দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশের সাফল্য উল্লেখযোগ্য হলেও দেশের ২৪.১ শতাংশ বা ৩.৯২ কোটি মানুষ ‘বহুমাত্রিক’ দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করছেন। বাস্তব জীবনে তারা নানা ধরনের বঞ্চনার শিকার হন, যেমন দুর্বল স্বাস্থ্যসুবিধা, অপর্যাপ্ত শিক্ষা ও নিম্নমানের জীবন। এ ধরনের দারিদ্র্যের কারণেই মোট জনসংখ্যার ২৪.৩ শতাংশ মানুষ রয়েছেন দারিদ্র্যসীমার নিচে।
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) ও যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক যৌথ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য। মঙ্গবার রাতে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক থেকে ‘দ্য ২০২১ গ্লোবাল মাল্টিডাইমেনশনাল পোভার্টি ইন্ডেক্স (এমপিআই)’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।
তবে দেশের সব অঞ্চলে দারিদ্র্য বিমোচনের হার এক নয়। প্রতিবেদনের তথ্যানুসারে, ২০১৪ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে সিলেট অঞ্চলের দারিদ্র্য বিমোচনের হার ছিল অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় কম।
দারিদ্র্য সাধারণত অর্থের অভাব দিয়ে পরিমাপ করা হয়। তবে দরিদ্র মানুষেরা দারিদ্র্যের বিচার করার ক্ষেত্রে আরও বিভিন্ন মাত্রা হিসাব করেন। দরিদ্র মানুষ একসঙ্গে নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে পারেন। যেমন তাদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও বাসস্থানে সমস্যা থাকতে পারে। দারিদ্র্যের সামগ্রিক চিত্র পরিমাপ করতে বহুমুখী দারিদ্র্যের সূচকে এসব বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হয়। অথচ টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের প্রথম অভীষ্ট হচ্ছে পৃথিবীর বুক থেকে সব ধরনের দারিদ্র্য দূর করা।
প্রতিবেদনে ‘বহুমাত্রিক’ দরিদ্র বলতে বোঝানো হয়েছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও জীবনযাত্রার মানদণ্ডে একটি পরিবারের সার্বিক পরিস্থিতি। এ তিনটি বিষয়ে মোট দশটি সূচক রয়েছে। যদি কোনো পরিবারে দশটি সূচকের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ ঘাটতি থাকে, তাহলে তাকে বহুমাত্রিক দরিদ্রতার শিকার বা গরিব পরিবার বলে বিবেচনা করা হবে।
স্বাস্থ্য সূচকের মধ্যে রয়েছে পুষ্টি ও শিশুমৃত্যুর হার। মানসম্পন্ন জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে উন্নত পয়ঃনিষ্কাশন, নিরাপদ পানি, বিদ্যুৎ ও সম্পদের মালিকানা। আর শিক্ষার মধ্যে রয়েছে স্কুলে উপস্থিতির হার ও প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করা।
প্রতিবেদনে, এগুলোর ভরযুক্ত (ওয়েটেড) গড় নির্ণয় করে দারিদ্র্যের হার নির্ধারণ করা হয়েছে। পাশাপাশি দারিদ্র্যের গভীরতাও নির্দেশ করা হয়েছে এমপিআই’র মাধ্যমে।
বাংলাদেশের ‘বহুমাত্রিক’ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ১০টি মানদণ্ডের মধ্যে স্কুলে ভর্তির হার ২৫.৩ শতাংশ, স্কুলে উপস্থিতির হার ৯.৫ শতাংশ, যা আরও কম। দারিদ্র্য জনগোষ্ঠীর শিশুমৃত্যুর হার ১.৩ শতাংশ ও পুষ্টি গ্রহণের হার ৮.৭ শতাংশ।
