ভোট নিয়ে প্রকাশ্যেই চলছে হুমকি ধামকি। নির্বাচন নিয়ে প্রার্থীদের মাঝে প্রচার প্রচারণা নিয়ে বিভিন্ন গলাবাজি ও বাকযুদ্ধ ইত্যাদি থাকলেও এবারের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে এসবের বাইরে গিয়ে বিভিন্ন হুমকি ধামকি চলছে। সরকার দলীয় প্রার্থী ও নেতাকর্মীরা কোনো রাখঢাক ছাড়াই ভোটের জন্য প্রকাশ্যে হুমকি ধামকি দিচ্ছে।
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার ভবানীগঞ্জ ইউপি নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী ও বর্তমান চেয়ারম্যান সাইফুল হাসান রনির কর্মী রিয়াজ উদ্দিন মাঝিকে ক্রসফায়ারসহ হত্যার হুমকির অভিযোগ উঠেছে। ভবানীগঞ্জে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল খালেক বাদলের ভাতিজা আবদুল্লাহ আল মামুন রাব্বি মোবাইল ফোনে কল করে তাকে হুমকি দেন।
শুক্রবার (৩ ডিসেম্বর) রাত ৮ টার দিকে রিয়াজের মোবাইলফোনে রাব্বি কল দেন। রেকর্ডে শোনা যায় প্রতিটি কথার আগে ও পরে রাব্বি খারাপ ভাষায় মিজিকে গালামন্দ করেছেন।
রেকর্ডিংয়ে আবদুল্লাহকে বলতে শোনা যায়, ‘এই মিজি (রিয়াজ উদ্দিন) নিরে। মিজি, যদি আর একটা স্ট্যাটাস দেস নৌকার বিরুদ্ধে, তাহলে তোরে বাড়িত তন (বাড়ি থেকে) ধরি আনি (এনে) ক্রসফায়ার করিয়াম। নৌকার বিরুদ্ধে কোনো স্ট্যাটাস দিলে ডাইরেক্ট আঁকি হালাইয়াম তুই যিয়ানেই থাস (থাকিস)। তুই বাড়িত নি হেডা (সেটা) ক (বল)। তুই নৌকার বিরুদ্ধে স্ট্যাটাস দিবি তো, তুই মহানগর যুবলীগ করস তো, যুবলীগের নাম বেচস কেন? তুই বিএনপির লগে লিয়াজোঁ করে আওয়ামী লীগের পেস্টুন ভাঙস, এগিন (এগুলো) মাইনসে জানে না। বিএনপির লগে লিয়াজোঁ করে যুবলীগের নাম বেচস (বিক্রি করিস)। মারি হালাইয়াম, ডাইরেক্ট মারি হালাইয়াম। তোর বাবা হালিম মাস্টাররে হবে ওয়াপদা অফিসে নাম ধরি কইছি।’
রিয়াজ উদ্দিন মিজি বলেন, কল পেয়ে আমি রাব্বিকে সালাম দিয়েছি। কিন্তু রাব্বি শুরু থেকেই আমাকে ধমক দিয়ে কথা বলা শুরু করেন। প্রতিটি বাক্যে তিনি আমাকে খারাপ ভাষায় গালাগাল করেছে। আমাকে ক্রসফায়ার দেবে, মেরে ফেলবে বলে হুমকি দিয়েছে। নিজের জীবনের নিরাপত্তায় আমি তার বিরুদ্ধে মামলা করবো। আমি নৌকার বিরুদ্ধে কোনও স্ট্যাটাস দিইনি।
এদিকে রিয়াজ উদ্দিন মিজি যুবলীগের কর্মী বলে নিশ্চিত করেছেন সদর থানার যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক রুপম হাওলাদার।
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে আবদুল্লাহ আল মামুন রাব্বি বলেন, হুমকিতো দূরের কথা আমি কাউকে কল দিই নাই। আর কেনইবা হুমকি দেবো। আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করা হয়েছে। ওই কল রেকর্ডিংয়ে আমার ভয়েস নেই। আমার মোবাইল থেকে অন্য কেউ রিয়াজকে কলও দেয়নি। রিয়াজ মামলা করুক, সমস্যা নেই।
রাব্বি হুমকি দেয়ার অভিযোগ অস্বীকার করলেও নৌকার প্রার্থী ও সমর্থকরা হুমকি-ধমকি দিচ্ছে-এমন দাবি করে শুক্রবার রাতে সদর থানায় অভিযোগ দিয়েছেন ৫ স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী। সেখানে রাব্বিকে অভিযুক্ত করেছেন প্রার্থীরা।
আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী চেয়ারম্যান প্রার্থী মামুনুর রশিদ ও বর্তমান চেয়ারম্যান সাইফুল হাসান রনি জানান, নৌকার প্রার্থী নির্বাচনি আচরণবিধি লঙ্ঘন করে প্রচার করছেন। পাশাপাশি তাদের হুমকিতে প্রার্থীসহ সাধারণ মানুষও আতঙ্কিত। এ জন্য সব চেয়ারম্যান প্রার্থী সদর থানায় অভিযোগ দিয়েছেন।
