তিন বছর আগের এক রাতে অফিস থেকে বাসায় ফেরার সময় রাজধানীর মহাখালী বাসস্ট্যান্ডে বাসের অপেক্ষায় ছিলেন একজন নারী সাংবাদিক। তখন একটি ছেলে তার গা ঘেঁষে হাঁটছিল, অশালীন অঙ্গভঙ্গি করছিল। তিনি প্রতিবাদ করলে ছেলেটি অশোভন কথা বলতে শুরু করে।
আশপাশের লোকজন ছেলেটিকে না থামিয়ে উল্টো তাকে বলেন, ‘আপা, আপনি মেয়েমানুষ, চুপ থাকেন।’ এতে ক্ষোভে–দুঃখে নিজেকে সামলাতে না পেরে একপর্যায়ে কাঁদতে শুরু করেন ওই নারী সাংবাদিক। তিনি বলেন, ‘এখনো রাতে যদি বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়াতে হয়, সেদিনের ঘটনা চোখের সামনে ভাসতে থাকে।’
দেশজুড়ে বাড়ছে নারী নির্যাতন ও সহিংসতার ঘটনা। প্রসঙ্গত, আজ ২৫ নবেম্বর আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস। নারীর ওপর যে কোন ধরনের নির্যাতনের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধে সর্বস্তরের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য আন্তর্জাতিকভাবে এ দিনটি পালন করা হয়। ১৯৯৯ সালের ১৭ নবেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ২৫ নবেম্বরকে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
জনসম্মুখেই যৌন হয়রানি-সহিংসতা
দেশের রাস্তাঘাট, গণপরিবহন, বাসস্ট্যান্ড, রেলস্টেশনসহ বিভিন্ন জনসমাগমস্থলে ৮১ দশমিক ৬ শতাংশ নারী যৌন হয়রানি ও সহিংসতার শিকার হন। তবে এসব ঘটনায় মামলা হচ্ছে ৩ শতাংশের কম (২.৯%)।
একটি বেসরকারি সংস্থার জরিপে এ চিত্র পাওয়া গেছে। তবে এ জরিপ অনুসারে নারীদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সহিংসতার ঘটনা ঘটছে পারিবারিক বলয়ে, ৮৬ দশমিক ৮ শতাংশ।
জরিপে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে করা প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের ‘চ্যালেঞ্জিং ফিয়ার অব ভায়োলেন্স’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, যৌন হয়রানি-নিপীড়নের শিকার নারীদের অনেকে মানসিক অবসাদে ভোগেন, আত্মবিশ্বাস কমে যায়। ভীত হয়ে পড়েন, অসুস্থ হয়ে পড়েন, লেখাপড়ায় মনোযোগ হারান। এমনকি পরীক্ষায় অকৃতকার্যও হন কেউ কেউ।
পারিবারিক বলয়, কর্মক্ষেত্র, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অনলাইন প্ল্যাটফর্ম আর জনসমাগমস্থল— এই পাঁচ ক্ষেত্রে জরিপটি করা হয়েছে। এই জরিপ অনুযায়ী, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সহপাঠী ও শিক্ষকদের মাধ্যমে শারীরিক-মানসিক নির্যাতন, হয়রানি ও ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের শিকার হচ্ছেন ৭৪ শতাংশ।
অনলাইন প্ল্যাটফর্মে অশালীন, ক্ষতিকর মন্তব্যের মাধ্যমে নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে ৫৭ শতাংশ আর কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন ৫৬ শতাংশ নারী।
আজ ২৫ নভেম্বর থেকে ১৬ দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ পালন উপলক্ষে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল।
গত জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত আটটি বিভাগের শহর ও গ্রামের ৪ হাজার ৩০৫টি পরিবারের ওপর জরিপটি করা হয়। এতে অংশ নেন ৮ হাজার ৮৫৪ জন। এর মধ্যে ১৫-২৪ বছর বয়সী ২ হাজার ২৩২ জন কিশোরী-তরুণী, ২ হাজার ২০৮ জন তরুণ, ২ হাজার ২১৭ জন মা এবং ২ হাজার ১৯৭ জন বাবা।
