প্রাচীনকালের প্রথা, ধর্ম, সাহিত্য, শিল্পকলা প্রভৃতিতে রয়েছে পাখির প্রত্যক্ষ উপস্থিতি। কিন্তু এই পাখির শুরুটা কীভাবে? অবশ্য কীভাবে বা কখন পাখিরা পৃথিবীতে এসেছিল তা সঠিকভাবে বলা মুশকিল। এ নিয়ে রয়েছে নানা মতবাদও।
সম্প্রতি ব্রাজিলে প্রাগৈতিহাসিক যুগের একটি পাখির ফসিল বা জীবাশ্ম পাওয়া গেছে। প্রায় ১১ কোটি ৫০ লাখ বছর আগে ক্রেটাসিয়াস যুগের প্রথম দিকে কারিরিয়াভিস নামের এই প্রজাতির পাখি বিচরণ করত। খবর সায়েন্স নিউজ।
এদের আবাসস্থল ছিল সুপারকন্টিনেন্ট গন্ডয়ানায়। এই সুপারকন্টিনেন্টের অন্তর্ভুক্ত ছিল দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, অ্যান্টার্কটিকা ও ভারত।
কারিরিয়াভিস ওরনিথারোমোরফা প্রজাতির পাখি বলে জানিয়েছেন দেশটির ইউনিভার্সিটি ফেডারেল ডো রিও ডি জেনেরিওর জীবাশ্মবিদ ড. ইসমার ডি সৌজা কারভালো।
তিনি বলেন, এ পর্যন্ত পাখির যেসব প্রজাতি বিলুপ্ত হয়েছে এবং জীবিত আছে, এদের সবই ওরনিথারোমোরফার বংশধর। কারিরিয়াভিসের গঠনে পৃথিবীর প্রাথমিক ও বর্তমান যুগের পাখি উভয়ের সংমিশ্রণ আছে। আকারে বড় এই পাখির পা ছিল মোটা। পায়ের নখগুলো ছিল শক্ত। এক নখে থাকত নখর।
জীবাশ্মবিদ ইসমার বলেন, এই পাখির ফসিল পাওয়া গেছে ব্রাজিলের সিয়েরা প্রদেশের পেদ্রা ব্রানকা খনিতে। এর পায়ের গঠন অনেকটা ভিন্ন। ধারণা করা হচ্ছে, কারিরিয়াভিস বর্তমান সময়ের উটপাখির কাছাকাছি প্রজাতির। যে পাখি বেশি উড়তে পারে না। আর দক্ষিণ আমেরিকায় এর চেয়ে পুরোনো কোনো পাখির ফসিল পাওয়া যায়নি।
এ পর্যন্ত পাখির সবচেয়ে প্রাচীন ‘চিত্র’ পাওয়া গেছে স্পেনের এক গুহায়। প্রত্নতাত্ত্বিকদের ধারণা, সেগুলো পনের থেকে ষোল হাজার বছর আগের গুহা মানবদের আঁকা। তখনকার দিনে শিকারে যাওয়ার আগে গুহার দেয়ালে পশুপাখির ছবি আঁকার একটি রেওয়াজ ছিলো।
আর এ পর্যন্ত পাখির প্রাচীনতম ‘জীবাশ্ম’ পাওয়া গেছে জার্মানির বাভারিয়ার লাইমস্টোন বা কালো পাথরের খনিতে। ১৮৬১ সালে জার্মানির এক পাথরের খনিতে এই পাখির ফসিল বা জীবাশ্ম পাওয়া যায়। সেখানে মূলত একটি পাখির দুটি বৃহৎ ডানার সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। ধারণা করা হয়, এটিই পৃথিবীর প্রাচীনতম পাখি। তবে এ নিয়ে বিতর্কও আছে। তবুও প্রত্নতাত্ত্বিক ও পাখি বিজ্ঞানীরা অনেকটা একমত যে, আবিষ্কৃত আর্কিওপটেরিক্সই পৃথিবীর প্রাচীনতম পাখি।
আবিষ্কারের পর পাখির এই জীবাশ্ম জীববিজ্ঞানীদের মাঝে প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি করে। এর ফলে পাখিদের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে জানার এক নতুন দিগন্ত খুলে যায়। সেই জীবাশ্মের পাখির মাথা দেখতে গিরগিটির মতো। চোয়ালে রয়েছে সারি সারি দাঁত। মেরুদণ্ড অনেকটা গিরগিটির লেজের মতো লম্বা। লেজটা কতগুলো জোড়া দেয়া হাড়ের মতো দেখতে, যার দু’পাশ জুড়ে থাকতো ঘন পালক। এ কারণেই একদল পাখি বিজ্ঞানীর অনুমান, গিরগিটি থেকে বিবর্তিত হয়ে পাখির উৎপত্তি হয়েছে। অনেকে আবার এর সাথে মিল পেয়েছেন ডাইনোসরের।
