সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের ‘শান্তি ও নিরাপত্তার’ উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাজ্যকে নতুন সামরিক জোট ‘অকাস’ ঘোষণা করেছেন। যদিওবা বহু প্রতীক্ষার পর চলতি বছরে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের আলোচিত সামরিক জোট ‘ কোয়াড’ আলোর মুখ দেখে। এদিকে বিশ্বে চীনের প্রভাব ঠেকাতে ৩৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের (৩০০ বিলিয়ন ইউরো) বৈশ্বিক বিনিয়োগ পরিকল্পনা প্রকাশ করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। আফ্রিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চীনের প্রভাব মোকাবিলায় পশ্চিমা চেষ্টা হিসেবে দেখা হচ্ছে ইউরোপের এ উদ্যোগকে।
বলা হচ্ছে, তাদের এই পরিকল্পনা চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের (বিআরআই) ‘প্রকৃত বিকল্প’ হবে। বুধবার (১ ডিসেম্বর) ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লিয়েন ‘গ্লোবাল গেটওয়ে স্কিম’ নামে এই মহাপরিকল্পনা সামনে এনেছেন। খবর বিবিসির।
বিআরআই’র আওতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রেল, সড়ক, সেতু, বন্দরসহ নানা ধরনের উন্নয়ন প্রকল্পে মোটা অংকে অর্থায়ন করেছে চীন। তবে অভিযোগ রয়েছে, এর মাধ্যমে চীনের ঋণের ফাঁদে পড়ে যাচ্ছে দেশগুলো, যা থেকে বেরিয়ে আসা অত্যন্ত কঠিন।
ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট বলেছেন, টেকসই প্রকল্প বাস্তবায়নে দেশগুলোর প্রয়োজন ‘বিশ্বস্ত অংশীদার’। এ জন্য এখন ইইউ’র সদস্য দেশ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি খাত থেকে শত শত কোটি ইউরো জোগাড়ের চেষ্টা করছেন তারা।
বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের এই বিশাল অঙ্কের বিনিয়োগ ২০২৭ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী অবকাঠামো, ডিজিটাল ও জলবায়ু প্রকল্পে ব্যয় করা হবে। ইইউ সদস্যরা এ প্রকল্পের অর্থ জোগান দেবে। ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট ‘গ্লোবাল গেটওয়ে স্কিম’ নামক এ পরিকল্পনাটি একটি বিশ্বস্ত ব্র্যান্ড হয়ে উঠবে বলে আশা প্রকাশ করেন।
বিশ্বব্যাপী চীনা বিনিয়োগের ব্যাপারে ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট বলেন, চীন প্রায়ই প্রতিকূল শর্তে এবং অস্বচ্ছ উপায়ে বিনিয়োগ করে থাকে, যা দরিদ্র দেশগুলোকে— বিশেষ করে আফ্রিকার কিছু দেশকে ঋণের ফাঁদে ফেলে চীনের ওপর নির্ভরশীল করে তুলেছে। ইইউর দাবি, চীনের বিকল্প হিসেবে গ্লোবাল গেটওয়ে স্কিমের বিনিয়োগে স্থানীয়দের সুবিধার ওপর অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। এর ফলে সুবিধা পাবে আফ্রিকা। এ ছাড়া বেসরকারি খাতকেও এসব বিনিয়োগে যুক্ত করা হবে। এসব কারণে ইউরোপিয়ান কমিশনের বিনিয়োগ কম ঝুঁকিপূর্ণ হবে।
গ্লোবাল গেটওয়ে স্কিম ঘোষণা করে এক সংবাদ সম্মেলনে উরসুলা ভন ডার লেয়েন বলেন, ‘প্রকৃতপক্ষে দেশগুলোর চীনের অফারের চেয়ে আরো ভালো এবং ভিন্ন অফার প্রয়োজন, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বিনিয়োগ পরিকল্পনাটি চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের প্রকৃত বিকল্প।’
তবে চীনের কৌশলগত পরিকল্পনার ছায়া এরই মধ্যে আফ্রিকা, এশিয়া, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল, এমনকি ইউরোপেও পৌঁছে গেছে। চীনের কসকো কোম্পানি গ্রিসের পাইরাস বন্দরের দুই-তৃতীয়াংশের মালিক, আবার ক্রোয়েশিয়ার একটি প্রধান সেতু তৈরি করেছে চায়না রোড অ্যান্ড ব্রিজ করপোরেশন।
বিশ্বে চীনের প্রভাব ঠেকাতে ৩৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের (৩০০ বিলিয়ন ইউরো) বৈশ্বিক বিনিয়োগ পরিকল্পনা প্রকাশ করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। আফ্রিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চীনের প্রভাব মোকাবিলায় পশ্চিমা চেষ্টা হিসেবে দেখা হচ্ছে ইউরোপের এ উদ্যোগকে।
