সেন্টমার্টিন দ্বীপ, যাকে ঘিরে রয়েছে অপার পর্যটন সম্ভাবনা। প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষ অবসর যাপনের জন্য ভিড় করে দেশের সর্বশেষ প্রান্তে অবস্থিত এই নীল জলের দ্বীপে। সারি সারি নারিকেলগাছ আর কেয়া বনের সৌন্দর্য সেন্টমার্টিনের গ্রহণযোগ্যতা আরো অনেক গুণ বাড়িয়ে দেয় ভ্রমণপিপাসুদের কাছে। কক্সবাজার জেলার টেকনাফ উপজেলায় অবস্থিত এই দ্বীপ বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের বুকে জেগে ওঠা একমাত্র প্রবালদ্বীপ।
এত সুন্দর ভৌগোলিক পরিবেশে অবস্থিত এই দ্বীপের বর্তমানে বড়ই বেহাল দশা। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে সেন্টমার্টিনের পরিবেশের ওপর পড়ছে বিরূপ প্রভাব। প্রতিনিয়ত কমে যাচ্ছে প্রবালের পরিমাণ। কমছে গাছপালা আচ্ছাদিত অঞ্চলের পরিমাণ, নষ্ট করা হচ্ছে প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা কেয়া বন। যেখানে ১৯৯৬-৯৭ সালে সেন্টমার্টিনে বার্ষিক পর্যটকের সংখ্যা ছিল মাত্র ১৫০-২০০ জন, সেখানে এখন প্রতি বছর লক্ষাধিক পর্যটক ভিড় করছে এই দ্বীপে। এতে একদিকে পর্যটন সম্ভাবনা বিকশিত হলেও, অন্যদিকে হচ্ছে পরিবেশের বিপর্যয়।
জীববৈচিত্র্যের আধার হিসেবে বিবেচিত দেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিনের প্রবালগুলো রোগাক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে। গত চার দশকে এ দ্বীপ উপকূল থেকে হারিয়ে গেছে হাজার হাজার টন প্রবাল ও পাথর। ফলে ক্ষয়ের শিকার হয়ে উপকূলের বিস্তীর্ণ ভূমি সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বিশেষ করে দ্বীপের উত্তর উপকূলে সৃষ্টি হয়েছে ভাঙনের। মনুষ্যঘটিত বেশ কয়েকটি অভ্যাসের কারণে দ্বীপটি পরিবেশগত ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাবের শিকার হয়েছে। অবিলম্বে এ দ্বীপে পরিবেশগত পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ নেয়া না হলে অদূর ভবিষ্যতে দ্বীপটি সাগরগর্ভে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন বিজ্ঞানীরা।
কক্সবাজারের পেঁচারদ্বীপস্থ বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বুরি) বিজ্ঞানীদের ২০২০-২১ অর্থবছরে সম্পাদিত গবেষণা ফলাফল উপস্থাপনের ওপর আয়োজিত এক সেমিনারে বিজ্ঞানীরা এ তথ্য প্রকাশ করেন।
বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তৃতা করেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব জিয়াউল হাসান এবং বিশেষ অতিথির বক্তৃতা করেন পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সচিব) অধ্যাপক ড. মো. কাউসার আহাম্মদ।
প্রধান অতিথি বলেন, বর্তমান সরকার দেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতির ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। পরিবেশ ও পর্যটনের উন্নয়নের মাধ্যমেই সুনীল অর্থনীতির বিকাশ ঘটাতে হবে। যদি আমাদের প্রাকৃতিক রিসোর্স বা সম্পদ শেষ হয়ে যায়, তাহলে উন্নয়ন কখনো টেকসই হবে না। তাই প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেই অর্থনীতির বিকাশ ঘটাতে সরকার বদ্ধপরিকর।
সেমিনারে ‘প্রবাল ও সেন্টমার্টিন দ্বীপ’ শীর্ষক মূল গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ও সমুদ্র বিজ্ঞানী সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দর (অতিরিক্ত সচিব)।
তিনি বলেন, সমৃদ্ধ ‘জীববৈচিত্র্যের আধার’ হিসাবে বিবেচিত দেশের একমাত্র প্রবালসমৃদ্ধ দ্বীপটির প্রবালগুলো রোগাক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে। সেন্টমার্টিন দ্বীপ বৃহস্পতিবার পরিদর্শনকালে বিস্তীর্ণ এলাকায় মৃত প্রবাল পাথর দেখা গেছে। গত চার দশকে এ দ্বীপ উপকূল থেকে হারিয়ে গেছে হাজারও টন প্রবাল ও পাথর। এ কারণে ক্ষয়ের শিকার হয়ে উপকূলের বিস্তীর্ণ ভূমি সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে, বিশেষ করে দ্বীপের উত্তর উপকুলে ভাঙনের সৃষ্টি হয়েছে।