এই আদি পাখির পালক ও হাড়গুলো লন্ডনের ন্যাচারাল হিস্টোরি মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে। বিজ্ঞানীরা এই পাখির নামই দিয়েছেন আর্কিওপটেরিক্স। তাদের ধারণা, এর বয়স ১৩ থেকে ১৪ কোটি বছর। তাদের দাবি, এটিই পৃথিবীর প্রাচীনতম পাখি।
পাখি এক বৈচিত্র্যময় প্রাণী। একইসাথে সে হাঁটতে ও উড়তে পারে। বিশেষত পাখির উড়তে পারা নিয়ে প্রাচীন মানুষের মাঝে ছিল অসীম কৌতূহল। অনেক সভ্যতায় তাই পাখিকে দেয়া হয়েছে দেবতুল্য সম্মান। যেমন বাজ পাখিকে মিশরীয়রা মনে করতো জাগ্রত দেবতা। নগরের অধিবাসীদের রক্ষা করতো এই দেবতা— এমনটাই বিশ্বাস ছিল তাদের। কথিত আছে, মিশরীয়দের মৃত্যুর দেবতা সেকেরের মুখ ছিল শিকারি বাজপাখির মতো। সূর্যদেব হোরাস ও পশ্চিম দিকের দেবতা আমেনত এর মুখ ছিল আইবিস পাখির ঠোঁটের মতো লম্বাটে।
প্রাচীন সুমেরীয় সভ্যতায়ও ছিল পাখির প্রভাব। ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রিস নদীর তীরে আবিষ্কৃত এই সভ্যতার ধ্বংসাবশেষে পাওয়া গেছে একাধিক পাখি মূর্তির সন্ধান। ভারতীয় উপমহাদেশের সিন্ধু নদের তীরে আবিষ্কৃত প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতায়ও ছিল পাখির সরব উপস্থিতি। মহেঞ্জোদারোর অধিবাসীদের তৈজসপত্রের গায়ে পাওয়া যায় অসংখ্য পাখি-চিত্রের সন্ধান।
প্রাচীন ধর্মগ্রন্থগুলোতেও পাওয়া যায় পাখির উপস্থিতি। মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কুরআন শরীফে উল্লেখ আছে আবাবিলের কথা। ১১৪টি সুরার মধ্যে একটি সম্পূর্ণ সূরা নাজিল হয়েছে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে।
বাইবেলে উল্লেখ আছে, সাদা সারসের কথা। এই পাখিরা উত্তর ইউরোপ থেকে ইসরায়েলে এসেছিল। ইহুদি ধর্মে সারসকে আনুগত্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। প্রচণ্ড বিপদেও সারসরা একে অপরকে ছেড়ে যায় না। ভাববাদী যিরমিয় ইহুদীরা যখন ঈশ্বর যিহোবার আনুগত্য পরিত্যাগ করেছিল, তখন তাদের সারসের উদাহরণ দিয়ে ধর্মের পথে ফিরে আসার আহ্বান জানানো হয়েছিলো।
প্রাচীনকালে সাহিত্যের পাতা জুড়েও পাওয়া যায় পাখির বিবরণ। গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস কিংবা উপমহাদেশের প্রাচীন কবি বাল্মীকি, কালিদাস, বানভট্ট প্রমুখের কবিতায়ও ছিল পাখির প্রসঙ্গ। বাল্মীকি তার জীবনের প্রথম কবিতা লিখেছিলেন একটি চখাচখি হাঁসের বিরহ বেদনা নিয়ে। কালিদাসের অমর সৃষ্টি মেঘদূতে চাতক, বক, ময়ূর, শালিক, পাহাড়ি ময়না, চখাচখি, নীলকণ্ঠ, গোলাপায়রা প্রভৃতি পাখির বিবরণ উঠে এসেছে। বানভট্টের অপূর্ব সৃষ্টি কাদম্বরী শুরু হয়েছে পম্পা সরোবর তীরের গভীর অরণ্যের বর্ণনা দিয়ে। সেখানে খোঁজ মেলে অসংখ্য পাখির। বিশেষত এক শুকপাখির মুখ দিয়ে তিনি পাখিদের জীবনের মর্মস্পর্শী বিরহ বেদনা তুলে ধরা হয় সেখানে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৫৬
আপনার মতামত জানানঃ