এর মধ্যে ৪.৬ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ ও ১.৪ শতাংশ মানুষ নিরাপদ পানি সুবিধা পেয়ে থাকেন। পাশাপাশি দরিদ্র্য জনগোষ্ঠীর ২২.৮ শতাংশ রান্নার কাজে জ্বালানি তেল বা গ্যাস ব্যবহার করেন, ১৫.৩ শতাংশ স্যানিটেসশন সুবিধা পায় ও ১৫.৯ শতাংশের কিছু পরিমাণে সম্পদ রয়েছে।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের ১২ শতাংশ ছাত্র ‘বহুমাত্রিক’ দরিদ্র পরিবেশে বসবাস করছে। এই জনগোষ্ঠীর প্রায় সবাই স্কুল থেকে ঝরে পড়েছে।
বহুমাত্রিক’ দরিদ্র বলতে বোঝানো হয়েছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও জীবনযাত্রার মানদণ্ডে একটি পরিবারের সার্বিক পরিস্থিতি। এ তিনটি বিষয়ে মোট দশটি সূচক রয়েছে। যদি কোনো পরিবারে দশটি সূচকের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ ঘাটতি থাকে, তাহলে তাকে বহুমাত্রিক দরিদ্রতার শিকার বা গরিব পরিবার বলে বিবেচনা করা হবে।
প্রতিবেদনে ১৩০ কোটি মানুষের ওপর গবেষণা চালানো হয়। ফলাফলে দেখা গেছে, বহুমাত্রিক দরিদ্রতার শিকার মানুষের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ বা ৮৩.৬ কোটি মানুষ এমন পরিবারে বাস করেন যেখানে কোনো নারী সদস্য স্কুলের ছয় বছরের প্রামথিক শিক্ষা শেষ করেনি। বিশ্বের এই ৮৩.৬ কোটি মানুষের বেশিরভাগই আফ্রিকার সাব-সাহারান অঞ্চলে (৩৬.৩ কোটি) ও দক্ষিণ এশিয়ায় (৩৫ কোটি) বাস করে। এরমধ্যে মাত্র সাতটি দেশেই রয়েছে ৫০ কোটির বেশি মানুষ, যারা বহুমাত্রিক দারিদ্রতার শিকার। ভারত রয়েছে ২২.৭ কোটি, পাকিস্তানে ৭.১ কোটি, ইথিওপিয়ায় ৫.৯ কোটি, নাইজেরিয়ায় ৫.৪ কোটি, চীনে ৩.২ কোটি ও বাংলাদেশে রয়েছে ৩ কোটি।
বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচকে পাকিস্তানের চেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। সূচকে পাকিস্তানের স্কোর ০.১৯৮, সেখানে বাংলাদেশের স্কোর ০.১০৪। এছাড়া, ইন্টেন্সিটি অফ ডিপ্রাইভেশন ইনডেক্সেও পাকিস্তানের চেয়ে ভালো অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। এই সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ৪২.৭ এবং পাকিস্তানের ৫১.৭। বিশ্বের ১০১টি দেশের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।
গত বছরের ৮ মার্চ দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরু হয়। এরপর থেকে এই মহামারি এখনো সংক্রমণ করেই যাচ্ছে। তবে বাংলাদেশ এই মহামারিকে শঙ্কভাবে মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু এই মহামারিকালে বহু মানুষ কর্ম হারিয়েছেন, রুটি-রুজি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর প্রভাবে দেশে নতুন করে ৩ কোটি ২৪ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়েছেন। চলতি বছরের মার্চ মাসে নতুন দরিদ্রের সংখ্যা ছিল ২ কোটি ৪৫ লাখ। অর্থাৎ গত ছয় মাসে ৭৯ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়েছে। এ বছর এপ্রিল মাস থেকে দেওয়া করোনা বিধিনিষেধের পর দরিদ্রের এই সংখ্যা বেড়েছে।
সম্প্রতি ‘জীবিকা, খাপ খাইয়ে নেওয়া ও উত্তরণে কোভিড-১৯ এর প্রভাব’ শীর্ষক ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) এবং পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) যৌথ জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে।
