ভারত শাসিত জম্মু-কাশ্মীরের অন্যতম মানবাধিকারকর্মী খুররম পারভেজকে গ্রেপ্তার করেছে ভারতের জাতীয় তদন্ত সংস্থা এনআইএ। সোমবার রাতে শ্রীনগর থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। সন্ত্রাসীদের অর্থায়ন নিয়ে একটি মামলায় সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার করার কথা জানিয়েছে এনআইএ। খবর বিবিসি
মঙ্গলবার সুইজারল্যান্ডে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের সভায় যোগ দেওয়ার কথা ছিল মানবাধিকারকর্মী খুররম পারভেজের। খুররাম পারভেজকে আটকের আগে রোববার তার বিদেশ ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়।
সোমবার বিকেলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের জন্য শ্রীনগরের বাড়ি থেকে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় সংস্থার জম্মু-কাশ্মীর উপত্যকা কার্যালয়ে। সেখানে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে সন্ধ্যায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
গ্রেপ্তারের আগে এনআইএর কর্মকর্তারা শ্রীনগরে খুররমের বাসভবন ও কার্যালয়ে অভিযান চালান। জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশ এবং সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্সের (সিপিআরএফ) সদস্যরা এনআইএ কর্মকর্তাদের সহায়তা করেন। খুররমের বাসভবন শ্রীনগরের সনোয়ারে এবং তার কার্যালয় শহরের আমির কাদাল এলাকায়। পারভেজ জম্মু-কাশ্মীরের বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন এবং ব্যক্তিদের নিয়ে ফেডারেশন জেকেসিসিএসের প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর।
এনআইএ সূত্র জানায়, পারভেজের বিরুদ্ধে বেআইনি কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইন (ইউএপিএ) এবং ভারতীয় দণ্ডবিধির বিভিন্ন ধারায় মামলা করা হয়েছে। তবে তাকে গ্রেপ্তার করা হয় ৬ নভেম্বর হওয়া মামলা ‘এফআইআর আরসি-৩০/২০২১/এনআইএ /ডিএলআই’-এর ভিত্তিতে।
সূত্রটি আরও জানায়, পারভেজের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২০বি (অপরাধী ষড়যন্ত্র), ১২১ (সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে উৎসাহিত করা) এবং ১২১-এ (ধারা ১২১ দ্বারা শাস্তিযোগ্য অপরাধ করার ষড়যন্ত্র), বেআইনি কার্যকলাপ (প্রতিরোধ) আইনের ধারা ১৭ (সন্ত্রাসী কার্যকলাপের জন্য তহবিল সংগ্রহ), ১৮ (ষড়যন্ত্র), ১৮বি (কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিকে সন্ত্রাসী কাজের জন্য নিয়োগ করা) এবং ৪০ (একটি সন্ত্রাসী সংগঠনের জন্য তহবিল সংগ্রহ) ধারায় মামলা রয়েছে।
মঙ্গলবার পারভেজকে নয়াদিল্লিতে নিয়ে যাওয়া হতে পারে বলে জানায় সূত্রটি। তাকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি তার ভাই শেখ শাহরিয়ারকে আগেই জানানো হয়েছে বলেও জানায় তারা।
বিবিসির প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, কঠোর সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অধীন গ্রেপ্তার কাশ্মীরি মানবাধিকারকর্মীর জামিন পাওয়া প্রায় অসম্ভব।
কাশ্মীরসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর হাতে সাধারণের মানুষের গুমের ঘটনা নিয়ে কাজ করে আসা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা এশিয়ান ফেডারেশন অ্যাগেইনস্ট ইনভোলানটারি ডিজঅ্যাপিয়ারেন্সেসের (এএফএডি) চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন খুররম পারভেজ।
দেশটির মানবাধিকার কর্মী এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অন্যান্য ব্যবহারকারীরা খুররম পারভেজের গ্রেপ্তারের ঘটনাকে মানবাধিকার কর্মীদের কণ্ঠরোধ এবং শাস্তি দেওয়ার প্রচেষ্টা বলে নিন্দা জানিয়েছেন। সুপরিচিত এই মানবাধিকারকর্মীকে গ্রেপ্তারের ঘটনা বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে; অনেকেই তাকে ছেড়ে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। মানবাধিকারকর্মীদের পাশাপাশি অন্যরাও তার গ্রেপ্তারকে ‘মানবাধিকারের জন্য লড়তে থাকাদের শাসানোর’ চেষ্টা হিসেবে দেখছেন।
ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) নেতৃত্বাধীন ভারতের ক্ষমতাসীন সরকারের কট্টর সমালোচক কাশ্মীরের এই মানবাধিকার কর্মী। কাশ্মীর-ভিত্তিক খুররমের বেসরকারি সংস্থা জম্মু কাশ্মীর কোয়ালিশন অব সিভিল সোস্যাইটি (জেকেসিসিএস) অতীতে উপত্যকায় মানবাধিকারের লঙ্ঘন এবং ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের খতিয়ান বেশ কয়েকটি প্রতিবেদনে তুলে ধরে।
কাশ্মীরসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর হাতে সাধারণের মানুষের গুমের ঘটনা নিয়ে কাজ করে আসা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা এশিয়ান ফেডারেশন অ্যাগেইনস্ট ইনভোলানটারি ডিজঅ্যাপিয়ারেন্সেসের (এএফএডি) চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন খুররম পারভেজ।
২০১৬ সালে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের ৩৩তম অধিবেশনে যোগ দিতে সুইজারল্যান্ডে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ভারত সরকার। নিষেধাজ্ঞার পরদিন তাকে গ্রেপ্তার করে দেশটির আইনশৃঙ্খলাবাহিনী। একই সঙ্গে তার বিরুদ্ধে দেশটির ব্যাপক বিতর্কিত জননিরাপত্তা আইনে অভিযোগ গঠন করা হয়। এই আইনে দেশটির আইনশৃঙ্খলাবাহিনী যে কাউকে কোনো ধরনের অভিযোগ ছাড়াই দুই বছর পর্যন্ত আটকে রাখতে পারে।
পরে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার তীব্র সমালোচনা এবং ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে দেশটির সরকার গ্রেপ্তারের ৭৬ দিন পর কাশ্মীরের এই মানবাধিকার কর্মীকে মুক্তি দেয়।
সোমবার এনআইএর তদন্তকারীরা খুররমের বাড়ি এবং কাশ্মীরের প্রধান শহর শ্রীনগরে জেকেসিসিএসের কার্যালয়ে তল্লাশি অভিযান পরিচালনা করে। প্রাথমিকভাবে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নেওয়া হলেও পরবর্তীতে সন্ধ্যার দিকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
দেশটির বেআইনি কার্যকলাপ (প্রতিরোধ) আইনের বিভিন্ন ধারায় সরকারবিরোধী যুদ্ধে উসকানি এবং অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এবং সন্ত্রাসী সংগঠনের জন্য তহবিল সংগ্রহের অভিযোগ আনা হয়েছে খুররমের বিরুদ্ধে।
এদিকে, পারভেজ খুররমের গ্রেপ্তারের খবরে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক বিশেষ দূত ম্যারি ললোর। তিনি বলেছেন, পারভেজ খুররম সন্ত্রাসী নন। তিনি একজন মানবাধিকারের রক্ষক। অবিলম্বে তার মুক্তির দাবি জানিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক এই কর্মকর্তা।
উপত্যকায় সম্প্রতি দুই বেসামরিক নাগরিকের প্রাণহানির ঘটনার পর ব্যাপক উত্তেজনার মাঝে কাশ্মীরের এই মানবাধিকার কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬০০
আপনার মতামত জানানঃ