ছুটির দিনে আমরা চিড়িয়াখানা যাই। বাচ্চাদের নিয়ে, পরিবারসহ। চিড়িয়াখানায় গিয়ে বিভিন্ন পাখি, জীবজন্তু দেখি। এটাই আমাদের অভ্যাস। কিন্তু যদি এমন কোনও চিড়িয়াখানা হয়, যেখানে খাঁচার ভেতর পশু নয়, থাকে মানুষ! হ্যাঁ, মানুষ! জলজ্যান্ত রক্তমাংসের মানুষ।
অবাস্তব লাগছে? কিন্তু একটা সময় কিছু জায়গায় সত্যিই ছিল মানুষের চিড়িয়াখানা বা ‘হিউম্যান জু’। যেখানে রীতিমত টিকিট কেটে খাঁচার ওপারের মানুষদের দেখতে আসত আরও কিছু মানুষ। বহু বছর ধরেই, পৃথিবীর নানা দেশে বিশেষত ইউরোপে প্রদর্শিত হয়েছে এই মানুষের চিড়িয়াখানা।
আর এই ঘটনা খুব বেশি বছর আগের নয়। উনবিংশ শতাব্দীর। আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কৃষ্ণাঙ্গদের ধরে আনা হতো। তাদের রাখা হতো খাঁচার মধ্যে। আর সেই কৃষ্ণাঙ্গদের দেখতে প্রতিনিয়ত ভিড় করত মানুষ।
ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এমন শত শত মানুষের চিড়িয়াখানা ছিলো। প্যারিস, হামবুর্গ, জার্মানি, বেলজিয়াম, স্পেন, লন্ডন, বার্সেলোনা, মিলান, পোল্যান্ড, সেন্ট-লুইস কিংবা নিউইয়র্ক; সবখানেই ছিল এমন চিড়িয়াখানা।
বিংশ শতকের গোড়া থেকেই ইউরোপের নানা জায়গায় চালু ছিল এমন আয়োজন। খাঁচার ওপারে যারা থাকতেন, তারা ছিলেন মূলত আদিবাসী সম্প্রদায় এবং আফ্রিকার কালো চামড়ার মানুষ।খাঁচাতেই কাটত তাদের জীবন, করতে হতো তাদের দৈনন্দিন কাজ। স্ত্রী পুরুষ, বৃদ্ধ তরুণ নির্বিশেষে প্রত্যেককে ‘প্রদর্শনের’ জন্য রাখা হত। এমনকি, ছাড় পেত না শিশুরাও।
এমন মানব চিড়িয়াখানা ঠিক কবে থেকে চালু হয়েছিলো তা সুনির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল। তবে মেক্সিকোর টেনোকটিটলান-এর নবম শাসক দ্বিতীয় মক্টেজুমার (রাজত্বকাল ১৫০২-১৫২০ খ্রিষ্টাব্দ) একটি চিড়িয়াখানার কথা জানা যায়; যেখানে নানা রকম পশুপাখির পাশাপাশি বামন, আলবিনো এবং কুঁজোদেরও দেখানো হতো।
রেনেসাঁ যুগে ইতালির মেদিচি পরিবারও এর সাথে যুক্ত ছিল। ষোড়শ শতাব্দীর দিকে কার্ডিনাল হিপোলাইটাস মেদিচির সংগ্রহে বিভিন্ন ধরণের জন্তু-জানোয়ারের পাশাপাশি বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষও ছিলো। এদের মাঝে ছিলো তুর্কী, আফ্রিকান, মুর এবং ভারতীয়রা।
আমেরিকান রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও প্রদর্শনীর মালিক পি. টি. বার্নাম (১৮১০-১৮৯১) ১৮৩৫ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি আফ্রিকান-আমেরিকান ক্রীতদাসী জয়েস হেথকে প্রদর্শন করেছিলেন। বার্নাম হেথের প্রদর্শনী থেকে টাকা কামাতে মিথ্যে গুজব ছড়িয়েছিলেন যে, হেথ আসলে জর্জ ওয়াশিংটনের ১৬১ বছর বয়সী দুধ মা! এছাড়া তিনি জোড়া লাগানো দুই জমজ চ্যাং ও ইং বাঙ্কারকেও প্রদর্শনীতে তুলেছিলেন।