রাব্বি হুমকি দেয়ার অভিযোগ অস্বীকার করলেও নৌকার প্রার্থী ও সমর্থকরা হুমকি-ধমকি দিচ্ছে-এমন দাবি করে শুক্রবার রাতে সদর থানায় অভিযোগ দিয়েছেন ৫ স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী। সেখানে রাব্বিকে অভিযুক্ত করেছেন প্রার্থীরা।
নৌকার প্রার্থী আবদুল খালেক বাদল অবশ্য অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘নৌকার বিরুদ্ধে কীভাবে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা অবস্থান নেয়, সেটা আমি জানি না। প্রতিপক্ষ প্রার্থীরা নির্বাচনি পরিবেশ নষ্ট করার ষড়যন্ত্র করছেন।’
হুমকি দেয়া অডিওর বিষয়ে লক্ষ্মীপুর সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জসিম উদ্দিন বলেন, ‘এ ধরনের একটি অডিও আমি শুনেছি। ঘটনাটি কেউ আমাকে জানায়নি। কেউ অভিযোগও করেনি। অভিযোগ পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে। কোনোভাবে ছাড় দেয়া হবে না।’
চতুর্থ ধাপে ২৬ ডিসেম্বর ভবনীগঞ্জসহ সদর উপজেলার ১৫ টি ইউনিয়নে নির্বাচন হবে। এ ইউনিয়নে বর্তমান চেয়ারম্যান রনি ও আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছাড়া আরও সাত প্রার্থী রয়েছে। এরমধ্যে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি আবদুল হালিম মাস্টার, সাবেক সাধারণ সম্পাদক ফজলুর রহমান ডালি, মামুনুর রশিদ ভূঁইয়া, সাবেক সহ-সভাপতি মোক্তার হোসেন, ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান প্রয়াত মোসলেহ উদ্দিন নিজামের স্ত্রী মমতাজ বেগম, বিএনপিপন্থী শাহ মোহাম্মদ এমরান ও জাহাঙ্গীর হোসেন।
নির্বাচনে অংশ নেয়নি বিএনপি। ভোটের ফাঁকা মাঠেও আওয়ামী লীগ ও এর বিদ্রোহী প্রার্থীরা ঝরাচ্ছে রক্ত। সংশ্লিষ্টদের মতে, ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকেরা নিজেদের মধ্যে সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ায় তা নিয়ন্ত্রণে অনেকটাই বেকায়দায় রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও।
দলীয় মনোনয়ন নিয়ে ক্ষমতাসীন দলও যে স্বস্তিতে নেই, তার প্রমাণ অনেক স্থানে কাউকে মনোনয়ন না দিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে যেসব খবর আসছে, তাতে দেখা যাচ্ছে ইউপি নির্বাচন নিয়ে সংঘর্ষ হচ্ছে মূলত আওয়ামী লীগের মনোনীত ও বিদ্রোহী প্রার্থীর অনুসারীদের মধ্যে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা জানান, এবারের নির্বাচনকে ঘিরে সরকারদলীয় প্রার্থী ও নেতাকর্মীরা কেন্দ্র দখল, ভোট চুরি করার কৌশল, নৌকায় ভোট না দিলে এলাকা ছাড়ার হুমকি প্রকাশ্যেই দিয়ে যাচ্ছে। এতে দেশের সার্বিক এক পরিস্থিতি উঠে আসে। দেশের নির্বাচন, গণতন্ত্র যে সঠিক প্রক্রিয়ায় আগাচ্ছে না তারই নমুনা হিসাবে এসব তুলে ধরতে চান বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতাকর্মীদের দৌরাত্ম্য দিনদিন চাউর হয়ে উঠছে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে ক্ষমতার চূড়ান্তে বসবাস করেন। তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসন ও সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে আগ্রহবোধ না করায় তাদের দৌরাত্ম্য আরও বেড়ে চলেছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯২৬
আপনার মতামত জানানঃ