তৃতীয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ আজ। সারা দেশের এক হাজার ইউনিয়ন ও ৯টি পৌরসভায় আজ ভোটগ্রহণ করা হবে। এ ধাপের নির্বাচনে আগে ব্যাপক সংঘাত ও প্রাণহানি হওয়ায় সংঘাত-সহিংসতার শঙ্কা নিয়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে নির্বাচন।
আগের ধাপগুলোতে সহিংসতা ও প্রাণহানি হওয়ায় এবার নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কঠোর অবস্থানের কথা জানানো হয়েছে। প্রস্তুতিও নেয়া হয়েছে ব্যাপক।
এর আগে প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের ইউপি নির্বাচনে এ পর্যন্ত ২১০টি সংঘর্ষের ঘটনায় আহত হয়েছে দুই হাজার ৫৪৩ জন। আর প্রাণ হারিয়েছে ৪০ জন।
সাংবাদিকদের হুমকি
এর মধ্যেই সাংবাদিকদের ফাটিয়ে ফেলতে কর্মী ও দলীয় বাহিনীকে নির্দেশনা দিয়েছেন লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলা চেয়ারম্যান ও রায়পুর উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অধ্যক্ষ মামুনুর রশীদ।
পুলিশের উপস্থিতিতে চরপাতা ইউনিয়ন অফিসে রাতে এই হুমকি ও নির্দেশ দিলে পুলিশ তখন অসহায় নিরব দর্শক। সাথে ছিলেন যুব লীগ নেতা।
নির্বাচনী সংবাদ সংগ্রহে ঢাকা থেকে আগত একদল সাংবাদিককে গতরাতে তিনি এই হুমকি দেন। পাশাপাশি একমাত্র নৌকা প্রতীকের চেয়ারম্যান প্রার্থী ছাড়া আর কারো পোস্টার তারা লাগাতে দেননি বলে অপর তিন প্রার্থী সাংবাদিকদের জানান।
উপজেলা চেয়ারম্যান তার সাথে থাকা লোকজনদের নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘সাংবাদিকদের ফাটিয়ে ফেলবি পুলিশ তোদের সাথে আছে’। পুলিশ কর্মকর্তা অসিমকে বলেন, এরা কারা? সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, এখানে আপনাদের কাজ কী? আপনারা কেন এসেছেন?
৫ নম্বর চরপাতা ইউনিয়নে রাতে সর্বত্র ভীতিকর পরিস্থিতি বিরাজমান ছিল। সাংবাদিকরা রিটার্নিং কর্মকর্তা ও পুলিশ সুপারকে হুমকির কথা জানালে তারা নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
তৃতীয় ধাপে রোববার দেশের ১ হাজার ইউপিতে ভোটগ্রহণ চলছে। এরমধ্যে লক্ষ্মীপুরের রায়পুরে ১০টি ইউপিতে ভোট চলছে। যদিও ১০ জনের মধ্যে ৩ জন চেয়ারম্যান পদে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন।
বিরোধীদের অভিযোগ
৫ নম্বর চরপাতা ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান ও বিদ্রোহী প্রার্থী খোরশেদ আলম বলেন, ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে আমাকে নৌকা প্রতীক বরাদ্দ দেয়া হয়নি। নির্বাচনে বিভিন্ন অনিয়ম, হুমকির ঘটনা নিয়ে আমি ৯টি অভিযোগ করেছি। কিন্তু প্রশাসনকে অভিযোগ দেয়া হলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
একই ইউনিয়নের আরেক স্বতন্ত্রপ্রার্থী হাজী বিল্লাল হোসেন (আনারস) ও হিজবুল্লাহ গুনু (মোটরসাইকেল) সাংবাদিক এসেছে শুনে ইউনিয়ন পরিষদে ছুটে আসেন। তারাও একই ধরনের অভিযোগ করেন। প্রতিপক্ষের ভয়ে পালিয়ে থাকেন বলেও তারা অভিযোগ করেন।
এ ব্যাপারে জেলা পুলিশ সুপার ড. এ এইচ এম কামরুজ্জামান বলেন, নির্বাচন কমিশনের বৈধ অনুমতি বা পরিচয়পত্র থাকলে সাংবাদিকদের কাজে বাধা দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। কেউ এ ধরনের কর্মকাণ্ড করলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এ এইচ এম কামরুজ্জামান বলেন, ‘সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, আবাধ ও সন্ত্রাসমুক্ত নির্বাচন দিতে আমরা শতভাগ প্রস্তুত। আমরা নির্বাচনী আইন অক্ষরে অক্ষরে পালন করব। কোনো অন্যায়কারীকে ছাড় দেয়া হবে না। কেউ কোনো বিশেষ সুবিধা পাবে না।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা হারুন মোল্লা বলেন, বহিরাগতদের বিষয়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটসহ পুলিশ প্রশাসনকে অবগত করা হয়েছে। বহিরাগতদের ব্যাপারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
জেলা প্রশাসক আনোয়ার হোসেন আকন্দ বলেন, ‘নির্বাচন সুষ্ঠু করতে পর্যাপ্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থাকবে।’
নির্বাচনের নামে অরাজকতা
এদিকে, তৃতীয় ধাপের এ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন মোট ৫৬৯ প্রার্থী। এর মধ্যে চেয়ারম্যান ১০০ জন, সাধারণ সদস্য পদে ৩৩৭ জন এবং সংরক্ষিত সদস্য পদে ১৩২ প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। বিনা ভোটে জয়ী হওয়ার ক্ষেত্রে তৃতীয় ধাপেও এগিয়ে আছে চট্টগ্রাম অঞ্চল।
বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিতদের বাদ দিলে ভোটের লড়াইয়ে আছেন ৫০ হাজার ১৪৬ জন প্রার্থী। তাদের মধ্যে ৪ হাজার ৪০৯ জন চেয়ারম্যান পদে, ১১ হাজার ১০৫ জন সংরক্ষিত সদস্য পদে ও ৩৪ হাজার ৬৩২ জন সাধারণ সদস্য পদে লড়বেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিএনপি-জামায়াতসহ সরকারবিরোধী অন্য দলগুলো ইউপি নির্বাচনে সরাসরি অংশ না নিলেও তাদের তৎপরতা থেমে নেই। দেশের বিভিন্ন জায়গায় তারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করছেন। আবার আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরাও নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। এ কারণে নির্বাচন ঘিরে সংঘর্ষ ও প্রাণহানির ঘটনা বেড়ে চলেছে।
এমন পরিস্থিতিতে তৃতীয় ধাপের নির্বাচনে কঠোর অবস্থানে থাকার কথা ভাবছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো। এ জন্য পুলিশ সদর দপ্তর থেকে বিশেষ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
এর মধ্যেই নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালিয়ে দুটি মাইক্রোবাসসহ ২১ যুবককে আটক করেছে। পুলিশ জানায়, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংসতা সৃষ্টির লক্ষ্যে তারা জড়ো হন।
গতকাল শনিবার রাত ৯টার দিকে উপজেলার কাবিলপুর ইউনিয়নের দিলদার মার্কেট থেকে সেনবাগ থানার অফিসার ইনচার্জ ওসি ইকবাল হোসেন পাটোয়ারী ও হাতিয়া থানার ওসি আনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে সঙ্গীয় পুলিশ ফোর্স তাদের আটক করেন।
সেনবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো: ইকবাল হোসেন পাটোয়ারী বলেন, রোববার সেনবাগ উপজেলায় তৃতীয় ধাপে ৫টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভার ইউপি নির্বাচনে সহিংসতা সৃষ্টি করার জন্য তারা জড়ে হয়েছেন বলে নিশ্চিত করেন।
নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও দেশের গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান, পুলিশ সদর দপ্তরে আইজিপিসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বৈঠক করছেন। আরও বৈঠক করছেন রেঞ্জ ডিআইজি ও পুলিশ সুপাররা। র্যাব কর্মকর্তারাও আলাদাভাবে বৈঠক করছেন। সামনের দিনগুলোয় যাতে আর প্রাণহানির ঘটনা না ঘটে, সে জন্য কঠোর দৃষ্টি রাখছে পুলিশ ও র্যাব।
গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ইউপি নির্বাচন ঘিরে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার ও সরবরাহ বেড়েছে; যা নির্বাচন ঘিরে ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী জোটের বিরোধকে রক্তক্ষয়ী সংঘাতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
গোয়েন্দাদের আশঙ্কা, তৃণমূলে যেভাবে সহিংসতা বাড়ছে, তাতে নির্বাচন-পরবর্তী সময়ও এর জের থেকে যাবে। এতে স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ উদ্বিগ্ন। নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতা ঠেকাতে এরই মধ্যে জেলার পুলিশ সুপারদের আরও কঠোর হওয়ার পাশাপাশি অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সংঘাত-সহিংসতার ঝুঁকিতে থাকা প্রতিটি উপজেলায় অতিরিক্ত পুলিশি টহলের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেন, নির্বাচনী এলাকার আইনশৃঙ্খলার নিয়ন্ত্রণ নির্বাচন কমিশনের হাতে। তারপরও খুনোখুনি ও সংঘর্ষের ঘটনা যেন না ঘটে, এ বিষয়ে এসপিদের সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
থানা ও জেলার সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের ডেকে সমন্বয় করে ব্যবস্থা নেওয়ার তাগিদ রয়েছে। কোথাও সংঘর্ষের আশঙ্কা থাকলে দ্রুত তা থানা পুলিশ কিংবা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানোর অনুরোধ করা হয়েছে।
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের বলছেন, ইউপি নির্বাচনকেন্দ্রিক বেশিরভাগ সহিংসতা হচ্ছে আওয়ামী ঘরানার প্রার্থীদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে। স্থানীয় পর্যায়ে সংসদ সদস্য, উপজেলা চেয়ারম্যান ও প্রভাবশালী নেতারা নিজ নিজ পছন্দের প্রার্থীকে নির্বাচনে জয়ী করতেই জন্ম দিচ্ছে সহিংসতার।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫৪০
আপনার মতামত জানানঃ