১৮৮৯ সালে প্যারিসে একটা বৃহৎ মেলার আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে আসে প্রায় ১৮ মিলিয়ন মানুষ। প্রদর্শণীর জন্য রাখা হয় চারশতাধিক আফ্রিকান ও অস্ট্রেলিয়ান-এশিয়ান আদিবাসী মানুষকে। নগ্ন কিংবা অর্ধনগ্ন অবস্থায় তাদের রাখা হয়েছিল খাঁচায়। বলাই বাহুল্য, তাদের সাথে ঠিক পশুর মত ব্যবহারই করা হত।
১৮ শতকের শেষ ভাগ থেকে ১৯ শতকের মধ্যভাগ অবধি মানুষের চিড়িয়াখানা গোটা ইউরোপজুড়ে খুব বিখ্যাত ছিল। এমনকি এই চর্চাটা ছড়িয়ে পড়েছিল উত্তর আমেরিকাতেও।
১৯০৬ সালে নিউ ইয়র্ক শহরের ব্রঙ্কস চিড়িয়াখানায় ওটা বেঙ্গা নামের এক কঙ্গোলিজ নারীর প্রদর্শণী হয়। সেখানে বেঙ্গাকে পশুদের সাথে খাঁচায় ছুঁড়ে ফেলা হয়। এমনকি তাকে উল্লুক ও ওরাংওটাংয়ের সাথে লড়াই করতেও বাধ্য করা হয়। রীতিমত অমানবিক এক কাজ!
যদিও, সাধারণ মানুষের কোনো আপত্তি ছিলো না এতে। আজকের মানুষ যেমন শুনেই আঁৎকে উঠছেন, তেমনটা ঘটেনি ওই সময়। বরং, তারা খুব স্বাভাবিক ভাবেই নিয়েছিলেন বিষয়টাকে।
তবে, লন্ডনে কালো মানুষদের এমন একটি প্রদর্শণী বাতিল হয়ে গিয়েছিল বর্ণবাদের অভিযোগে। এতো কিছুর পরও বেলজিয়ারের সিরকায় ১৯৫৮ সালে সর্বশেষ মানুষের প্রদর্শণী হয়েছিল। খুব বেশিদিন আগের কথা কি?
রাজা-রাজড়া থেকে উচ্চবিত্ত, প্রত্যেকের কাছেই বিনোদনের বিষয় ছিল এই চিড়িয়াখানা। আফ্রিকার কালো মানুষগুলো যেন ভিন গ্রহের কোনও এক জীব! এমন মনোভাব নিয়েই তারা দেখতে যেত এদের। ১৮৯৭ সালে কিং লিওপল্ড টু বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে এইরকমই একটি মানব চিড়িয়াখানা শুরু করেন।
যেখানে ‘প্রদর্শনের’ জন্য ২৬৭ জন কঙ্গোর বাসিন্দাকে নিয়ে আসা হয়। ব্রাসেলসের ঠান্ডায় অসুস্থ হয়ে সেই চিড়িয়াখানাতেই মারা যান সাতজন। এরপরও অবশ্য বন্ধ হয়নি এই চিড়িয়াখানা। আস্তে আস্তে ব্রাসেলস থেকে লন্ডন, প্যারিস, অসলোর মতো শহরে শুরু হয় এটি।
১৯৫৮ সালের পর এই মানুষের চিড়িয়াখানা অবশ্য আর দেখা যায়নি। কিন্তু এত বছর ধরে চলা একটা ঘৃণ্য প্রথার স্মৃতি এখনও রয়ে গেছে। রয়ে গেছে চিড়িয়াখানার ভেতরে থাকা মানুষগুলোর এখনকার প্রজন্মের মধ্যে। নিছক বিনোদনের জন্য একটা অংশকে এভাবে ব্যবহার করা, এটা কি কখনও ক্ষমার যোগ্য?
এসডব্লিউ/এসএস/১৭২০
আপনার মতামত জানানঃ