নারী নির্যাতন
প্রতি ৩ জন নারীর মধ্যে একজন তার জীবনে কোন না কোন সময়ে শারীরিক বা যৌন সহিংসতার শিকার হয়। প্রতি ৩ জন নারীর মধ্যে দুজন স্বামী/বিপরীত লিঙ্গের বন্ধু/পরিবারের সদস্যদের দ্বারা পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হন। নির্যাতনের শিকার নারীদের মধ্যে বেশিরভাগই নির্যাতনের বিরুদ্ধে সমাজ লোকলজ্জার ভয়ে মুখ খোলেন না।
বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের প্রেক্ষাপটে বিবিসি ও ইউএনএফপিএ প্রদত্ত এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশে বিবাহিত নারীদের মধ্যে প্রায় ৮৭ শতাংশ পারিবারিক সহিংসতার শিকার। ঐ নারীদের মধ্যে ৭৭ শতাংশ প্রতিনিয়ত প্রহৃত হন, এদের মধ্যে ৫৫ শতাংশ নির্যাতিত নারীর চিকিৎসার প্রয়োজন হয়।
এক-তৃতীয়াংশ নারী স্বামী দ্বারা ধর্ষণের শিকার হন। নির্যাতনের ৫০ শতাংশ নারী ১৪ বছরের আগেই ধর্ষণের শিকার হন। এছাড়া এসিড নিক্ষেপ, আগুন দেয়া, সমাজচ্যুত করা, জোরপূর্বক তালাক দেয়া এগুলো প্রতিনিয়ত হচ্ছে।
সহিংসতার পরিণতি
জনসমাগমস্থলে সহিংসতার শিকার ৭২ দশমিক ৪ শতাংশ কিশোরী-তরুণী জানান, তারা মানসিক বিষাদে ভোগেন। পারিবারিক বলয়ে সহিংসতার ভয়ে স্বামীর অনুমতি ছাড়া কোনো কর্মকাণ্ডে জড়াতে ভয় পান ৮০ শতাংশ নারী।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সহিংসতার শিকার ছাত্রীদের ৯০ শতাংশ মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে, হতাশায় ভোগে, একা থাকতে চায়। কেউ কেউ স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়।
কর্মক্ষেত্রে হয়রানির পর কাজে যাওয়া বন্ধ করেন ২৬ শতাংশ নারী। অনলাইনে হয়রানির শিকার মেয়েদের ৭৮ শতাংশ মানসিক চাপে ভোগেন।
জরিপের তথ্য বলছে, জনসমাগমস্থলে যৌন হয়রানির ক্ষেত্রে লোকজনের সাহায্য চান ৪৪.১ শতাংশ নারী, প্রতিবাদ করেছেন ৪৩.৪ শতাংশ, নীরব থেকেছেন ৩৫.৯ শতাংশ, পুলিশকে জানান ৯.৩ শতাংশ এবং ‘৯৯৯’ বা ‘১০৯’ নম্বরে ফোন করেন ৩.৩ শতাংশ নারী। এ ক্ষেত্রে মামলা হয়েছে ২.৯ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টদের মতামত
প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের পরিচালক (গার্লস রাইটস হাব) কাশফিয়া ফিরোজ বলেন, সহিংসতার ভয়ের কারণে মেয়েরা চাকরি ও পেশা নির্ধারণে নানা রকম চাপের মুখে থাকেন। সহিংসতার ভয় মেয়েদের বেড়ে ওঠার পথে বাধার সৃষ্টি করে। এটা বাল্যবিবাহও বাড়ায়।
কাশফিয়া ফিরোজ আরও বলেন, সহিংসতার ভয়ের কারণে মেয়েরা চাকরি ও পেশা নির্ধারণে নানা রকম চাপের মুখে থাকেন। সহিংসতার ভয় মেয়েদের বেড়ে ওঠার পথে বাধার সৃষ্টি করে। এটা বাল্যবিবাহও বাড়ায়।
প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের নীতি নির্ধারণ ও তথ্য বিশ্লেষণে যুক্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শাহ্নাজ হুদা বলেন, সহিংসতার শিকার হওয়ার শঙ্কার প্রভাব কতখানি গুরুতর, তা মেয়েদের জীবনযাপন প্রক্রিয়াকে কীভাবে সংকুচিত করে, মানসিক শক্তি ক্ষয় করে, সম্ভাবনা নষ্ট করে, তাও এ জরিপে দেখানো হয়েছে।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম বলেন, মেয়েদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। মেয়েদের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনতে হবে।
এসডব্লিউ/এসএস/১২০৫
আপনার মতামত জানানঃ