ভন ডার লিয়েন বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন দেখাতে চায়, একটি ভিন্ন গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি এমন সব প্রকল্প দিতে পারে, যা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য টেকসই উন্নয়নে নজর দেবে।
তার কথায়, প্রকল্পগুলো হতে হবে উচ্চ মানের। উচ্চমাত্রায় স্বচ্ছতা ও সুশাসন নিশ্চিতকরণসহ তা সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর জন্য বাস্তব ফলাফল প্রদানে সক্ষম হতে হবে।
ইইউ’র এক কর্মকর্তা বিবিসি’কে বলেছেন, তাদের এই মহাপরিকল্পনার প্রধান লক্ষ্য থাকবে আফ্রিকাকেন্দ্রিক।
ইউরোপীয় কমিশন প্রেসিডেন্ট বলেন, বিনিয়োগে যখন পছন্দের কথা আসে, তখন হাতে থাকা অল্প কয়েকটি বিকল্পের মধ্যেও অনেক ছোট ছোট বিষয় থাকে, যার পরিণতি হয় অনেক বড়। হতে পারে তা আর্থিকভাবে, রাজনৈতিকভাবে কিংবা সামাজিকভাবে।
প্রেক্ষাপটটিকে অনিবার্য উল্লেখ করে জার্মান মার্শাল তহবিলের জ্যেষ্ঠ ট্রান্স-আটলান্টিক গবেষক অ্যান্ড্রু স্মল বলেছেন, বেল্ট অ্যান্ড রোড না থাকলে বৈশ্বিক সংযোগ থাকবে না।
তিনি বলেছেন, এটি ইউরোপীয়দের পক্ষ থেকে প্রথম উল্লেখযোগ্য চেষ্টায় বিভিন্ন প্যাকেজ একত্রিত করা ও অর্থায়নের প্রক্রিয়াগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। এর ফলে যে দেশগুলো চীনের থেকে ঋণ নেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করছিল, তাদের জন্য অন্য অরেকটি বিকল্প উপায় তৈরি হয়েছে।
অবশ্য যাদের ঠেকাতে এত বড় পরিকল্পনা নিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, সেই চীনই বিষয়টিকে স্বাগত জানাচ্ছে। গত মাসে এক ব্রিফিংয়ে ইইউ’তে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত ঝ্যাং মিং বলেছিলেন, বেইজিং ইইউ’র গ্লোবাল গেটওয়ে পরিকল্পনাকে স্বাগত জানাবে, যদি এটি উন্মুক্ত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য সহায়ক হয়।
তিনি সতর্ক করে আরও বলেছিলেন, অবকাঠামো প্রকল্পগুলোকে যদি ভূরাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত করার চেষ্টা হয়, তবে তা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হবে এবং নিজেদেরই ক্ষতি করবে।
বেল্ট অ্যান্ড রোডকে চীনের পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ নীতিতে বাণিজ্য সংযোগের উন্নয়নের নতুন রাস্তা, বন্দর, রেলওয়ে এবং সেতুতে অর্থ বিনিয়োগ করে দেশটি। এ নীতিটি এশিয়া, ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল, আফ্রিকা—এমনকি পশ্চিম বলকানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিকটবর্তী প্রতিবেশি পর্যন্ত পৌঁছে গেছে।
এ নীতিটিকে ‘ঋণ-আগ্রাসন’ হিসাবে ‘ঋণ-ফাঁদ কূটনীতি’ বলে সমালোচনা করা হচ্ছে। তবে অনেকে এটিকে আরও জটিল হিসেবে চিহ্নিত করে বলেছে, বড় অংকের অর্থ ধার দেওয়া ঝুঁকিমুক্ত নয়। যদিও অন্যান্য দেশের সঙ্গে চীনের তুলনা হয় না।
তাই যেভাবেই হোক, পশ্চিমের সঙ্গে উত্তেজনা বাড়ার পাশাপাশি চীনের অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক পদচিহ্নও বেড়েছে।
এর আগে বিশ্বের স্বল্প ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ঠেকাতে উন্নত দেশগুলোর জোট জি-৭ বিশাল আকারের এক অবকাঠামোগত সহায়তার পরিকল্পনা করে। এর মাধ্যমে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভকে (বিআরআই) টেক্কা দিতে চায় জি-৭। এবার ইইউ চীনকে ঠেকাতে এই বড় বিনিয়োগের বিস্তারিত পরিকল্পনা প্রকাশ করল।
চীন তার বৈরি দেশসমূহের বাজারও দখলে রেখেছে। সে বিনিয়োগ দিয়ে তার প্রভাব তৈরি করতে চায়। গত ২০ বছরে যুক্তরাষ্ট্র ‘ওয়ার অন টেরর’ ঘোষণা দিয়ে তার ভূরাজনীতি, অস্ত্রের ব্যবসা করেছে। এখন ‘চীন ঠেকাও’ নীতিতে যুক্তরাষ্ট্র তার অস্ত্রের ব্যবসা ও ভূ-রাজনীতি প্রসার করছে। ‘কোয়াড’ ও ‘অকাস’ গঠন তা অনেকটা স্পষ্ট করে দিয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪২০
আপনার মতামত জানানঃ