থাইল্যান্ডের রেইনফরেস্টে এমন এক ধরনের ছত্রাক আছে, যারা জীবন ধারণের জন্য অন্য প্রাণীকে আক্রমণ করে খুন করে এবং সেই মৃতদেহে নিজের ইচ্ছেমতো জীবন যাপন করে। আর খুন করার আগে এরা পোষককে দিয়ে নিজের ইচ্ছেমতো কাজ করিয়ে নেয়। এই কাজটা করে তাদের মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে।
ওপিওকর্ডিসেপস ইউনিল্যাটেরিলস নামের এই ছত্রাক ‘জম্বি ছত্রাক’ নামে পরিচিত। থাইল্যান্ড ও ব্রাজিলের রেইন ফরেস্টে এরা আজও বেঁচে আছে। ইউরোপ ছাড়া প্রায় সব মহাদেশেই এদের কমবেশি দেখা পাওয়া যায়।
জীববিদ আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস এদের পর্যবেক্ষণ করেছিলেন সেই ১৮৫৯ সালে। তবে এক গবেষণায় জার্মানির মেসেল পিট নামের ৪৭ মিলিয়ন বছর পুরনো এক ফসিলে এদের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া গেছে। আসলে, জম্বি ছত্রাকের বসবাসের জন্য বনজ পরিবেশ প্রয়োজন হয়। আর আবিষ্কৃত ফসিলটি যে সময়কালের, সে সময় জার্মানিসহ পুরো ইউরোপ মহাদেশের সবটুকু জুড়েই ছিল সবুজের ছড়াছড়ি।
ব্রাজিলের রেইনফরেস্টেও এদের দেখতে পাওয়া যায়। সেখানে উঁচু উঁচু গাছের নিচের দিকে খোঁজ করতে করতে থমকে যেতে পারেন একটি পাতা দেখে। মাটি থেকে ঠিক ২৫ সেন্টিমিটার উঁচুতে থাকতে হবে সেই পাতাটি। একটু উপরেও নয়, একটু নিচেও নয়। ঠিক ২৫ সেন্টিমিটার উঁচুতে একটি গাছের পাতার ওপর কোনো পিঁপড়েকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখলেই জানবেন, তার নিজের বোধবুদ্ধি আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। সবটাই চলে গিয়েছে ওই ছত্রাকের কবলে।
মূলত রেইনফরেস্টে দেখা পাওয়া যায় এমন এক ছত্রাকের। যারা বংশবিস্তারের জন্য বেছে নেয় পিঁপড়ের শরীর। শুধু শরীর নয়, তাদের মস্তিষ্কেরও দখল নেয়। তারপর পিঁপড়েটি নিজের অজান্তেই দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গাছ বেয়ে উঠতে থাকে। ঠিক ২৫ সেন্টিমিটার উপরে এসে থেমে যায়। এই জায়গাটিই ওপিওকর্ডিসেপস নামের ওই ছত্রাকের বেঁচে থাকার সবচেয়ে উপযুক্ত পরিবেশ।
সেখানে একটু একটু করে পিঁপড়ের শরীরে ছত্রাকের বংশবিস্তার ঘটতে থাকে। একসময় মাথার পাশ দিয়ে বেরিয়ে আসে শুঁড়ের মতো একটি উপবৃদ্ধি। এই উপবৃদ্ধি আসলে ছত্রাকের রেণুথলি। এখান থেকে রেণু ঝরে পড়ে নিচে। তারপর নিচে থাকা দলের বাকি পিঁপড়েদের শরীরেরও দখল নেয়।
বিগত ৪ বছর ধরে এই ছত্রাকের কাজ পর্যবেক্ষণ করছেন পেনসিলভানিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষক ডেবিড হিউগ। হিউগের গবেষণার সূত্রে ওপিওকর্ডিসেপসের কাজের ধরন সম্বন্ধে অনেক নতুন তথ্যই জানা গিয়েছে। দেখা গিয়েছে, একটিমাত্র ছত্রাক পিঁপড়ের শরীরে প্রবেশ করার পর অতি দ্রুত উপনিবেশ তৈরি করে। শুধু তাই নয়, একটি পিঁপড়ের শরীরের সমস্ত ছত্রাক নিজেদের মধ্যে যোগাযোগও রাখে।
এককোষী ছত্রাকদের নিজের কোনো মস্তিষ্ক নেই। অথচ তাদের চেয়ে অনেক বড়ো প্রাণীর মস্তিষ্কের দখল নিয়ে নিতে পারে তারা। আর সবচেয়ে মজার বিষয়, এর জন্য মস্তিষ্কের আশেপাশে বংশবিস্তারের প্রয়োজন হয় না তাদের। কেবলমাত্র পিঁপড়ের পেশির দখল নিয়ে সেখান থেকেই মস্তিষ্ককে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এই ছত্রাক। তবে ঠিক কীভাবে পিঁপড়ে মস্তিষ্ককে নিয়ন্ত্রণ করে এই ছত্রাক, তা তিনি এখনও বুঝতে পারেননি।
সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, একধরনের ছত্রাক আছে যারা এই জম্বি ছত্রাকের বিরুদ্ধে কাজ করে এবং এদের বেড়ে উঠা দমন করে। এদের নাম দেওয়া হয়েছে ‘এন্টি-জম্বি-ফাঙ্গাস’। এই এন্টি-জম্বি যদি জম্বিকে আক্রমণ করে, দেখা গেছে মাত্র ৬.৫ শতাংশ জম্বি ছত্রাক এদের আক্রমণ থেকে বেঁচে নিজের মতো করে বেড়ে উঠতে পারে। এ জন্যই আসলে কার্পেন্টার প্রজাতির পিঁপড়েরা এখনও পুরোপুরি বিলীন হয়ে যায়নি।
এ ছাড়াও আরেকটা ব্যাপার আছে। এতদিন ধরে আক্রমণের শিকার পিঁপড়ারা ধীরে ধীরে জেনে গেছে যে, কোনো আক্রান্ত পিঁপড়াকে ব্যবহার করে জম্বি ছত্রাক পুরো কলোনি দখল করে নিতে পারে। কাজেই, কালের প্রবাহে পিঁপড়ারা এই ছত্রাকে আক্রান্ত যে কোনো সদস্যকে শনাক্ত করতে শিখে গেছে।
এমনিতে পিঁপড়ারা বেশ সামাজিক প্রাণী হলেও আত্মরক্ষার জন্য কলোনির কোনো সদস্য আক্রান্ত হলে অন্যা সুস্থ সদস্যরা তাকে কলোনি থেকে অনেক দূরে কোথাও রেখে আসে। তাতে রক্ষা পায় পুরো কলোনি।
আমাদের সৌভাগ্য, ছত্রাকের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো, এরা ঢালাওভাবে সকলকে আক্রমণ করে না। শুধু নির্দিষ্ট কোনো প্রজাতিকে আক্রমণ করে। তেমনই, এই জম্বি ছত্রাক আক্রমণ করে কার্পেন্টার পিঁপড়াকে। জম্বি ছত্রাক জানে, এই পিঁপড়াকে আক্রমণ করলেই তারা সবচেয়ে ভালোভাবে নিজেদের জীবন পার করতে পারবে। সেজন্য এরা পরিকল্পিতভাবেই এদেরকেই আক্রমণ করে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩১৭
আপনার মতামত জানানঃ