ু দূষণের কারণ হিসেবে পড়শি উত্তরপ্রদেশ এবং হরিয়ানার কৃষি জমিতে খড়বিচালি পোড়ানোকে চিহ্নিত করা হয়েছিল। কিন্তু সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টে কেন্দ্রের দেয়া তথ্য জানাচ্ছে, দিল্লির দূষণের মাত্র ১০ ভাগ হচ্ছে পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলিতে খড়বিচালি পোড়ানো ফলে। যানবাহন, ডিজেল চালিত জেনারেটর এবং শিল্প থেকে বায়ু দূষণের পরিমাণ তার চেয়ে অনেক বেশি।
শীতের গোড়ায় বায়ুদূষণের ফলে বাড়ছে অসুস্থতার ঘটনাও। চোখ জ্বালা, চোখ দিয়ে জল গড়ানো, কাশি-কফের সমস্যার পাশাপাশি শ্বাসনালী ও ফুসফুসে সংক্রমণের ঘটনাও বাড়ছে।
দিল্লি সরকারের পক্ষে দূষণ মোকাবিলায় কিছু বিধিনিষেধ মেনে চলার কথা বলা হয়েছে শহরবাসীকে। বাইরে বেরোলে গলায় স্কার্ফ এবং চোখের জ্বলুনি কমাতে সানগ্লাস পরার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এমনকি, ঘরে থাকাকালীনও প্রয়োজন বুঝে মাস্ক পরার কথাও বলা হয়েছে। শিল্প দূষণ কমাতে ইতিমধ্যেই দিল্লির ১১টি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের মধ্যে ছয়টি বন্ধ রাখা হয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে কেন্দ্র ও দিল্লি সরকার একাধিক পদক্ষেপ করলেও তা এখনো স্বস্তি দিতে পারেনি দিল্লিবাসীকে।
প্রায় প্রতি বছরই ভারত সরকার অথবা দেশটির সুপ্রিম কোর্ট আতশবাজি পোড়ানোয় নিষেধাজ্ঞা জারি করে থাকে। তবে মাঠপর্যায়ে তা খুব কমই কার্যকর হতে দেখা যায়। এর সঙ্গে যোগ হয় দিল্লির প্রতিবেশী পাঞ্জাব ও হরিয়ানায় কৃষকদের খড় পোড়ানোর মৌসুম। পরবর্তী বছরে চাষের জন্য মাঠ প্রস্তুত করতে পুরোনো খড়কুটোয় আগুন ধরিয়ে দেন কৃষকরা। দিল্লির বায়ুদূষণের জন্য অন্তত ৩৫ শতাংশ দায়ী এ থেকে তৈরি ধোঁয়া।
ভারত সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, অর্থনৈতিক কার্যক্রমে নজর দিতে গিয়ে তারা বায়ুদূষণ রোধে যথাযথ পদক্ষেপ নিচ্ছে না। গত ১ নভেম্বর স্কটল্যান্ডে কপ২৬ সম্মেলনে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ঘোষণা দিয়েছেন, ভারত ২০৭০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনবে। তবে কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, বৈশ্বিক জলবায়ু সংকট মোকাবিলার এই লক্ষ্যমাত্রায় ভারত অন্তত দুই দশক বেশি সময় নিচ্ছে।
বিশ্লেষকরা জানান, অবস্থানগত কারণে দিল্লির এই সমস্যা গুরুতর হচ্ছে৷ আশেপাশে কোনো জলাধার না থাকায় ও আবহাওয়ার ধাঁচ শীতপ্রধান ও শুষ্ক হওয়ায় দূষিত বাতাস পালাবার জায়গা পায় না৷ এছাড়া, তীব্র বেগে চলা বাতাস প্রায়ই সাথে করে আরো বাড়তি ধোঁয়া নিয়ে আসে, যা আরো খারাপ করে পরিস্থিতি৷
তারা বলেন, প্রতি শীতেই আমরা বিভিন্ন হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিশ্বাসজনিত ও হৃদরোগ-সম্পর্কিত রোগীদের বাড়ন্ত দেখতে পাই৷ দীর্ঘদিন ধরে দূষিত বাতাসে শ্বাস নেওয়া স্বাভাবিক স্বাস্থ্যের বিকাশ রোধ করে৷ দিল্লিতে বর্তমানে প্রতি তিনজনে একজন শিশুর ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷ বহু শিশুর ফুসফুস সম্পূর্ণ বেড়ে ওঠে না ও সেখানে রক্তক্ষরণও হয়ে থাকে৷
২০১৯ সালে কৃষিবর্জ্য পোড়ানো থামাতে আইনী নির্দেশ এলেও, তার বাস্তবায়ন এখনও হয়নি৷ জাতীয় সবুজ ট্রাইবুনাল নভেম্বর মাসে আতশবাজি পোড়ানো বন্ধ করা নিয়ে আলোচনা করছে বলে জানাচ্ছে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম৷ দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল ‘গ্রিন অ্যাপ’ চালু করেছেন, যাতে করে দূষণবিষয়ক নাগরিক নালিশ নথিভুক্ত করা যায়৷
বিশেষজ্ঞদের মতে, অবিলম্বে শহরে বিকল্প গণপরিবহণের কথা ভাবতে হবে, বাড়াতে হবে সাইকেলের মতো পরিবেশবান্ধব যানচলাচল৷ পুনর্ব্যবহারের বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন ও শিল্পক্ষেত্রে পরিবেশবান্ধব জ্বালানির ব্যবহার চালু করতে হবে বলে পরামর্শ দেন তারা। তবে এসবের কিছুই সরকারী তৎপরতা ছাড়া সম্ভব নয় বলে মনে করেন তারা৷
তারা জানিয়েছেন, আসলে সরকার ভোট ব্যাংক অটুট রাখতে চায়। হিন্দুদের চটালে তো তারা ভোট পাবে না। পৃথিবীজুড়েই রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত পরিবেশ সম্পর্কে অসচেতন। না হলে, সমুদ্রের জলস্তর বাড়ছে, প্রকৃতি তার প্রতিশোধ নিতে শুরু করেছে, কিন্তু কেউ জরুরি ব্যবস্থা নিচ্ছেন না।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৩২
আপনার মতামত জানানঃ