নব্বই দশকে সেন্টমার্টিন দ্বীপ নিয়ে তার গবেষণা ও বর্তমান গবেষণার একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণ তুলে ধরে বলেন, মনুষ্যঘটিত বেশ কয়েকটি প্রভাবে দ্বীপটি যেভাবে পরিবেশগত বিপর্যয়ের শিকার হয়েছে, তা অব্যাহত থাকলে এবং অবিলম্বে পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ না নেওয়া হলে অদূর ভবিষ্যতে দ্বীপটি সাগরগর্ভে তলিয়ে যেতে পারে।
সেন্টমার্টিন দ্বীপের পরিবেশগত পুনরুদ্ধারের জন্য বুরি বিজ্ঞানীরা কয়েকটি প্রজাতি চিহ্নিত করেছেন এবং যার মাধ্যমে সেন্টমার্টিনে দ্বীপে কৃত্রিম উপায়ে কোরাল রিফ গড়ে তোলার কৌশলও অর্জন করেছেন বলে জানান মহাপরিচালক সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দর।
তিনি দ্বীপে পরিবেশগত বিপর্যয়ের জন্য প্রবাল মরে যাওয়া, আহরণের কারণে উপকূল থেকে প্রবাল ও পাথর হারিয়ে যাওয়াকে দায়ী করছেন। তিনি অপরিকল্পিতভাবে পর্যটন শিল্প গড়ে তোলা, প্লাস্টিক ও অন্যান্য দূষণ, ক্ষতিকর পদ্ধতিতে মাছ ধরা, অতিরিক্ত মাছ ধরা ও বড় বড় জাহাজ চলাচলসহ মনুষ্যঘটিত অন্যান্য কারণেই এ দ্বীপের প্রবালগুলোর রোগাক্রান্ত হওয়া ও মরে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে বলে মনে করেন।
দেশের একমাত্র প্রবালসমৃদ্ধ দ্বীপটির প্রবালগুলো রোগাক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে। সেন্টমার্টিন দ্বীপ বৃহস্পতিবার পরিদর্শনকালে বিস্তীর্ণ এলাকায় মৃত প্রবাল পাথর দেখা গেছে। গত চার দশকে এ দ্বীপ উপকূল থেকে হারিয়ে গেছে হাজারও টন প্রবাল ও পাথর। এ কারণে ক্ষয়ের শিকার হয়ে উপকূলের বিস্তীর্ণ ভূমি সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে, বিশেষ করে দ্বীপের উত্তর উপকুলে ভাঙনের সৃষ্টি হয়েছে।
বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে প্রতিবছরই পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা অল্প অল্প করে বাড়ছে। পৃথিবীব্যাপি এর প্রভাবের তারতম্য আছে। কোথাও বেশি কোথাও কম। তবে সামুদ্রিক জীব এবং উদ্ভিদ দুটোর উপরেই বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রভাব অনেক মারাত্মক। এই উষ্ণতার প্রভাবে ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সমুদ্রের তলদেশের বাস্তুতন্ত্রের ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। এটি গত ১০ বছরে সমুদ্রের ১৪ শতাংশ ‘সাগর রত্ন’ প্রবাল প্রাচীরকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলেছে।
সমুদ্রের পানির উষ্ণতা বৃদ্ধি আর জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই এই মহামারির কবলে পড়েছে প্রবাল জগৎ। এভাবে উষ্ণতা বাড়তে থাকলে গভীর সমুদ্রের তাৎপর্যপূর্ণ প্রবাল প্রাচীর আরও ক্ষতির মুখে পড়বে। বৈশ্বিক উষ্ণতার এই নেতিবাচক প্রভাবের চিত্র উঠে এসেছে আরেকটি গবেষণায়।
গ্লোবাল কোরাল রিফ মনিটরিং নেটওয়ার্কের তিন শতাধিক বিজ্ঞানী প্রবালের আবাসস্থল এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে গবেষণার পর এক প্রতিবেদনে জানান, উষ্ণতার প্রভাবে দক্ষিণ এশিয়া, আরব উপদ্বীপ ও অস্ট্রেলিয়া উপকূল এবং প্রশান্ত মহাসাগরের প্রবাল সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
প্রবাল প্রাচীরগুলো সমুদ্রের তলদেশের মাত্র শূন্য দশমিক দুই শতাংশ জুড়ে রয়েছে, তবে এগুলো সমস্ত সামুদ্রিক প্রাণী এবং উদ্ভিদের কমপক্ষে এক-চতুর্থাংশের বাসস্থান। নিসর্গের সৌন্দর্যে যেমন ভিন্নমাত্রা যুক্ত করে আণুবীক্ষণিক প্রাণীটি, ঠিক তেমনি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা আর সামুদ্রিক প্রাণী বিশেষ করে সামুদ্রিক মাছের খাদ্য হিসেবেও প্রবাল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷
গবেষণায় ১০টি প্রবাল প্রাচীর নিঃশেষ হওয়ার পেছনে প্রবাল ব্লিচিং, অতিরিক্ত মাছ শিকার, অনুন্নত উপকূল এবং পানির মান রক্ষায় অবহেলা প্রভৃতিকে কারণ বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমনের ফলে ৯০ শতাংশ তাপ সমুদ্র শোষণ করে নেয় এবং যার প্রভাব পড়ে প্রবাল প্রাচীরের ওপর।
বর্তমানে প্রবাল প্রাচীর নতুন এক বিপদের সম্মুখীন, মাত্র কয়েক সপ্তাহের জন্য তাপমাত্রা ২৮ ডিগ্রী বিরাজ করলেই, এদের উদ্ভিদ কোষের মৃত্যু ঘটে। ফলে, প্রবালগুলো তাদের রং এবং খাদ্যের প্রধান উত্স হারিয়ে ফেলে। উচ্চ তাপমাত্রা দীর্ঘমেয়াদি হলে পলিপগুলো মৃত্যুবরণ করে। বিগত কয়েক বছর, পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক প্রবাল প্রাচীর উষ্ণতা বৃদ্ধিতে আক্রান্ত।
এক সময়ের সমৃদ্ধ সামুদ্রিক রাজ্যগুলি পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে। ফলে ,এসব প্রাচীরে বসবাস করা প্রাণীগুলো হয়ে পড়েছে গৃহহীন।
কিছু বিজ্ঞানীদের মতে চলতি শতাব্দীর মধ্যেই পৃথিবীর সকল প্রবাল প্রাচীর এর অস্তিত্ব বিলীন হবে।
এদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়ে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের প্রায় ১৭ শতাংশ এলাকা পানির নিচে তলিয়ে যেতে পারে এবং ২ কোটি মানুষ বাস্ত্যুচুত হতে পারেন বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাই কমিশনার মিশেল ব্যাচলেট মানবাধিকার পরিষদের ৪৮তম অধিবেশনে এক প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে এই তথ্য জানান।
গত একদশক ধরে সেন্টমার্টিনের চতুর দিকে ভাঙন অব্যাহত থাকলেও ভাঙন প্রতিরোধের কার্যত কোন ব্যবস্থা নেয়নি সংশ্লিষ্টরা। চলতি বর্ষায় প্রতিদিন নতুন নতুন ভাঙন যুক্ত হয়েছে। বিশেষ করে দ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিমে অংশে অবিশ্বাস্য ভাঙনে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে সেন্টমার্টিন।
তবে পরিবেশবিদ ও বিশ্লেষকদের মতে ভাঙন ছাড়াও অপরিকল্পিত পর্যটক ব্যবস্থার কারণে প্রতিদিন একটু একটু করে দেবে যাচ্ছে দ্বীপটি। চতুর্মুখী ভাঙনে ৮০ শতাংশ বিলুপ্ত হয়ে গেছে দ্বীপ রক্ষায় বুকপেতে দেওয়া কেয়াবন। এতে করে তলিয়ে যাওয়ার শংঙ্কা বাড়ছে দ্বীপটির।
পরিবেশবিদরা বলেন, সেন্টমার্টিন ভাঙনের অন্যতম কারণ হচ্ছে— দ্বীপ রক্ষাকারী কেয়াবন, সাগর লতা নিধন,পাথর ও শৈবাল উত্তোলন। নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও কটেজ রিসোর্টসহ নানান স্থাপনা নির্মাণকে দ্বীপ ভাঙনের অন্যতম কারণ বলা যায়।
তাদের মতে, দ্বীপ রক্ষায় শুধু বেড়িবাধ যথার্থ পদেক্ষেপ নয়। ভাঙন প্রতিরোধে বায়ু প্রটেক্ট— কেয়াবন, সাগরলতাকে পরিকল্পিতভাবে দ্বীপের চতুর্দিক পরিচর্যা করে দেয়াল হিসাবে গড়ে তুলতে হবে।
উল্লেখ্য, প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন দেশিবিদেশি পর্যটকদের কাছে অন্যতম আকর্ষণীয় একটি স্থান। দ্বীপটিতে বছরে তিন থেকে চারমাস পর্যটকরা ভ্রমণের সুযোগ পায়। প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানান বাঁধা সম্মুখিন হবার পরও সেন্টমার্টিন প্রতিবছর সাড়ে ৩ লক্ষাধিক পর্যটক ভ্রমণ করতে পারে।
বিভিন্নসূত্রে পাওয়া তথ্যমতে, ১৯৬১ সালে ৭৫০ জন জনসংখ্যা ছিল সেন্টমার্টিনে। বর্তমানে জনসংখ্যা ১১হাজারের বেশি। পর্যটন মৌসুমে প্রতিদিন ৭ থেকে ১০ হাজার পর্যটক দ্বীপে ভ্রমণে যায়। তার মধ্যে অর্ধেকের বেশি পর্যটক রাত্রিযাপন করছে সেন্টমার্টিনে। পর্যটকদের জন্য প্রায় ২০০ শতাধিক কটেজ ও রিসোর্ট নির্মাণ করা হয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬৩২
আপনার মতামত জানানঃ