দেশে ৮ মার্চ প্রথম করোনা সংক্রমণ শনাক্তের খবর জানায় রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)। প্রথম মৃত্যুর খবর জানানো হয় ১৮ মার্চ। ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব স্কুল-কলেজ বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ২৬ মার্চ থেকে সারা দেশে শুরু হয় সাধারণ ছুটি। অবশ্য এর আগেই বিপুলসংখ্যক মানুষ রাজধানী ছেড়ে যায়। সাধারণ ছুটির আদলে করোনা বিধিনিষেধ চলেছে গত বছরের মে মাস পর্যন্ত। চলতি বছরের মার্চ মাসের শেষের দিক থেকে করোনা সংক্রমণ আবার বাড়তে শুরু করলে নানা নামে লকডাউন শুরু হয় এপ্রিল মাস থেকে। এটি চলে আগস্ট মাস পর্যন্ত।
মহামারি সংক্রমণের দেড় বছর পার হয়েছে। ঋণের জালে জড়িয়ে এবং সঞ্চয় হারিয়ে বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠী দৈনন্দিন জীবন চালাতে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করছে। চলমান করোনা মহামারিতে দেশে মোট শ্রমশক্তির অনেক লোক কর্ম হারিয়েছেন। চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছেন অনেকে। অনেক প্রতিষ্ঠান করোনার ধাক্কা সামাল দিতে না পেরে এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। করোনা মহামারিকালে যেখানে সাধারণ মানুষের আয় কমে গেছে, সেখানে দেশে নতুন করে কোটিপতির সংখ্যা বেড়ে গেছে। দেশে এখন কোটি টাকার ব্যাংক হিসাবের (অ্যাকাউন্ট) সংখ্যা প্রায় ১ লাখ। যা ছয় মাস আগেও ছিল প্রায় ৯৪ হাজার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ২০২১ সালের জুন ভিত্তিক হালনাগাদ প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
সবশেষ হিসাব অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোতে এক কোটি টাকার বেশি আমানত রয়েছে এমন অ্যাকাউন্টের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯৯ হাজার ৯১৮টি। দেশে মহামারি শুরুর আগে গত বছরের মার্চে কোটি টাকার আমানতের হিসাব ছিল ৮২ হাজার ৬২৫টি। অর্থাৎ মহামারিতে ১৭ হাজার ২৯৩টি কোটি টাকার হিসাব বেড়েছে।
দেশে আশঙ্কাজনকভাবে গরিবের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া নিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলেন, কোভিডকালে সামাজিক সুরক্ষা নামমাত্র ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু এটিকে এখন অগ্রাধিকার দেওয়া দরকার। শহরের দরিদ্র শ্রেণি এবং নতুন দরিদ্রদের জন্য বর্তমানে থাকা সুরক্ষা কর্মসূচির পাশাপাশি কার্যকর ও প্রযুক্তিভিত্তিক নতুন ও তাৎপর্যপূর্ণ আরো কর্মসূচি হাতে নেওয়া উচিত।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, করোনা ও লকডাউনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছেন দিনমজুর, শ্রমিক ও নিম্নবিত্ত জনগণ। বিশেষ করে যারা শহর ও শহরের উপকণ্ঠে থাকেন। এ পরিস্থিতিতে অনানুষ্ঠানিক খাতের লোকজন রিকশাচালক, পরিবহনকর্মী, হকার, দিনমজুর, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, কামার, কুমোর, জেলে, দর্জি, বিভিন্ন ধরনের মিস্ত্রি, নির্মাণ শ্রমিকসহ দৈনন্দিন আয়ের ওপর নির্ভরশীল মানুষ কাজ করার সুযোগ পাচ্ছেন না। সামগ্রিকভাবে কৃষি, শিল্প ও সেবা সব খাতেই নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর লকডাউনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। আয় হারিয়ে কর্মহীন বসে থাকার ফলে এ ধরনের মানুষের খাদ্য সংকট ছাড়াও স্বাস্থ্য ও মানসিক পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতিরও আশঙ্কা রয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫১৮
আপনার মতামত জানানঃ